কলকাতা: পুতুলনাচ নববর্ষের আনন্দ ও উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।নববর্ষের পুতুলনাচ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে একটি ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ। এই ধরনের পুতুলনাচ সাধারণত বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রচলিত, যেখানে পুতুলগুলি মানুষের বা প্রাণীর মতো করে তৈরি করা হয় এবং একজন মানুষ দ্বারা পরিচালিত হয়।এই পুতুলনাচ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন স্টিক পুতুল, সুতো দিয়ে চালিত পুতুল, বা অন্য কোনো ধরনের পুতুল, যা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। নববর্ষের পুতুলনাচ সাধারণত আনন্দ ও উৎসবের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।নববর্ষের পুতুলনাচ একটি সুন্দর ও ঐতিহ্যবাহী কার্যকলাপ যা নববর্ষের আনন্দ ও উৎসবকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় সমস্ত চরিত্রগুলোকে পুতুলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। যারা নিজেদের ইচ্ছেতে চলতে পারেন না। পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাদেরকে পরিচালিত করে। অর্থাৎ কারোর না কারোর হাতের পুতুল। এই উপন্যাসে পুতুল নাচের রূপকে তুলে ধরা হয়েছে বাংলার গ্রামীণ জীবনে। শৈশবের অন্যতম প্রধান সঙ্গী ছিল পুতুল। বাংলার প্রাচীন লোকসংস্কৃতি হিসেবে পুতুল নাচের মহান ঐতিহ্য সবসময় স্মরণীয়।
বর্তমান সময় আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজ বাংলা হারাতে বসেছে প্রাচীন পুতুলনাচের সংস্কৃতিকে। একটা সময় এই পুতুল নাচ ছিল বিনোদনের মূল উৎস, কিন্তু ভিডিও গেম, টেলিভিশন এবং স্মার্টফোন সহ নানান যান্ত্রিক সহযোগিতা আসায় তৈরি হয়েছে বিনোদনের একাধিক পথ। তবে এখনো গ্রাম বাংলায় গেলে দেখা মেলে এই পুতুল নাচের ঐতিহ্যকে কিন্তু আগের তুলনায় বর্তমান সময়ে তার চল এখন প্রায় লুপ্তের দিকে।
শিল্পীদের মতে এই পুতুল নাচের চল এখন সবচেয়ে বেশি কৃষ্ণনগর, নবদ্বীপ এবং মেদিনীপুর জেলাগুলিতে দেখতে পাওয়া যায়। এর পাশাপাশি শিল্পীরা শহরের মেলা থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সরকারি অনুষ্ঠানে এই পুতুল নাচ দেখিয়ে থাকেন। একবারে বলা যেতে পারে শিল্পীদের এটাই একমাত্র রুজি-রুটির রাস্তা।
পুতুল নাচের মাধ্যমে শিল্পীরা শিশুদের বিনোদনের জন্য রূপকথার গল্প থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য রামায়ণ এবং মহাভারতের মতো নানান পৌরাণিক কাহিনী পরিবেশন করে থাকেন।
তবে এই পুতুলের প্রাণ না থাকলেও এর মাধ্যমেই নানান কাহিনী তুলে ধরা যায়। যা মানুষকে অজানা দেশ- বিদেশ, কাহিনী সম্পর্কে জ্ঞান দিয়ে থাকে। সুতরাং এটি সারা বিশ্বের সংস্কৃতির একটি জায়গা করে নিয়েছে। এই পুতুল যেমন শৈশবের স্মৃতিচারণ করায়, তেমনই নানান দৃশ্যও তুলে ধরে। তাই এর তাৎপর্য অনেক।পড়াশুনায় মনোযোগ বাড়াতে হাতিয়ার পুতুল নাচ।
পুতুল খেলার ঘর কিংবা পুতুলের বিয়ে দেওয়ার নজিরও রয়েছে। সেই সময় পুতুলকে পরানো হতো রং-বেরঙের জামা কাপড়, পুঁতির হার, ইমিটেশনের অলঙ্কার। তারই সূত্র ধরে বাংলায় জাঁকিয়ে বসেছিল পুতুল নাচ। নিছক বিনোদন ছাড়াও পুতুল নাচের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক বিষয়, পালাগান, পৌরাণিক গল্প উপস্থাপন করা হতো। যা সহজেই মানুষের মনকে ছুঁয়ে যেত। কিন্তু মোবাইল ফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে পুতুল নাচের জনপ্রিয়তায় এখন ভাটা পড়েছে।
তবে ,পুতুল নাচের এই পুতুল তৈরির পদ্ধতি কি? নিশ্চয়ই আপনাদের মনে এই প্রশ্ন ঘুরছে, তবে আসুন তা জেনে নিই, কি ভাবে এই হাতের পুতুল তৈরি হয়।
আগেকার সময় নদীতে ভেসে আসা অথবা মাঠে পড়ে থাকা সোলার বাক্স গুলি সংগ্রহ করে শিল্পীরা সেই বাক্সগুলিকে কাজে লাগিয়ে এক মাপের চার কোণকে বাদ দিয়ে সোলার ছাল ছাড়িয়ে সাদা অংশটিতে আঠার লেপ লাগিয়ে প্রায় দুইদিন রোদে শুকোতে দেয়, এরপর ওই সাদা অংশটি কাটপাটি করে একটি মানুষের আকৃতি সৃষ্টি করে পুতুল নির্মাণ করা হতো।
কিন্তু, বর্তমান সময় সোলার বাক্সের পরিমাণ কমে আশায় পুতুল তৈরির শিল্পীরা বাক্সের বদলে থার্মোকলের দ্বারা পুতুল নির্মাণ করেন, তবে শিল্পীদের মতে আগেকার তৈরি পুতুলগুলির মত এখনকার থার্মোকলের পুতুল টেকসই নয়। বড়জোর সেই পুতুলগুলির আয়ু দু’বছর। শিল্পীদের তৈরি একটি হাতের পুতুল হলেও তাদের কাছে এটি একটি বড় আবেগ।
আগেকার সময় মুভি থিয়েটার বা কোন ওটিটি প্লাটফর্ম ছিল না। কিন্তু আগেকার দিনে কি বিনোদন হতো না? না অবশ্যই হতো! তখনকার সময় এই পুতুল নাচই ছিল তরুণ থেকে শুরু করে বয়স্কদের কাছে বিনোদনের মূল উৎস।শিশুদের কাছেও পুতুল নাচ যথেষ্ট আকর্ষণীয়।
শিল্পীরা জানিয়েছেন ২০০০ সাল থেকে ২০১১ সাল অব্দি প্রায় এই পুতুল নাচ একবারে লুপ্তের দিকে ঢলে পড়েছিল, কিন্তু ২০১১ সাল থেকে মমতা ব্যানার্জির সহযোগিতায় আবার এই হাতের পুতুল নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
পড়ুয়াদের মনোযোগ বাড়াতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পুতুল নাচকে হাতিয়ার করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুতুল নাচের ঐতিহ্য সম্পর্কে ছাত্র–ছাত্রীদের অবহিত করতে স্কুলে স্কুলে কর্মশালার আয়োজন করছে। পুতুল নাচ কী, কী ভাবে পুতুল বানানো হয়, পুতুলের পোশাক কেমন হয়, তাদের রূপসজ্জা কেমন হয়, সমস্তটাই হাতে ধরে শেখানো হচ্ছে।