নমস্কার শুরু করছি আজকের চতুর্থ স্তম্ভ, আমি সুচন্দ্রিমা।
এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃস্টান।
এসো ব্রাহ্মণ শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার,
এসো হে পতিত করো অপনীত সব অপমানভার।
মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা,
সবারে-পরশে-পবিত্র-করা তীর্থনীরে।
আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।
আমাদের ঠাকুর সেই কবেই বলে গেছেন, এই কথা, আমাদের কানে ঢোকেনি এই যা। আমরা জানিই না, জানার চেষ্টাও করিনি সবে বারাত-এর উৎসব কেন? কী হয় সে উৎসবে? আমরা জানার চেষ্টা করিনি লক্ষ্মীর পাঁচালি কী। আমরা জানিই না ইস্টার স্যাটারডে খায় না মাথায় দেয়। আমাদের ধারণা মুসলমান মানেই গরু খায়, কাজেই তাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন শুনলেই বাবা-মা চোখ কপালে তুলেছেন, গেল বোধহয় ছেলের জাত। আমাদের ধারণাই নেই ৯০ শতাংশ হিন্দু জবাই করা মুরগি বা খাসিই কেনে, জানা নেই বলেই এক আতঙ্কিত মুসলমান হিন্দুদের বাড়িতে ফলাহার করে বাড়ি ফেরে, আমরা জানিই না যে খ্রিস্টান বা আদিবাসী সাঁওতাল কোল ভিল মানুষজন খাবার পাতে রোজ শুয়োর রাখে না, তারা ভাত, ডাল, ডিমও খায়। আমরা জানি না এক সাঁওতাল আদিবাসীর বিয়েতে কন্যাপক্ষকে পণ দিতে হয়, আমরা জানি না যে ক্যাথলিক খ্রিস্টানেরা দুই বিবাহ, ডিভোর্স ইত্যাদিকে পাপ বলে মনে করে, আমরা জানিই না যে হিন্দু মতে বিয়ে মানে দুজন নারী পুরুষ নয়, দুই ভিন্ন গোত্রের বিয়ে, সেখানে নারী বা পুরুষের ভেদাভেদ এই সেদিনের চল। আমরা জানি না আমার পাশের বাড়ির মানুষটা কী খেতে ভালবাসে, আমরা জানি না আমার সন্তানের বন্ধুরা বাড়িতে কোন ভাষায় কথা বলে, আমরা জানি না মালয়ালম, কন্নড়, তামিল, তেলুগুর পার্থক্য, আমরা জানি না মঙ্গোলয়েড চেহারা মানেই নেপালি নয়। এই পশ্চিমবাংলার আমরা অনেকেই জানিই না যে বাঙালি মুসলমান বাংলাতেই কথা বলে। আমরা কিছু বন্ধুবান্ধব বাড়িতেই আড্ডা দিচ্ছিলাম, তার মধ্যে একজন মুসলমান ছেলেও ছিল, আমার ঠাম্মা ঘরে এসে বলেছিলেন, বাহ, তুমি মুসলমান হলে কী হবে? কী পরিষ্কার ঝরঝরে বাংলা বলো। কালাম, আমাদের বন্ধু হাসতে হাসতে বলেছিল, হ্যাঁ ঠাম্মা, আমরাই তো বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছি। আমরা জানিই না আমাদের চারপাশে থাকা, বসবাস করা মানুষজনেদের, জানার চেষ্টাও করি না। আর সেই সুযোগেই আমাদের মাথার মধ্যে পুরে দেওয়া হয় অজস্র মিথ্যে কথা, দেওয়া হয় বিভেদের কুমন্ত্রণা। আমরা একজন মুসলমান দেখলেই প্রথমেই মনে করি এর নিশ্চয়ই চারটে বউ আছে, ১৮টা বাচ্চা আছে। একবারও তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখেছেন, আপনার পরিচিত বা অপরিচিত মুসলমান মানুষজনদের ঘরে? তাদের ক’টা বিয়ে, ক’টা বাচ্চা? কী খায়? তাঁদের উৎসব, তাঁদের জন্ম বা মৃত্যুর উপাচার জানার চেষ্টা করেছেন? একজন মুসলমানও কি সেটা করার চেষ্টা করেন? মঙ্গোলয়েড মুখ দেখলেই তারা নেপালি আর কুকুর খায়, এই ধারণার বাইরে গেছেন? তাঁদের কবিতা গান, সাহিত্য ঘেঁটে দেখার ইচ্ছে হয়েছে? বাড়ির কাছে আরশিনগর, সেথা এক পড়শি বসত করে, ঠিক আছে, কিন্তু সেই পড়শির সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী? পঞ্জাবের মানুষ মানেই মুর্গ মুসল্লম আর অন্ডা তড়কা? তথ্য বলছে পঞ্জাবে দেশের মধ্যে সবথেকে বেশি নিরামিষভোজীদের বসবাস। দক্ষিণ ভারতীয় মানেই অব্রাহ্মণ এই ধারণার বিপরীত তথ্য হল আমাদের কেদারনাথের মূল পুরোহিত দক্ষিণ থেকেই আসেন।
হ্যাঁ, পড়শি নিয়ে এই অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়েছে হিন্দু মৌলবাদীরা। মুসলমান মৌলবাদীরা। তারা প্রচার করেছে, মিথ্যে প্রচার করেছে, নোংরা প্রচার করেছে আর সেই প্রচারে পা দিয়ে আমরা লড়েছি, ভাইয়ে ভাইয়ে লড়েছি, প্রতিবেশীদের খুন করেছি, ঘর জ্বালিয়েছি, আজ থেকে নয়, হাজার হাজার বছর আগে থেকেই। অথচ হিন্দুরা বলেছেন বসুধৈব কুটুম্বকম, খ্রিস্টানরা বলেছেন লাভ দাই নেবার, প্রতিবেশীদের ভালোবাসো, বি আ গুড সামারিটান। হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনও অমুসলিমকে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ প্রত্যেক ধর্ম, প্রত্যেক জাতি সম্প্রীতির কথাই বলেছে, পড়শিকে ভালবাসার কথা বলেছে কিন্তু কিছু হাতে গোনা মানুষ সেই সম্প্রীতিকে ভাঙতে চায়, তারা কাশ্মীর থেকে কাশ্মীরি ব্রাহ্মণদের উচ্ছেদ করে, তারাই গুজরাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সন্তানসম্ভবা মায়ের পেট চিরে উল্লাস করে, তারাই গলায় জলন্ত টায়ার ঝুলিয়ে প্রৌঢ় শিখকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে, তারাই মণিপুরে কেবল মাত্র অন্য জাতের বলেই মহিলাকে নগ্ন করে প্যারেড করায়, ধর্ষণ করে, উপাসনালয় ভাঙে, ঘর জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের কেমন থাকা উচিত? যদি কেবল বাঙালিদেরই কথা বলি, তাহলে আমরা এই ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই রুখতে কী করব?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজির রক্তমাখা হাতের অতীত ফিরে ফিরে আসছে
আমরা বাঙালি-চেতনা নিয়ে বিদেশি গুপ্ত-শাসনে গ্লানিবোধ করব, পাল-গৌরবে গর্বিত হব, স্বাধীন সুলতানি আমলের ঐশ্বর্য গর্বে উল্লসিত হব, মুঘল শাসনের অত্যাচারী সম্রাটদের অত্যাচার নিয়ে শতবার বেদনাবোধ করব, আকবরের মতো প্রজাবৎসল শাসকদের সম্মান করব, শেরশাহ সূরির গ্রান্ট ট্রাঙ্ক রোডের কথা বুক পিটিয়ে বলব, ব্রিটিশ শাসনে অপমানের জ্বালা অনুভব করব। স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রতিটা জাতি, ধর্মের মানুষদের আত্মত্যাগের কথা মনে রাখব, দেশ বিভাজনের গ্রেট বিট্রেয়াল মনে রাখব। আমরা বৌদ্ধযুগের মূর্তিশিল্পে পিতৃপুরুষের নৈপুণ্য প্রত্যক্ষ করব, সেন আমলের সংকীর্ণ ব্রাহ্মণ্যবাদের নিন্দা করব, মসলিন শিল্পের গৌরব করব, মন্দিরে মসজিদে অসাধারণ কারুকার্য, গঠন শিল্পের প্রসারে উল্লাসবোধ করব, বাংলা ঘরের আকর্ষণে আকুল হব। ধনপতি-চাঁদ সওদাগরে বাঙালির উদ্যম দেখে খুশি হব, সত্যপীর-বড়গাজিতে বাঙালির কল্যাণবুদ্ধির বিকাশ দেখে আশ্বস্ত হব। বাউল-দর্শনের গৌরব করব। আমরা গীতা বাইবেল কোরান-হাদিস ত্রিপিটক জেন্দাবেস্তা জানব, বুঝব, সেই সময়ের ইতিহাসের আলোয় সেসবের অর্থ বোঝার চেষ্টা করব। চর্যাগীতির রহস্য উদঘাটন করব, বেহুলা-লখিন্দরের গল্প পড়ব, বৈষ্ণব পদাবলি আস্বাদন করব, বিদেশি তুর্কি-মুঘল শাসক বিদ্বেষী বঙ্কিম-সাহিত্যের রস-গ্রহণ করব, রবীন্দ্রসাহিত্য-সমুদ্রে অবগাহন করব। তাকিয়ে দেখুন না, পাকিস্তান এক মুসলমান দেশ, তারা মহেঞ্জোদরো-হরপ্পা ঐতিহ্যের সংরক্ষণ করেনি? হিন্দু-বৌদ্ধ ঐতিহ্যবাহী গান্ধার-এ নিজেদের খুঁজে পায়নি? এইভাবেই তো বিভিন্ন সংস্কৃতি মিশে যায়, ধর্মের মিলন ঘটে, এমন এক অবস্থাতেই তো মানুষ মনোযোগ দেয় আরও উন্নততর জীবনের দিকে। আর এটা করতে গেলে নো দাই নেবার, নিজেদের পড়শিকে চেনো, এটাই হতে পারে এক মোক্ষম অস্ত্র। আমার পাশের বাড়ির, পাশের পাড়ার অন্য ধর্ম, অন্য জাতির মানুষকে জানলে, তাদের সঙ্গে পরিচিত হলে একটা গুজবেই লড়াই দাঙ্গা হবে না। তাদের বাড়ির ছোটদের প্রবীণদের সঙ্গে পরিচিত হলে আমাদের মধ্যেকার সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। যে ফাঁকফোকর দিয়ে বিভেদের কুমন্ত্রণা ঢুকছে, তা বুজে যাবে। ঠিক এই মুহূর্তে এটাই সবথেকে বড় কাজ, আর সেই কাজে হাত দিয়েছেন কিছু মানুষ। তাঁদের নেতৃত্ব আগামী কাল ২৯ তারিখে কলকাতায় আসছেন, একগুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়ে, তাঁরা ডাক দিয়েছেন, মেরে ঘর আ কে তো দেখো, রবি ঠাকুরের ডাক, এসো এসো আমার ঘরে এসো। তাঁদের বক্তব্য হল আগামি দিনগুলোতে আমরা আমাদের পড়শিদের বাড়িতে ডাকব, অন্য ধর্মের, অন্য জাতের, অন্য বর্ণের, অন্য ভাষার মানুষজনদের পরিবার সমেত নেমন্তন্ন করব। ঘরে যা আছে, যেটুকু সম্ভব তাই দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করব, তাই দিয়েই তাদের সঙ্গে খেতে বসব, তাদের সঙ্গে কথা বলব, তাদের বোঝার চেষ্টা করব। অপরিচিত সেই সমাজ, ধর্ম, জাতি, বর্ণ আর ভাষার মানুষদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলব। মাসে একটা বা দুটো পরিবার, এক অন্য রকমের সম্মিলন। বাঙালির কাছে এ তো নতুন কিছু নয়। আমাদের প্রাণের ঠাকুর তো সেই কবেই এই কথা বলে গেছেন—হেথায় আর্য, হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড়, চীন–
শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।
আজ সেই দেহকে আলাদা আলাদা করার চেষ্টায় মেতেছে আরএসএস-বিজেপি। সেই সময়ে এই মেরে ঘর আ কে তো দেখো এক অনবদ্য চিন্তা। হ্যাঁ, বাইরে থেকে কথা বলবেন কেন? তাঁদের ঘরে যান, তাঁদের ঘরে ডাকুন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলুন, তাঁদের কথা শুনুন, আমরা ওরার বিভেদ কাটিয়ে আমরা হয়ে উঠুন, তাহলেই ওই বিষাক্ত কালনাগিনীর ফনা ভেঙে যাবে। যারা এরকম করবেন, আমাদের জানান, আমরা সেই বাড়িতে যাবো, তাঁদের কথা শুনব, দেখাব কলকাতা টিভিতে। যে সব সংগঠন এই ডাক দিয়েছে তার মধ্যে সমাজকর্মী ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ওমেন-এর সভাপতি অরুণা রায় আছেন, আছেন শবনম হাসমি, শহীদ নাট্যকার সফদার হাসমির বোন, আছেন অ্যানি রাজা, সিপিআই সাধারণ সম্পাদকের স্ত্রী, কিন্তু সেটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় তো নয়, তিনি মহিলা সংগঠন এনএফআইডাবলিউ-এর সাধারণ সম্পাদক, জাগরী গ্রামীণ, কারওঁয়া এ মুহব্বত-এর মতো সংগঠন। সবচেয়ে বড় কথা হল কে ডাক দিয়েছে, এখানে সেটা গৌণ, আসল বিষয় হল পড়শিকে চিনুন, আগামী ১৫ অগাস্ট থেকে শুরু হবে এই কর্মসূচি, সেদিন থেকে মাসে অন্তত একটা পরিবারকে ডাকুন ঘরে, ডাল ভাত খাওয়ান, কথা বলুন, ভারত আবার ফিরে পাক বসুধৈব কুটুম্বকমের ঐতিহ্য। সলিল চৌধুরি লিখছেন,
ও মোদের দেশবাসীরে—
আয়রে পরাণ ভাই আয়রে রহিম ভাই
কালো নদী কে হবি পার।
এই দেশের মাঝেরে পিশাচ আনেরে
কালো বিভেদের বান,
সেই বানে ভাসেরে মোদের দেশের মান।
এই ফারাক নদীরে বাঁধবি যদিরে ধর গাঁইতি আর হাতিয়ার
হেঁইয়া হেঁই হেঁইয়া মার, জোয়ান বাঁধ সেতু এবার |
এই নদী তোমার আমার খুনেরি দরিয়া
এই নদী আছে মোদের আঁখিজলে ভরিয়া
এই নদী বহে মোদের বুকের পাঁজর খুঁড়িয়া
মোরা বাহু বাড়াই দুই পারেতে দুজনাতে থাকিয়া
ওরে এই নদীর পাকে পাকে কুমীর লুকায়ে থাকে
ভাঙে সুখের ঘর ভাঙে খামার,
হেঁইয়া হেঁই হেঁইয়া মার, জোয়ান বাঁধ সেতু এবার।