শুভ পয়লা বৈশাখ। বাংলার বারো মাসে তেরো পার্বণের সবথেকে আনন্দের দিন, সব্বার আনন্দের দিন পয়লা বৈশাখের সকাল এইভাবেই শুরু হয়। আমরা বলি শুভ পয়লা বৈশাখ, সূর্য ইতিমধ্যেই গনগনে হয়ে উঠছে, হব হব করছে। দু’ একটা কালবৈশাখীতে আম ঝরেছিল কিছু, তারপরেও আম রয়েছে গাছে, এঁচোড় এবার কাঁঠাল হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, পুকুরে মাছ তোলা হবে, হচ্ছে, কারণ জৈষ্ঠ্যে আবার নতুন পোনা ছাড়া হবে। এখনও ডাকছে কোকিল, এখনও আবেশে ফুটছে পলাশ, ডাকছে কোকিল, বিছানায় সে ফিরবে পাশ, আর সেই আবহে পয়লা বৈশাখ চলে আসে, বাড়িতে সত্যনারায়ণ আর দরগায় পিরের সিন্নিতে, একই কাঁঠালি কলা, আটা, মাখা সন্দেশ আর বাতাশা, কুঁচো ফল। নতুন ধুতি গেঞ্জি, লাল পেড়ে শাড়ি, এসো হে বৈশাখ এসো, এসো। সেই আবহে কোথাও কি ছিল ধর্ম? থাকলেও কোথাও কি ছিল বিভেদের সুর? ছিল না, আজ আছে। শাহ আবদুল করিমের গলায় ছিল সেই আশঙ্কা, তিনি লিখছেন,
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান,
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান,
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম,
হায় রে, মিলিয়া বাউলা গান আর সারি গান গাইতাম
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম,
আমরা, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
হিন্দুগো বাড়িতে, যাত্রা গান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম,
বাউলা গান, ঘাটু গান আনন্দের তুফান
গাইয়া সারি গান নৌকা দৌড়াইতাম,
হায় রে, গাইয়া সারি গান নৌকা দৌড়াইতাম
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম,
আমরা, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
বর্ষা যখন হইত, গাজির গান আইত
রংগে ঢংগে গাইত, আনন্দ পাইতাম,
কেহ বা মেম্বার, কেহ বা মিনিস্টার,
কেহ বা মেম্বার, কেহ বা মিনিস্টার,
আমরা কি এসবের নাম জানিতাম?
হায় রে, আমরা কি এসবের নাম জানিতাম,
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম,
আমরা, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
সেই সুর কোথায় হারাল? কখন হারাল? কেমন করে হারাল? কারা আমাদের প্রত্যেকের অলক্ষে সেই সুর চুরি করে নিয়ে গেল? এ পাড়া, ওপাড়া, বামুন পাড়া, গয়লাদের পাড়া, মুসলমান পাড়া তো তখনও ছিল, কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় এমন বিভেদ তো আগে ছিল না, সে পাড়ায় পাড়ায়, অবাধ যাতায়াতে বাধা তো ছিল না। লাল, নীল, সবুজ ম্যারাপ বাঁধা মঞ্চে কৃষ্ণপ্রেমে বিরহিনী রাধা কাঁদছে, সুলেমান মিয়ার বউও কাঁদছে, ঘোষেদের বাড়ির ছোট বউও কাঁদছে, আমরা দেখেছি তো। দেখেছিই তো আসার আর আবদুল মিয়া জাল টেনে তুলেছে ৫ কেজির পাকা কাতলা, সেদিন পংক্তিভোজ, সবাই খাবে, সারি দিয়ে বসে, রান্না করবে ৬৮ বছরের উৎকলবাসী বামুন সহদেব। এসব ছবি হঠাৎ উবে গিয়ে আজ ওরা আর আমরায় টুকরো সমাজে শুভ পয়লা বৈশাখ তো আসে, কিন্তু মনে প্রশ্ন তো আসে, কতটা শুভ? কার জন্য শুভ? ধর্মের বিভেদ ছিল না? ছিল। কিন্তু তা এমন সর্বব্যাপী ছিল না। সারাটা সকাল মাঠে কাজ করার পর তাহেরুদ্দিন, জসিমুদ্দিনদের খাবার বেড়ে দিত আমার দিদান, নিজের হাতে, এটা খা, আরও একটু ভাত নে, মোছলমানের রক্ত, আর একটু মাংস না খেলে চলবে? তাদের কি যত্ন করে খাওয়াত। আজ ফতোয়া জারি হচ্ছে, নিজে তো খাবই না, অন্য কেউ যেন না খায়। দাদুনকে দেখেছি ইয়া চেহারা নিয়ে লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে বৈঠকখানার ঘরে গিয়ে বসতেন, আজ প্রধানমন্ত্রী লুঙ্গি দেখে ধর্ম বিচার করছেন। আগেও ফারাক ছিল, মনান্তর ছিল, আকচা আকচিও ছিল, কখনও সখনও দাঙ্গাও হয়েছে, কিন্তু নিত্য জীবনে এমন বিভেদের বেড়া তো ছিল না।
অনায়াসে রামকৃষ্ণদেব চলে গেছেন এক মোল্লার কাছে, ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন, তারপর বলেছেন, যত মত, তত পথ, আজ সেই পথে এত রক্ত কেন? এত ঘৃণা কেন? আমরা তো বসেই থাকতাম নচপি কাকু সেমাই খাওয়াবে বলে, তিনি ইদ মুবারক বলতেন, আমরা তো বুঝিইনি, কিন্তু সারাদিন বলে বেড়িয়েছি ইদ মুবারক। পুজোর মন্ত্রোচ্চারণে ওম ফট স্বাহা বলতেন ঠাকুরমশাই, আমরাও খেলতে খেলতে বলতাম ওম ফট স্বাহা, ওম বা স্বাহার থেকেও ওই ফট শব্দে আমাদের আকর্ষণ বেশি ছিল। নচপি কাকুর ছেলেও বলত ওম স্বাহা, কোথাও কেউ বারণ করেনি। আজ মহরম আর বিজয়ার মিছিলে পুলিশি পাহারার বন্দোবস্ত করতে হয়। আমরা ইদ মুবারক বলতে ভুলে গেছি, ওরাও কেউ শুভ বিজয়া বলে না। অথচ একই বাজারে আগুনচড়া দামে সবজি কিনছি আমরা, একই বাসে চেপে অফিস যাচ্ছি, একই পেট্রল পাম্পে তেল ভরছি, যে তেলের দাম রোজ বাড়ছে। আমাদের মধ্যে অবিশ্বাস রোজ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে, ফারাক বেড়েই চলেছে। দু’পক্ষেরই কিছু লোকের কুমন্ত্রণায় যা কিছু শুভ, তা অশুভ হয়ে উঠছে প্রতিদিন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | এই মোদি যোগী শাহের দল আসলে হিন্দুই নন
চলুন একটু ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাই, প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ, সিপাহি বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সাল। প্রথম শহীদ, মঙ্গল পান্ডে, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, কাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন? ইংরেজদের। সিপাহিদের নেতৃত্বে কাকে সামনে রেখে লড়াই হচ্ছে? বাহাদুর শাহ জাফর। সেদিন ইংরেজরা বেছে বেছে হিন্দু মেরেছিল? বেছে বেছে মুসলমান মেরেছিল? কাঠের পোস্টে, গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিয়েছিল বিদ্রোহীদের, এ ডালে মুসলমান, ও ডালে হিন্দু। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই লড়ছেন, নানা ফড়নবিশ লড়ছেন, কুঁয়র সিং লড়ছেন, তাঁতিয়া টোপি লড়ছেন, বেগম হজরত মহল লড়ছেন, মৌলভি আহমাদুল্লা শাহ লড়ছেন, ইংরেজ নয়, এনারা চাইছেন বাহাদুর শাহকে দিল্লির সিংহাসনে বসাতে। হাজারে হাজারে মুসলমান সৈনিক, মারাঠা হিন্দু সৈনিক, ক্ষত্রিয়, হিন্দু ব্রাহ্মণ সেদিন ওই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিল। ইংরেজরা সেদিন কোনওরকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, কোনওরকমে সেই বিদ্রোহ দমন করেছিল, কিন্তু এটাও বুঝেছিল যে হিন্দু মুসলমানের মিলিত শক্তি যে কোনওদিন আবার ডেকে আনবে নতুন বিদ্রোহ। সেই আশঙ্কা দূর করতেই ইংরেজদের নতুন মন্ত্র হল ডিভাইড অ্যান্ড রুল, ভাগ করো এবং শাসন করো। সর্বত্র, সর্বত্র তারা এই নিয়ম চালু করল, সঙ্গে পেয়ে গেল কিছু ক্ষমতালোভী মোল্লা আর হিন্দু উচ্চবর্ণের মানুষজনকে। সেই সময় থেকে এক বিষবৃক্ষ রোপণ করা হল গোটা দেশে, এই বাংলাতে আরও বেশি করে, কারণ এখান থেকেই জন্ম নিয়েছিল বিদ্রোহের প্রথম স্ফুলিংগ। বিভিন্ন পরিকল্পনার মধ্যে ছিল বাংলা ভাগের চক্রান্ত। রুখে দাঁড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলার অগণিত মানুষ, রাস্তায় নেমে রবীন্দ্রনাথ রাখিবন্ধনের ডাক দিলেন মানুষকে। লর্ড কার্জনের চক্রান্তের বিরুদ্ধে ১৬ অক্টোবর অরন্ধন দিবসের ডাক দেন রবীন্দ্রনাথ, মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, মেয়েরা শাঁখ বাজাচ্ছেন, ফুল ছড়ানো হচ্ছে, পায়ে হেঁটে রবীন্দ্রনাথও গেলেন জগন্নাথ ঘাট, সঙ্গে দিনু ঠাকুর, অবন ঠাকুর, গঙ্গায় চান করে একে অন্যকে রাখি পরানো হল, গান গাইছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল—
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান॥
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ—
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান॥
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা—
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান॥
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন—
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান॥
বিরু মল্লিকের বাড়ির আস্তাবলের মুসলমান সহিসদের হাতে রাখি পরালেন রবীন্দ্রনাথ নিজে, তারপর চললেন চিৎপুরের বড় মসজিদে, সেখানেও রাখিবন্ধন হল। কেউ সেদিন রবীন্দ্রনাথকে মুসলিম তোষণের দায়ে অভিযুক্ত করেননি। ১৯০৫-এর এই ঘোষণার ৬ বছর পরে ১৯১১তে বঙ্গভঙ্গ বাতিল করা হল। সেদিন আবার উৎসবে মেতেছিল বাংলার মানুষ, হিন্দু-মুসলমান। ইংরেজরা সেই পরিকল্পনা আপাতত বন্ধ রেখেছিল, কিন্তু ডিভাইড অ্যান্ড রুল চালিয়ে গিয়েছিল শেষদিন পর্যন্ত। এরপর জিন্না এবং সাভারকর, এ বাংলায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে পেয়েছিল তারা, স্বাধীনতার আগে সেই বাংলাকে দু’ টুকরো করার এতদিনের পরিকল্পনা সফল হয়েছিল এইসব বিশ্বাসঘাতকদের সাহায্যে। কিন্তু তারপরেও বাংলার কবি, সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা বরাবর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন এই সম্প্রীতি বজায় রাখার, সুতো গিয়েছিল ছিঁড়ে, তবুও চেষ্টা বজায় ছিল। আবার সেই একই পরিকল্পনা নিয়ে হাজির আরএসএস-বিজেপি, আবার বাংলা ভাগের কথাও তাঁরা বলেই চলেছেন, ওই একই রাজনৈতিক সুবিধের জন্য। বিভেদের কুমন্ত্রণা ছড়িয়ে দিচ্ছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, তার বিষাক্ত প্রভাব চতুর্দিকে। আমাদের শান্তির নীড় ভেঙে চুরমার করে এক দানবীয় মধ্যযুগীয় সময়কে ফিরিয়ে আনতে চায় তারা। সেই পরিকল্পনাকে রুখতে হবে। আজ পয়লা বৈশাখ শুভ হয়ে উঠবে তখন যখন আপনি অন্তত একজনের মন থেকে, তার মগজ থেকে এই বিভেদের বিষ নামাতে পারবেন, যদি না পারেন তাহলে এই পয়লা বৈশাখ কেবল কথায় শুভ হয়ে থাকবে, ভাইয়ে ভাইয়ে বিভেদ কোনওদিন কোনও সমাজে শুভ হয়ে উঠতে পারে না, এ বাংলা, এ দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। আসুন আমরা সত্যি করেই এমন এক সমাজ, এক দেশ, এক বাংলা গড়ে তুলি, যেখানে আবার ফিরে আসবে সেই সম্প্রীতি, ভালবাসা আর সখ্য। শুভ পয়লা বৈশাখ।