ট্রাম্প সাহেব ভেবেছিলেন চীনের বড্ড বাড় বেড়েছে, ওরা সতর্ক হবার আগেই ওদেরকে চিৎপাত করে ফেলতে হবে। আর বাজারে চীন না থাকলে তো ফাঁকা মাঠে গোল করা যাবে। আছেন তো ভারতের ৫৬ ইঞ্চির মোদিজি, বলার আগেই আমেরিকান বারবান হুইস্কির শুল্ক কমিয়েছেন। এই ট্যারিফ যুদ্ধ বা বাণিজ্য যুদ্ধের আসল লক্ষ্য ছিল ওই চীন। কেন? কারণ তারা বছর পনেরোর মধ্যে হয়ে উঠেছে বিশ্বের ম্যানুফাকচারিং হাব, যা দেখছেন চোখে, যা কিছু, ইলেকট্রনিক্স গুডস থেকে গিফট আইটেম, সব তৈরি হচ্ছে ওই চীনে। কতটা বিস্তৃত? আমার এক বন্ধু গিয়েছিলেন ইজিপ্টে, তো সেখানে গেলেই সব্বাই যাবেন পিরামিড দেখতে আর সেখানেই বাজারে বিক্রি হচ্ছে ছোট ছোট সুভ্যেনির, পিরামিড, মমি, স্ফিংস ইত্যাদির পুঁচকে রেপ্লিকা। তো বন্ধুবান্ধবদের জন্য খান ১৫ সেটাই কিনে ফেললেন। দেশে ফিরে দেওয়ার সময়ে বুঝতে পারলেন সে সবই চীনে তৈরি, মেড ইন চায়না। পিছনে স্টিকারে লেখাই আছে। আমাকেও সেরকম একটা দিয়েছিলেন আর তারপরে খবর নিয়ে জানলাম আইফেল টাওয়ারের নীচে বা বাকিংহ্যাম প্যালেসের সামনে বা বার্লিন রাইখস্ট্যাগ বিল্ডিং বা রোমের কলোসিয়ামের সামনে যে স্যুভেনিরগুলো বিক্রি হয়, সবই চীনেই তৈরি। তাঁরা বিক্রি করছেন হাফ ডলারে, ওঁরা আমাদের ওদের দেশের স্যুভেনির বিক্রি করছেন ৫ ডলারে। হ্যাঁ বিশ্বজোড়া স্যুভেনির মেমেন্টোর ব্যবসার দখল নিয়েছে চীন, আজ নয়, বছর ২০ আগে থেকে। তারপর আমাদের দেশের বাজারে সস্তার যত মোবাইল, চার্জার থেকে খেলনা থেকে নানান গ্যাজেট ওই চীন থেকেই আসছে। এবং তারা দখল নিয়েছে বাল্ব বা আলোর বাজারের, ফার্নিচারের। কলকাতার রাস্তার ধারে সারি সারি আলোর দোকান, নানান ধরনের আলো, বা ফার্নিচারের সিংহভাগ ওই চীনেই তৈরি, সেটা কি কেবল ভারতে? তৃতীয় বিশ্বে? না সর্বত্র। এমনকী ফ্রান্সে গ্যোতিয়ের ফার্নিচার মার খাচ্ছে চীনের প্রাইসিং স্ট্রাটেজির কাছে, তাদের দাম কোথাও অর্ধেক, কোথাও তারও কম। তো এসব আমরা কম বেশি জানতাম।
আজ চীনের দুটো বাণিজ্য পদ্ধতি বা ট্রেড স্ট্রাটেজি নিয়ে কথা বলব। আমেরিকা ভাবছিল চীন তাদের দেশের রফতানির উপর নির্ভরশীল, কারণ চীনের ডোমেস্টিক কনজাম্পশন তেমন বাড়েনি, মানে দেশের ভেতরের চাহিদা তেমন বাড়েনি, কাজেই তাকে তৈরি হওয়া মাল আমেরিকাকে বিক্রি করতে হয়, কাজেই সেই রফতানির উপরে শুল্ক বা ট্যারিফ চাপালেই চীন বাপ বাপ করে পায়ে পড়বে। কিন্তু আমরা দেখলাম চীন পাত্তাও দিল না। কারণ চীন তার স্ট্রাটেজি বহু আগেই ঠিক করেছে। সেই কবে ২০১৩ সালে শি জিনপিং চালু করেছিলেন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, এই BRI হল চীনের একটা বিশাল উদ্যোগ, যা দিয়ে তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য, পরিকাঠামো, আর অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে চায়। খেয়াল করে দেখুন সেই ২০১৩ সালেই তারা জানিয়েছিল এর মূল লক্ষ্য হল এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আর এমনকী লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে সড়ক, রেল, বন্দর, আর অন্যান্য পরিকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে একটা বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করা। এটা পুরনো ‘সিল্ক রোড’ বাণিজ্য পথের আধুনিক সংস্করণও বলা যায়। ধরুন নেপালে এয়ারপোর্ট, ওধারে উত্তরে তিব্বত থেকে পাকিস্তান রাস্তা। নেপাল বা ভুটান এগুলো ল্যান্ড লকড কান্ট্রি, পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা সমুদ্রপথে করতে হলে বিরাট ঘুরপথ, এবারে চীন রাস্তা তৈরি করছে, সেই রাস্তা শেষ হওয়ার মুখে। সামরিকভাবে, বাণিজ্যিকভাবে চীন কোথায় চলে গেছে। পাকিস্তান যাওয়া মানেই আফগানিস্তান হয়ে ইউরোপে ঢুকে পড়া, সেই রাস্তার দু’ ধারে চীনের সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | অধীরের চুলকুনি আর সিপিএমের ব্রিগেড জমায়েত
এই বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের দুটো পার্ট আছে। ১) সিল্ক রোড ইকনমিক বেল্ট: এটা মূলত স্থলপথের নেটওয়ার্ক। চীন থেকে মধ্য এশিয়া, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত রেল, সড়ক, আর অন্যান্য পরিকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। একসময়ে চীনের বাণিজ্য বা সেই সিল্ক রুটকে আবার তারা জাগিয়ে তুলছে। ২) একুশ শতাব্দীর মেরিটাইম সিল্ক রোড: এটা সমুদ্রপথের নেটওয়ার্ক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকার পূর্ব উপকূল, আর ইউরোপ পর্যন্ত বন্দর আর শিপিং রুট তৈরি বা উন্নত করা হচ্ছে। তারা শ্রীলঙ্কাতে করেই ফেলেছে, পাকিস্তানে কাজ চলছে আর বাংলাদেশ এর সঙ্গে কথা শুরু হয়েছে। হ্যাঁ, ২০১৩ থেকেই তারা এই কাজে হাত দিয়েছে, তাদের বাণিজ্য যেন কোনওভাবেই মার্কিন নির্ভর না হয়ে ওঠে তা নিয়ে তারা ভাবতে শুরু করেছিলেন ২০১২ থেকে, তখন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির মাথায় হু জিনতাও, ১৮তম পার্টি কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় চীনের পুরনো বাণিজ্য পথকে বাঁচিয়ে তুলতে হবে। কীভাবে এই প্রজেক্ট কাজ করে? চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাস্তা, রেল, বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, আর টেলিকম নেটওয়ার্কের মতো বড় বড় প্রকল্পে টাকা দেয় বা ঋণ দেয়। আর এই প্রকল্পগুলোতে চীনের কোম্পানিগুলো কাজ করে, আর বেশিরভাগ সময়ই চীনের শ্রমিকরাও জড়িত থাকে। ফলে এই দেশগুলোর পরিকাঠামোর উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চীনের বাণিজ্য বাড়ে, তাদের দেশের লোকজনেদের রোজগার বাড়ে।
প্রথমে দেখা যাক চীনের জন্য কেন এটা গুরুত্বপূর্ণ? ১) চীনের পণ্য রফতানির জন্য নতুন বাজার তৈরি হয়। ২) চীনের কোম্পানিগুলো বিদেশে ব্যবসা বাড়াতে পারে। ৩) জ্বালানি আর কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। ৪) বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের প্রভাব বাড়ে। এবার আসুন দেখে নিই অন্য দেশের জন্যও কেন এই প্রজেক্ট লাভজনক হয়ে উঠছে? ১) উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য রাস্তা, বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো পরিকাঠামো তৈরি হয়, যা তাদের অর্থনীতির জন্য ভালো। ২) তাদেরও বাণিজ্য আর বিনিয়োগ বাড়ে। এরমধ্যেই তারা কোথায় কোথায় এই কাজ শুরু করে দিয়েছে? পাকিস্তান: চীন-পাকিস্তান ইকনমিক করিডর (CPEC) BRI-এর একটা বড় অংশ। এর মাধ্যমে গদর বন্দর, রাস্তা, আর বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। এই প্রকল্পের মধ্যেই নেপালে এয়ারপোর্ট হয়ে গেছে, নেপাল আর কিছুদিনের মধ্যে সড়কপথেই চীনের মাল আনাতে পারবে, কলকাতা বন্দরের দরকার হবে না। আফ্রিকা: কেনিয়ার মোম্বাসা-নাইরোবি রেলওয়ে BRI-এর টাকায় তৈরি হয়েছে। ইউরোপ: চীন গ্রিসের পিরেয়াস বন্দরে বিনিয়োগ করেছে, যা ইউরোপে তাদের বাণিজ্যের প্রবেশপথ। শ্রীলঙ্কার কথা তো আগেই বলেছি। মানে যে কথা আগেই বলছিলাম, তাঁরা জানতেন যে একটা সময়ে এসে আমেরিকা এ ধরনের আর্ম টুইস্টিং, হাত মুচড়ে কাজ করানোর চেষ্টা করবে, তাদের বাধ্য হয়ে নতজানু হতে হবে আমেরিকার কাছে। তারা বহু আগে থেকেই তাই অন্য বাজারের দখল নেওয়া শুরু করেছে। এটা হল প্রথম স্ট্রাটেজি, আর পরেরটা আরও মারাত্মক।
আগেই বলেছি চীন তাদের দেশটাকে এক বিরাট ম্যানুফাকচারিং হাব তৈরি করেছে সেই কোন কাল থেকে। তার ইউনিক সেলিং পয়েন্ট ছিল চিপ লেবার, ভাই তোমরা আমাদের দেশে আসো, আমাদের কারখানাগুলো দেখো, আর কোন কোন মেশিন লাগবে জানাও, আমাদের এখানে খুব সস্তায় তোমাদের মাল তৈরি করে দিচ্ছি, তোমরা নিয়ে গিয়ে ব্যবসা করো। সব দেশ লাফিয়ে পড়েছে। সেখানে কমপিউটার তৈরি হচ্ছে, ল্যাপটপ তৈরি হচ্ছে, তারপর তার উপরে কেবল লোগোটা ছাপিয়ে ব্যবসা করছে, কেবল ইলেক্ট্রনিকস গুডস নয়, এমনকী পৃথিবী বিখ্যাত বিরাট বিরাট ব্রান্ডের বিলাস দ্রব্য, লাক্সারি গুডস, চামড়ার ব্যাগ, ঘড়ি, জিনস থেকে শুরু করে পারফিউম, নেল পালিশ, লিপস্টিক পর্যন্ত তৈরি হচ্ছিল চীনে, আর বিক্রি হচ্ছিল ইউরোপে। কতটা দামের তফাতে? আমরা আন্দাজ করতাম কিন্তু জানতাম না। আর একটা বিষয়ও ছিল, চীন সস্তার জিনিস বিক্রি করে, তাদের লাক্সারি গুডস নেই, এটাই ছিল পারসেপশন, সাধারোণ মানুষের ধারণা। আজ ট্রাম্প সাহেবের জন্য সেটাও আমাদের সামনে এসে হাজির, টিকটক থেকে পয়েবসাইটে চীনের ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন গুচি, স্যানেল, লুই ভিতঁ থেকে শুরু করে দুনিয়াজোড়া লাক্সারি ব্র্যান্ডের যা কিছু তার ৯০ শতাংশ তৈরি হত চীনে, আর তার দাম কোথাও ১০/১৫/২০/৩০ গুণ বেশি করে বিক্রি হত ইউরোপ আমেরিকার বাজারে। মানে একটা গুচির অত্যন্ত সাধারণ ব্যাগ ইউরোপে বিক্রি হচ্ছে ৬০০০ ডলারে, যা চীন তাদেরকে বিক্রি করেছে ১০০ ডলারে। এবারে চীন বলছে কেন দুবাই যাবেন? বেজিং আসুন, কিনে নিয়ে যান। এবং কিছুদিনের মধ্যেই এক চিচিং ফাঁক দেখতে পাব আমরা, ট্রাম্প সাহেব দেখবেন, চোখের সামনে চীনের বাণিজ্য বাড়ছে। হ্যাঁ, তারা বাওয়াল দেয়নি, বিশ্বগুরু ২০টা দেশের নেতা, ফাদার অফ ডেমোক্রেসি ইত্যাদি বলেনি, কিন্তু নিজের দেশের স্বার্থে কাজ চালিয়ে গেছে। ফলাফল আজ আমাদের সামনে।
রপ্তানির বৃদ্ধি: বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তা থাকলেও ২০২৪-এর প্রথম ছয় মাসে চীনের রফতানি ৬.৯ শতাংশ বেড়ে ১২.১৩ ট্রিলিয়ন ইউয়ান মানে ১.৬৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে।
আসিয়ান আর লাতিন আমেরিকা বড় বাজার: ২০২৪-এর প্রথমার্ধে আসিয়ানের সঙ্গে বাণিজ্য ৭.১ শতাংশ আর লাতিন আমেরিকার সঙ্গে ৭.৪ শতাংশ বেড়েছে।
প্রথাগত অংশীদারদের সঙ্গে কম বাণিজ্য: ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্য ৩.৭ শতাংশ আর আমেরিকার সঙ্গে ০.২ শতাংশ কমেছে।
হাই-টেক রফতানির উত্থান: ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট আর গাড়ির মতো হাই-টেক সেক্টরের দারুণ পারফরম্যান্সে রফতানি বেড়েছে।
ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে আধিপত্য: ইকনমিক সার্ভে ২০২৪-২৫ অনুযায়ী, চীনের ম্যানুফ্যাকচারিং আউটপুট বিশ্বের প্রায় ৪৫ শতাংশ।
‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ উদ্যোগ: এই উদ্যোগে নেক্সট-জেনারেশন আইটি, হাই-এন্ড রোবটিক্স, আর নতুন এনার্জি গাড়ির মতো ১০টা সেক্টরের উপরে জোর দেওয়া হয়েছে।
বাণিজ্য চুক্তির বিস্তৃত নেটওয়ার্ক: চীন ২৯টা দেশ আর আঞ্চলিক ব্লকের সঙ্গে ২২টা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট সই করেছে। আরও ১০টা এফটিএ নিয়ে আলোচনা আর ৮টা বিবেচনার মধ্যে আছে। এছাড়া ১০৭টা বাইল্যাটারাল ইনভেস্টমেন্ট ট্রিটি, দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি হয়ে গেছে।
রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কিং সিস্টেম: চীনের ব্যাঙ্কগুলো বেশিরভাগ রাষ্ট্রীয় বা রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত, যা ঋণ বণ্টন আর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগগুলোকে বিরাট সমর্থন দিচ্ছে।
জ্বালানি বাণিজ্যের পরিবর্তন: রাশিয়া চীন আর ভারতের মতো নতুন বাজারে তেল বিক্রি করছে, প্রায়ই কম দামে, যা বিশ্ব জ্বালানি বাণিজ্যের পথ বদলাচ্ছে।
রফতানি বৃদ্ধিতে নতুন পণ্যের ভূমিকা: ১৯৯৭ থেকে ২০০৫-এর মধ্যে চীনের রফতানি বৃদ্ধির বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নতুন পণ্য ২৬ শতাংশ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
সব মিলিয়ে দাঁড়াল কী? ট্রাম্প সাহেবের ঘরে লোকজনেরা বলছে, এবারে মুখ পুড়িয়ে ট্রাম্প সাহেবকেই একটা সমঝোতার রাস্তা বার করতে হবে, না হলে চীন আরও আগ্রেসিভ হয়েই বাজারের দখল নিতে নেমে পড়বে, ট্রাম্প সাহেব জানেন চীন এখন নিঃসঙ্গ নয়।
হ্যাঁ, চীন লড়ছে আমেরিকার সঙ্গে, আমরা ভাবছিলাম চীন ভারত নিয়ে নাকি চিন্তিত।