আমার এক সিনিয়র সাংবাদিকের মুখে শুনেছিলাম, তখন বাম সরকার, সুভাষ চক্রবর্তী মন্ত্রী এবং তাঁকে নিয়ে রোজ বিতর্ক, তুমুল বিতর্ক। তিনিও সে বিতর্কে রোজ ধোঁয়া দেন, রোজ এমন কিছু বলেন, যা দলের কাছে অস্বস্তির হয়ে ওঠে, রোজ। সেইরকম এক সময়ে, আমার ওই সাংবাদিক দাদা ওনার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সুভাষ’দা দল কি বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে? মানে, মানুষ কি দলকে বিশ্বাস করছে না? সুভাষ চক্রবর্তী বলেছিলেন, সিপিআইএম দল বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছেন কিনা তা বলতে পারেন, কেবল সাংবাদিকরা অথবা দলের শীর্ষ নেতৃত্ব, আমি দুটোর কোনওটাই নয়। তবে মানুষ কখন বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়, সেটা আমি জানি। আপনি বা আপনারা সবাই দেখতে পাচ্ছেন, সামনের মাঠে গাধা হাঁটছে, আপনার পাশে দাঁড়িয়ে আমি যদি বলি, ওই দেখ পারস্যের ঘোড়া দৌড়চ্ছে, তাহলে সেই লোকটা, মানে আমি বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবোই, কেউ আমাকে বিশ্বাস করবে না, এটাই স্বাভাবিক, ব্যক্তিগত জীবন, সমাজ জীবন, রাজনীতিতেও এটাই হয়, মানুষের অভিজ্ঞতা এক, আর আপনি আরেক রকম বললে, আপনি বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবেন।
কত সহজ কথা, অথচ এ এক চরম সত্য, সেই কবে সুভাষ চক্রবর্তী, দলের অসুখটা পরিস্কার ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, টাইটেল চক্রবর্তী হলে কি হবে, সুজনবাবু এই সত্য আজও বুঝে উঠতে পারলেন না, কেবল উনি নয়, সিপিএম নেতৃত্ব এই সহজ সত্যটাকে মেনে নিতে পারেননি, কাজেই বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে এসে ঠেকেছে। মানুষ বুঝেছে যে, ওনারা যা বলছেন, যা যা বলছেন, সবটাই কৌশল, বহু বহু আগে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি কে ওই কৌশল পার্টি বলে ডাকা হত কি ওই কারণে? ধরুন ওই সূর্য বাবু, সুজন বাবুদের দল, সিপিএম, এখন আর দেওয়ালে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করুন, গোছের শ্লোগান লেখেন না বটে, কিন্তু কর্মসূচিতে তাই লেখা আছে। সে কি শিহরণ ছিল, শুনেছি কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার পার্টি ক্লাসে এসেই প্রথমেই বলতেন, কমরেড বিপ্লব হবেই, রক্ত ছলাৎ করে উঠত, অনেকেই মনে করত, তারাতলা রোড দিয়ে বিপ্লব ঢুকছে, আর একটু এগোলেই ব্যস।
তো এই জণনগণতান্ত্রিক বিপ্লবটা কেন? লক্ষ তো সমাজতন্ত্র, এটা কেন? তার বিরাট ব্যাখ্যা আছে, সে ব্যাখ্যা সিপিএমের। সিপিআই আবার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলে, সিপিআইএমএল নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলে, আরএসপি সোজা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথাই বলে, সেসব জটিল আলোচনা, তৈলাধারের পাত্র না পাত্রাধারে তৈলের মত জটিল আলোচনা। কিন্তু মোদ্দা কথাতো বলাই যায় যে, সিপিএম শেষ পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব চাইছেন বা করবেন বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, যে সমাজতন্ত্রে সব কল কারখানা, দেশের সব সম্পদের মালিক হবে রাষ্ট্র, সমাজ। শিল্পপতিদের কাছ থেকে শিল্প কেড়ে নেওয়া হবে, জমির মালিকের জমি আর থাকবে না, সব থাকবে রাষ্ট্রের হাতে। এসব বেশ সুন্দর করে লেখা আছে তাঁদের কর্মসূচিতে। কিন্তু, কিন্তু তার আগে সিপিএম দল, টাটাদের দিয়ে ন্যানো কারখানা তৈরি করাতে চান, ভাল কথা। বেকারদের চাকরি হবে, রাজ্যে শিল্প হলে অর্থনীতি ভাল হবে, আলবত হবে। তা হলে সিপিএমের জনপ্রিয়তা বাড়বে, তাঁরা প্রথমে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব করবেন, ওই কারখানার শ্রমিকরা রক্তপতাকা হাতে নিয়ে বিপ্লবের প্রথম সারিতে, সবই ঠিক হ্যায়। কিন্তু ওই রতন টাটা কিরকম আহাম্মক ভাবুন তো? সিপিএমের ১৫/২০ টাকা দিয়ে কেনা যায়, সেই কর্মসূচিটা কি উনি পড়েন নি? উনি কি জানেন না, যে ক’দিন পরেই যখন বিপ্লব হবে তখন সাধের কারখানার মালিকানা যাবে শ্রমিকদের দখলে, কারখানা কমিটির মাথায় থাকবেন হয় কমরেড রবীন দেব, না হলে কমরেড সুজন চক্রবর্তী? রতন টাটা যিনি হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে এলেন, তিনি জানেন না যে, আর ক’দিনের মধ্যেই তাঁর সম্পদ হাতছাড়া হবে? নাকি ভাল করেই জানেন যে, ওসব ফালতু কথা, লিখতে হয় তাই লিখেছে, আসলে মালিকানা ওনারই থাকবে, লাভের গুড় উনিই খাবেন, আর ছিটেফোঁটা বিলোবেন! সবাই জানে, দেশ শুদ্ধু মানুষ সব্বাই জানে যে আর যাই করুক সিপিএম বিপ্লব করবে না, সিপিএমের নেতারাও বিলক্ষণ জানেন, কিন্তু কর্মসূচিতে জ্বলজ্বল করবে, কমরেড বিপ্লব হবেই, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব।
আসুন আর একটু এগোনও যাক, দুটো চুক্তি নিয়ে সিপিএম যত কথা বলেছে, তার সংকলন সম্ভবত আর একটা মহাভারত হয়ে উঠবে, প্রথমটা হল ডাঙ্কেল চুক্তি, দ্বিতীয়টা হল আমেরিকার সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি, নিউক্লিয়ার ডিল। আচ্ছা, গত পাঁচ বছরে এ নিয়ে একটা কথাও শুনেছেন, সিপিএম নেতাদের মুখে। যে চুক্তি হলে আমাদের দেশ বিকিয়ে যাবে, সব যাবে চুলোর দোরে। সেই দুই চুক্তি হয়ে যাবার পরে ইদানিং কালে একটা কথাও শুনেছেন? শোনেননি। তাহলে কি ডাঙ্কেল চুক্তি সঠিক ছিল? আমেরিকার পারমাণবিক চুক্তি কি সঠিক ছিল? তাও নয়। কিন্তু সিপিএমের বিরোধিতা যে নিছকই বিরোধিতা ছিল, তা আজ জলের মত পরিস্কার। জমিনি হকিকৎ, মাটিতে যা ঘটছে, সেই বাস্তবতার সঙ্গে দলের কোনও যোগাযোগ নেই, রাখার চেষ্টাও নেই। সেই একই ধারাবাহিকতা মেনে মমতা বিরোধিতা, এর মানে কি এটা নাকি যে মমতা সরকারের বিরোধিতা করা যাবে না? বিরোধী দল তো বিরোধিতা করবেন, দাবি তুলবেন, যুক্তি দিয়ে তথ্য দিয়ে বোঝাবেন যে সরকার ভুল করছে, এটাই তো সংসদীয় রাজনীতির রীতিনীতি, এটাই তো স্বাভাবিক। বেশ করেছেন স্বাস্থ্যসাথী চালু করেছেন, কিন্তু এই তো সবাই পাচ্ছে না, কেন পাচ্ছে না? জায়জ প্রশ্ন। দুর্নীতি চলছে কেন? কাটমানি খাচ্ছে কেন? জায়জ প্রশ্ন। প্রশ্ন করলে অন্তত দশটা মানুষ ঘাড় নাড়াবে, পাশে এসে দাঁড়াবে। অঙ্গনওয়াড়ি মহিলাদের ভাতা বাড়াতে হবে, তাঁরা পাশে এসে দাঁড়াবেন, স্বাভাবিক। কিন্তু যদি বলেন বিজেপি মমতা আসলে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ, তৃণমূল আসলে কেন্দ্রে বিজেপির সুবিধে করে নিতে চায়, মমতা দিল্লি গেছেন নরেন্দ্র মোদিকে ম্যানেজ করতে, তখন মানুষ হাঁ করে তাকিয়ে আপনাদের দেখে, দেখে আর ভাবে, এরা কি পাগল? এরা কি শয়তান? এরা কী চাইছে? সেই একই দল মাত্র গতকাল, এমন কি শিবসেনা বা ন্যাশন্যাল কনফারেন্সকে নিয়ে পেগাসাস নিয়ে ডেপুটেশন দিতে গেছে, ডিএমকে নিয়ে ডেপুটেশন দিতে গেছে। সবার জানা, এই সেদিন পর্যন্ত এই সব কটা দল কখনও না কখনও বিজেপির শরিক ছিল, তাদের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিল, বাবরি মসজিদ ভাঙায়, শিবসেনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, হিন্দুত্বের প্রশ্নে তারা এখনও কট্টর। সিপিএমের এদের নিয়ে কোনও অসুবিধে নেই, অসুবিধে কাকে নিয়ে? তৃণমূলকে নিয়ে, কারণ সেই দল বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, তেলেগু দেশম থেকে ন্যাশন্যাল কনফারেন্স থেকে, ডিএমকে থেকে শিবসেনা নিয়ে চুপ করে থাকা সুজন চক্রবর্তী, রাজ্যের মানুষকে বোঝাচ্ছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লি গেছেন নরেন্দ্র মোদিকে ম্যানেজ করতে, এই একই কথা বুঝিয়েছেন মানুষকে প্রতিটা জনসভায়, প্রতিটা লিফলেটে, প্রচারে, ফেসবুকে, টুইটারে। বিজেপি আর তৃণমূল একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ, আমরা দু’জনের বিরুদ্ধেই লড়বো, দু’জনকেই হারাবো, আসন তো পাবই, তৃণমূলের আসন কম পড়লেও সমর্থন করবো না। মানুষ বুঝেছে? কেন বুঝতে যাবে? মানুষ কি পাগল না কৌশল পার্টি? তারা চোখের সামনে দেখছে, মোদি সরকারের প্রায় পুরো মন্ত্রিসভা, তাদের বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, তাদের রাজ্যের নেতারা প্রতিদিন তৃণমূলকে আক্রমণ করছে তীব্র ভাষায়, প্রতিদিন তৃণমূলনেত্রীকে আক্রমণ করছে, তীব্রতর ভাষায়, সিপিএম বলছে দিদি মোদি সেটিং আছে, আসলে ওরা বিজেমূল।
তৃণমূল তো ছাড়ুন, এ রাজ্যে কিছু বাম মানুষজন শ্লোগান দিলেন, নো ভোট টু বিজেপি। সিপিএম বললো, এই শ্লোগান আসলে তৃণমূলকে জেতানোর জন্য, তাঁরা কেউ একবারের জন্যও, ভোট ফর তৃণমূল বলেননি, মানুষ দেখছে, শুনছে। সুজন চক্কোত্তি আর সূর্য মিশ্র বললেন ওরা বিজেমূল, ওনাদের সবেধন বুদ্ধিজীবী সৌরভ পালোধি, কমলেশ্বর মুখার্জি বললেন বিজেমূল, বিজেমূল। ঘুমের ঘোরে বললেন না, না বুঝে বললেন না। মনে করেছিলেন এভাবেই মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া যাবে, টুম্পাকে তো বুঝিয়েই ফেলেছেন, ফল? শূন্য, নিজের জেতা আসনও হারালেন সুজনবাবু, হারলেন আব্বাস জোটের কারিগর সেলিম সাহেব। আসলে সেই একই প্রশ্ন, আপনি যে শ্লোগান তুলছেন, আপনি যা বলছেন, মানুষ তা বিশ্বাস করছে তো? যদি বিশ্বাস করে, তাহলে কেরলের দিকে তাকান, এমন কি সবরিমালা বিতর্কে বিরোধিতার পরেও, সেখানে সিপিএমের ভোট কমেনি, আসন বেড়েছে। তাঁরা বলেননি কংগ্রেস খারাপ, বলেছেন কেরলের উন্নয়ন বামেদের হাতে সুরক্ষিত, বলেছেন কোভিড সামলানোর কথা, মানুষ বরং রাহুল গান্ধীকে বিশ্বাস করেনি, যিনি বলেছিলেন, সিপিএম যে দর্শনে বিশ্বাস করে তা পচে গেছে, মানুষ শোনেনি তেনার কথা, পিনারাই বিজয়ন জিতেছেন, শূন্য পেয়েছেন সুজন চক্রবর্তী, আরও পাবেন। কারণ ওনার, ওনাদের ঘোর এখনও কাটেনি, সর্বভারতীয় মঞ্চ ওনারা না চাইলেও হবে, তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সে মঞ্চে নিশ্চই থাকবেন সীতারাম ইয়েচুরি, এক মঞ্চ থেকেই বিজেপি বিরোধী লড়াই হবে, হবেই। সুজনবাবুরা নিজেদের না শুধরোলে, বিশ্বাসযোগ্যতা, যা হারিয়েছে, তা ফেরত পাবেন না। সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে রাজনীতি করা যায় না, মানুষ কৌশল ধরে ফেলে, হাতে নাতে জবাবও দিয়ে দেয়, কবে বুঝবে বঙ্গ সিপিএম?