কাশ্মীরে ২৭ জন ভারতীয় নাগরিককে খুন করেছে পাকিস্তানি উগ্রপন্থীরা, একদিনের মধ্যেই জানা গেছে যে তারা নিজেদের মধ্যে পাখতুন ভাষায় কথা বলছিল। তারা জংলা পোশাক পরেছিল এবং তারা যদি খুব কাছের বারামুল্লা সেক্টর দিয়েও ঢোকে তাহলেও তাদের কম করে ১৫০ কিলোমিটার হাঁটতে হবে। তার মানে তারা লাইন অফ কন্ট্রোল পার করে দিন দুই তিন পরেই ঢুকেছিল বৈসরণ ভ্যালিতে। শ্রীনগর থেকে ট্যুরিস্টরা আগে যেত আরু ভ্যালিতে, তারপরে বেতাব ছবির শুটিং হয় খানিক দূরে, জায়গাটার নামই হয়ে যায় বেতাব ভ্যালি, মানুষ সেখানে যেতে শুরু করে, আর তারপর গত বেশ কয়েক বছর ধরেই এই বৈসরণ ভ্যালি মানুষের নজর কেড়েছে, এবং জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত প্রতিদিন সেখানে ৩-৪ হাজার মানুষ যান, এটাই গত চার বছরের গড় হিসেব। এই জায়গা থেকে নিয়ারেস্ট লাইন অফ কন্ট্রোল আগেই বলেছি বারামুল্লা, কিন্তু সেখান থেকে সোজা কোনও মোটরেবল রাস্তা নেই, অসম্ভব দুর্গম পাহাড়ি পথ দিয়ে হেঁটে আসতে হবে, যদিও সেখানে ঘটনাটা ঘটল।
এবারে আসুন দেখা যাক প্রশ্নগুলো কী কী? আর কোথায় কোথায় রহস্য লুকিয়ে আছে। ১) প্রথম প্রশ্ন হল, নাকি এক দুর্ভেদ্য তিন স্তরের সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, তো সেই তিন স্তরের সুরক্ষা ভেদ করে কী করে ঢুকে পড়ল এই পাক টেররিস্টরা? সেখানে কতগুলো এজেন্সি কাজ করছে এই সুরক্ষার জন্য? জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ, ভারতীয় সেনাবাহিনী, সেন্ট্রাল আর্মড পুলিশ ফোর্স (সিএপিএফ), সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ), বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স, ইন্দো টিবেটিয়ান বর্ডার পুলিশ এবং চার ধরনের গোয়েন্দা দফতর, মিলিটারি গোয়েন্দা, রাজ্য সরকারের গোয়েন্দা এবং অবশ্যই আরএডব্লু (র), এই প্রত্যেকটা এজেন্সিকে ঘোল খাইয়ে তিনজন পাক টেররিস্ট একে ফর্টি সেভেন হাতে চলে এল? আমাদেরকে এই আষাঢ়ে গল্প বিশ্বাস করতে হবে? এই কাশ্মীর বর্ডার সুরক্ষার জন্য ঘোষিত খরচ কত? রাষ্ট্রীয় রাইফেলস যাদের কাজ এই ধরনের সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করা, কেবল তাদের বাজেট ২০২৫ -২৬-এ ১১২৯০ কোটি টাকা। এছাড়াও অপারেশন সদভাবনা, যা নাকি কেবল জম্মু-কাশ্মীরেই ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দিয়েই চালানো হচ্ছে তার বাজেট ৪৫০ কোটি টাকা। আর আমাদের ডিফেন্স বাজেট ৬.৮১ লক্ষ কোটি টাকা, যার এক বিরাটভাগ এখানে খরচ হয়। এছাড়াও বিভিন্ন অঘোষিত ফান্ড আছে, যা সাধারণভাবে জানানোই হয় না। এই বিরাট খরচের পরে দায়বদ্ধতা থাকবে না?
২) গত চার বছর ধরে সিজনে প্রতিদিন যে ট্যুরিস্ট স্পটে গড়ে ৪০০০ লোক জমা হচ্ছেন, সেখানে বা তার ৫ কিলোমিটার রেডিয়াসে কোনও সুরক্ষা বাহিনীর সেনা ছিল না। এটা এক অবাক করার মতো ঘটনা। অমিত শাহ যাবেন, ৩০ গাড়ির কনভয় থাকবে, শ্রীনগরে পাঁচ-সাত পা দূরে দূরে মিলিটারি পাহারা থাকবে আর এত মানুষ জড়ো হচ্ছে, সেখানে দোকান আছে, হোম স্টে আছে, সেখানে কোনও পাহারা নেই। এটা ব্যর্থতা না অন্য কিছু? ৩) ঘটনা ঘটল, ঘটনাস্থল থেকে ৫০-৬০ রাউন্ড কার্ট্রিজের খোল পাওয়া গেছে, মানে ৫০-৬০ রাউন্ড গুলি চলেছে, মিলিটারি আসতে আধঘণ্টা লেগে গেল? এটা বিশ্বাস করতে হবে? ৪) এটা পরিষ্কার যে স্থানীয় সহযোগিতা ছিল, না হলে এই তিনজনের পক্ষে এত সহজে হত্যালীলা চালিয়ে পালিয়ে যাওয়াটা সম্ভব হত না। তার মানে স্থানীয় ইনপুট কিছুই নেই? গত ৩ বছরে কেবল পহেলগাঁও থেকেই সাড়ে তিনশোর বেশি যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছিল, জনা ৫০ জেলে আছে, বাকিদের কোনও খবর কি সুরক্ষা দফতরের গোয়েন্দাদের কাছে আছে? জানা যাচ্ছে এই ছেলেদের একটা গ্রুপ নাকি এই পাক উগ্রপন্থীদের শেল্টার, খাবার ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছিল। কেন সেই খবর সুরক্ষা বাহিনীর কাছে নেই? অথচ যে সমস্ত যুবকদের অ্যারেস্ট করা হয় নিয়মমাফিক তাদের উপরে লাগাতার নজরদারির কথা, তাদের মধ্য থেকেই ইনপুট পাওয়ার কথা, পেয়েছিল কি? পেয়েও কি চেপে যাওয়া হয়েছিল? কেন?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | কেন আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে? হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের পক্ষে?
৫) অমিত শাহ এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কেন গিয়েছিলেন কাশ্মীরে? কোন আলোচনা করতে? উনি সেই ভিজিটে পহেলগাঁওয়ে গিয়েছিলেন? কোনও বিশেষ ইনপুট কি ছিল? জানা নেই, কোনওদিন জানা যাবে বলে মনে হয় না। ৬) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাশ্মীরে যাওয়ার কথা ছিল ১৯ এপ্রিল, কেন উনি গেলেন না? কোন ইনপুট ছিল যার ফলে প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিল করা হল? জানি না, জানা যাবে বলে মনেও হয় না। ৭) ঘটনা ঘটে যাওয়ার চারদিন পরেও ওই তিনজন পাক উগ্রপন্থীদের ট্রেস করা গেল না, খুঁজেই পাওয়া গেল না, তাহলে কি তারা এই দেশেই অন্য কোথাও আছে? সাধারণত কাশ্মীরে যে রাস্তাতেই ঢুকুন না কেন, একটা হিসেব তো থাকেই, বের হওয়ারও থাকে, সেই তালিকা নিয়ে এখনও কেন কেউ সেই দিনেই বসেনি? হ্যাঁ, সূত্র বলছে তিন দিন আগে থেকে সেই তালিকা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। এবারে আসুন এই ঘটনার সঙ্গে কিছু রহস্য জড়িত আছে, সেগুলোর জবাব তো চাওয়া যাবে না কিন্তু উল্লেখ করা যাক। ১) এই ২৬ জন ট্যুরিস্টের মধ্যে তিনজন ছিলেন নৌ বাহিনী এবং ইন্টেলিজেন্স-এর লোক, সেই ইনপুট কি এই উগ্রপন্থীদের কাছে ছিল? তিনজনকেই কিন্তু মারা হয়েছে, এই ইনফর্মেশন থাকলে সে তো এক সাংঘাতিক ব্যাপার। ২) এনারা কি একে অন্যকে জানতেন? কোনও কোভার্ট অপারেশন চলছিল? যেটা ব্যাকফায়ার করেছে?
৩) এই কাশ্মীরে অন্তত ৫-৬টা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী সরকারের কাউন্টার ইনসারজেন্সি গ্রুপ হিসেবে কাজ করে, এটা তাদের বেহিসেবি পদক্ষেপ নয় তো? ৪) এই তিন পাক উগ্রপন্থী কি ট্যুরিস্ট হিসেবেই এসেছিল, কাজের শেষে ট্যুরিস্ট হিসেবেই ফিরে গেছে? হ্যাঁ, অনেক রহস্য আর অনেক প্রশ্নে ঘেরা আছে এই বৈসরণ হত্যাকাণ্ড। কবে তার স্পষ্ট ছবি আমরা পাব জানি না, কারণ এর আগের পুলওয়ামার ছবি এখনও আমাদের কাছে অস্পষ্ট, এখনও ধোঁয়াশায় ঢাকা। তিন, চার বা পাঁচ মিনিটের অপারেশন নয়, মিনিট কুড়ি ধরে তারা বেছে বেছে গুলি চালিয়েছে, তারা টেররিস্ট, তারা বাকি গোটা দেশকে মেসেজ পাঠাতে চায়, কাশ্মীর জন্নত নয়, কাশ্মীরে গেলে মরতে হতেই পারে, আমরা বেছে হিন্দু খুন করব, রিপাবলিক বাংলার অশিক্ষিত সাংবাদিক আছে, যারা এখানে মুসলমান খুন করার নসিহত দেবে, দারা সিং বা গিরিরাজ সিং বা অনুরাগ ঠাকুর আছে গোলি মারো শালো কো বলার জন্য বা গুলি করে মুসলমান মারার জন্য। একে অন্যের পরিপূরক, দেশ জ্বলবে, তবে তো সুবিধে হবে লুঠমারে, দেখুন না এসব বিরাট ধর্মযুদ্ধের মাঝখানেই আদানির পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে পাকিস্তানে, কেউ গুলি চালাচ্ছে? মালিক হিন্দু, কোম্পানির নাম আরবি, ফারসিতে, বিক্রি করছে গরুর মাংস, এদিকে সে আবার নাকি বিজেপি, কেউ গুলি চালাচ্ছে?
গুলি চলবে আম আদমির উপরে, কাশ্মীর জন্নত হয়ে গেছে, আ গলে লগ যা, আসুন, দেখুন আমরা উগ্রপন্থাকে হারিয়ে দিয়েছি, ২০ মিনিটে ২৭টা মানুষ শবদেহ হয়ে পড়ে আছে মাঠে। দেখলাম এক মহিলা অন্যদিকে তাকিয়েই বসে আছেন, পাশে তাঁর স্বামীর মৃত দেহ, সামনে ইয়ে হাসিন বাদিয়া, ইয়ে খুলা আসমাঁ। অথচ এক আহাম্মক সেই কবেই নোটবন্দি করার পরে জানিয়েছিল টেররিজম কো খতম করনে কে লিয়ে এক বড়া আউর আখরি কদম। নির্ভেজাল সেই মিথ্যের পরে বারবার রক্তাক্ত হয়েছে কাশ্মীর, পুলওয়ামার ঘটনা তো সব্বার নিশ্চয়ই মনে আছে। সেদিন ৪০ জন জওয়ান মারা গিয়েছিল, আজ অবধি কেউ জানতে পেরেছে কারা কীভাবে ঢুকে সেদিন ওই আক্রমণ চালিয়েছিল? কাদের ব্যর্থতায় সেদিন এই দুর্ঘটনা ঘটাতে পেরেছিল টেররিস্টরা কেউ আজও জানে না। সেই সময়ের রাজ্যপাল মুখ খুলেছিলেন, জেনেছিলাম এই ঘটনা তাঁকে চেপে যেতে বলেছিলেন আমাদের চৌকিদার মোদিজি। আমরা অর্ণবের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ থেকে জেনেছিলাম যে এই ঘটনা ঘটার পরে বহু লোক আশ্বস্ত হয়েছিলেন এই ভেবে যে তাহলে এই সরকার বিরাট গরিষ্ঠতা পাবেই।
কিন্তু আমরা জানতে পারিনি যে তারপরে যে সার্জিকাল অ্যাটাক ইত্যাদির বাওয়াল দেওয়া হয়েছিল, তার ফল কী হয়েছিল। আজ নয় সেই কবেই ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজর অজিত দোভাল বলেছিলেন, আর একটা মুম্বই হলে বালোচিস্তান হারাবে পাকিস্তান, কিন্তু সেগুলো তো জুমলাই ছিল। মনে নেই? কাদের সময়ে কাশ্মীরি ব্রাহ্মণদের পলায়ন শুরু? সেই সময়ে সরকার ভিপি সিংয়ের, সবচেয়ে বড় সমর্থন তো ছিল এই বিজেপির, সেসব কি আমরা ভুলে গেছি? এরপরে তুলে নেওয়া হল ৩৭০ ধারা, বলা হল উগ্রপন্থাকে কবরে পাঠানো হয়েছে, আজ সেই উগ্রপন্থার বলি ২৭ জন ভারতীয় আর এই আক্রমণের পরে কাশ্মীরে আপাতত পর্যটন বন্ধ হয়ে যাবে, এবারে না খেতে পেয়ে সেখানকার মানুষ মরবে। আর দেশের অন্যপ্রান্তে রিপাবলিক টিভির অশিক্ষিত উন্মাদ, বিজেপির কিছু বিষাক্ত নেতা বিষ ছড়াবে, যাঁরা ক’দিন আগেই বলছিলেন বাংলায় হিন্দু খতরে মে হ্যায়, হিন্দুদের মারা হচ্ছে, হিন্দুদের ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, মমতা ব্যানার্জি পদত্যাগ করুন, সেই অশিক্ষিত জানোয়ার আর উন্মাদের দল আজ এই ঘটনার জন্য লিবারাল, সেকুলারদের দায়ী করছেন। কিন্তু কেউ এই প্রশ্নের জবাব দেবেন না, আবার একটা হত্যাকাণ্ড হবে আবার হুমকি আর মিটিয়ে দেব মিশিয়ে দেব বাওয়াল, এই চলতে থাকবে?