সংসদে এক একজন সাংসদ ছ’টা। আটটা, ১২টা করে পয়েন্ট অফ অর্ডার তুলেছেন, নোটিস দিয়েছেন, লাগাতার লোকসভার স্পিকার বা রাজ্যসভার চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেছেন ২৬৭ ধারায় মণিপুর নিয়ে আলোচনা করা হোক আর প্রধানমন্ত্রীকে মণিপুর নিয়ে বিবৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু ৭৮ দিন পরে একটা ৩৬ সেকেন্ডের বিবৃতি দেওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী এই নিয়ে আর কোনও কথা বলতে রাজি নন। আর সংসদে এক মহানুভব অমিত শাহ চিঠি লিখে বিরোধী দলনেতাকে জানিয়েছেন যে আপনারা আলোচনায় আসুন। কিন্তু ওই ২৬৭ ধারা অনুযায়ী নয়, ১৭৬ ধারা মেনে আলোচনা হবে। ওই ১৭৬ ধারা মেনে আলোচনা হলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আলোচনা করতে হবে, স্পিকার বললেন দেড় ঘণ্টা কি দু’ ঘণ্টা, সেটাই ফাইনাল। তখন সেই দেড় কি দু’ ঘণ্টাকে শাসকদল, বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ভাগ করা হবে। সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী বেরিয়ে যাবেন ভ্রমণে, তাঁর তো পায়ের তলায় সরষে। ঠিক সেই কারণেই বিরোধীরা ২৬৭ ধারা মেনে আলোচনা চাইছেন, যেখানে সময়সীমা নেই, এবং তাঁরা নিশ্চয়ই ওই আলোচনা চলাকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করবেন, উনি না দেওয়া পর্যন্ত আলোচনা চলবে। কিন্তু বিজেপির আর যাই থাকুক গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি এতটুকু আস্থাও নেই, কাজেই ওঁরা তা চান না। অতএব বিরোধীদের হাতে এর পরের অস্ত্র ছিল সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব আনা, আলোচনা চলবে দুই কি তিন দিন ধরে এবং প্রধানমন্ত্রী বাধ্য এই আলোচনার শেষে তাঁর বিবৃতি দিতে। কাজেই এই অনাস্থা প্রস্তাবে সরকার পড়ে যাবে না, কিন্তু নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদিজিকে মণিপুর নিয়ে বলতে বাধ্য করা যাবে, তাঁকে বলতেই হবে কী চলছে মণিপুরে, আর অনাস্থা প্রস্তাবের আলোচনায় কান থাকবে সংবাদমাধ্যমের। সব্বাই তো আর রিড় কি হড্ডি বিকিয়ে দিয়ে জো হুজুর বনে যায়নি, কাজেই ওঁর সেই মুখনিসৃত বাণী মানুষের কাছে পৌঁছবেই।
কিন্তু একটা প্রশ্ন তো থেকেই যায় যে মোদিজি, বা এই বিজেপি সরকার মণিপুর নিয়ে কথা বলতে রাজি নন কেন? মণিপুরে যা ঘটেছে তা এক জাতি দাঙ্গা, ধর্মকেও কাজে লাগানো হয়েছে, বিজেপির এক সুপরিকল্পিত চক্রান্তের পরেই এই দাঙ্গা শুরু হয়েছে। এন বীরেন সিংয়ের সরকার মনে করেছিল যে দাঙ্গা কিছুদিন চলুক, মেইতেই, কুকি, জো, হিন্দু বৈষ্ণব, খ্রিস্টান, মুসলমান বিভাজনটা পরিষ্কার হোক, সংখ্যাগুরু মেইতেইদের সমর্থন তো আমাদের হাতেই থাকবে, ওদিকে কুকি আর জো বা রাজ্যের মুসলমানরা তো এক জায়গায় আসবে না, কাজেই ওই ৪১-৪২ শতাংশ মেইতেইদের সমর্থন পেলেই ভবিষ্যৎ ফুরফুরে। কিন্তু সে দাঙ্গা সামাল দেওয়া যায়নি, দেওয়া যায় না, কারণ অত ছোট রাজ্য হলেও উপজাতিরা ওয়ারিয়র ক্লাস, যোদ্ধা জাতি, পাশে মায়ানমার বর্ডার, বাংলাদেশ বর্ডার থেকে অস্ত্রের জোগান আছে, মারলে পালটা মারও আসবে, এটা ভেবে উঠতে পারেনি এন বীরেন সিং সরকার। এসেছে, এবং এখনও সেই আগুন নেভানো যাচ্ছে না, মণিপুরে ঠিক কার শাসন চলছে তাও আমাদের জানা নেই। মধ্যে বলা হয়েছিল, ৩৫৫ ধারা অনুযায়ী একজন সামরিক প্রশাসককে বসানো হয়েছে, যাঁর নেতৃত্বে আইন শৃঙ্খলার দেখরেখ চলবে। কিছুদিন পরেই মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করেই জানিয়ে দিয়েছেন, আইন শৃঙ্খলা তাঁর হাতেই আছে। সেনাবাহিনী আনা হয়েছে, তারা কোন রেজিমেন্ট, কোন জাতির, সেসব তথ্য আগেই ফাঁস হয়ে গেছে। স্বাধীন ভারতবর্ষে এই ঘটনা এই প্রথম, সেনাবাহিনীর কমান্ডার, তার নাম জাতি প্রকাশ্যে আসার কোনও ঘটনা আজও ঘটেনি, মণিপুরে সেটা ঘটল। এর থেকে এটা অন্তত পরিষ্কার যে কেবল রাজ্য সরকার নয়, মোদি-শাহের সরকারও এই দাঙ্গার জন্য সমান দায়ী। পুলিশের আর্মারি লুঠ হল, অটোরিকশা ভাড়া করে আর্মস অ্যামুনিশন নিয়ে চলে গেল দুষ্কৃতীরা, বিনা বাধায়, একজনও পুলিশ গুলিই চালায়নি। বিজেপির বিধায়কদের মধ্যে ৮ জন কুকি উপজাতির সদস্য আছে, তাদের মধ্যে একজন ভুঞ্জাগিন ভালতেকে রাস্তায় রড দিয়ে পেটানো হয়েছে, তারপর তাঁকে স্থানীয় এক ক্লাবে নিয়ে গিয়ে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হয়েছে। তিনি কথা বলার মতো অবস্থায় নেই, তাঁর স্ত্রী বলছেন, উনি একদিনও ছুটি নিতেন না, এখন অখণ্ড ছুটিতেই আছেন, বিছানায় শুয়ে আছেন, কথাও বলতে পারছেন না। ওঁরা অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করে অপরাধীদের গ্রেফতার করতে বলেছিলেন, সেখান থেকে কোনও জবাব পাননি। এন বীরেন সিং একবার ফোন করেছিলেন, তারপর থেকে আর ফোন করেননি, ওঁর স্ত্রী মিডিয়ার সামনেই বীরেন সিংয়ের পদত্যাগ চেয়েছেন। বাকি সাতজন বিজেপি নেতৃত্বের কাছে এন বীরেন সিংয়ের পদত্যাগ চেয়েছেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | শকুনের চোখ ভাগাড়ের দিকে
কার্গিলে লড়েছেন যে সৈনিক, সেই সৈনিকের স্ত্রীকে নগ্ন করে প্যারেড করানো হয়েছে, ধর্ষণ করা হয়েছে। সেই সৈনিক বলেছেন, আমি আমার দেশকে রক্ষা করেছি, পরিবারকে রক্ষা করতে পারলাম না। এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর আশি ঊর্ধ্ব বিধবা স্ত্রীকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। কিন্তু আমাদের তথাকথিত দেশপ্রেমিক নরেন্দ্র মোদি এসব নিয়ে মুখ খোলেননি, তাঁর মুখ খোলানোর জন্যই এই অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছে। এদেশে ভয়ঙ্কর জাতি দাঙ্গা, ধর্মের ভিত্তিতে দাঙ্গা হয়নি তা তো নয়। অসমে বঙাল খেদাও হয়েছে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাতেই হয়েছে। হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। তার আগুন আজও নিভেছে? না, জাতি দাঙ্গার আগুন সহজে নেভে না। কিন্তু এই দাঙ্গা নিয়ে বহু পরে হলেও কংগ্রেস থেকে অসম গণ পরিষদ নেতারা দুঃখপ্রকাশ করেছেন, ক্ষমা চেয়েছেন। শিখ নিধন যজ্ঞ চলেছিল দিল্লিতে, বহু পরে হলেও কংগ্রেস দল, নেত্রী সোনিয়া গান্ধী ক্ষমা চেয়েছেন, ঘা শুকিয়েছে? না, ভেতরে ভেতরে সে আগুন আছে, সময় হলেই তা বার হবে। কাশ্মীরে কাশ্মীরি ব্রাহ্মণদের ক্লিনজিং, আজও, এমনকি বিজেপি যারা নাকি এই ইস্যু নিয়ে প্রবল চিন্তিত, তাদের ৯ বছরের প্রবল রাজত্বের পরে ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার পরেও একজন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণকেও ফেরানো যায়নি, এ ঘা শুকোবার নয়। কিন্তু এমনকী বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিহ্নিত কাশ্মীরি নেতারা বা মেন স্ট্রিমের ফারুক আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্স বা মেহবুবা মুফতির পিডিপি ক্ষমা চেয়েছে, দুঃখপ্রকাশ করেছে। ২০০২-এর গুজরাতের স্টেট স্পনসর্ড রায়ট। ১১০০-র বেশি মানুষ খুন হয়েছেন, বাড়ি জ্বলেছে অসংখ্য, জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে প্রাক্তন সাংসদকে, ধর্ষিতা হয়েছেন অসংখ্য মহিলা। কিন্তু না, এই দাঙ্গার জন্য একবারও দুঃখ প্রকাশ করেননি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বরং জাস্টিফাই করেছেন, গোধরায় হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ট্রেনের কামরায় পুড়িয়ে মারার প্রতিক্রিয়া এই গুজরাতের দাঙ্গা এমনটা বহুবার বলেছেন। না, মামলা দায়ের হয়নি, হলেও তা তুলে নেওয়া হয়েছে, সঠিক সময়ে মিলিটারি ডিপ্লয় করা হয়নি, এমনকী যাদের বিরুদ্ধে এই দাঙ্গা লাগানোর অভিযোগ তারা প্রায় প্রত্যেকে একে একে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে, প্রমাণের অভাবে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিলকিস বানোর যে মামলায় ধর্ষকদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, তাদের সাজা কমিয়ে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই বিরাট দাঙ্গার জন্য না নরেন্দ্র মোদি না বিজেপি, কেউ ক্ষমা চায়নি। দাঙ্গা নিয়ে সব থেকে কটু কথা কে বলেছেন? অটলবিহারী বাজপেয়ী। কী বলেছেন? তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছিলেন, রাজধর্ম পালন করো। ব্যস, এই পর্যন্তই।
এই দাঙ্গার রক্ত লেগে আছে মোদি-শাহের হাতে। এবং এ নিয়ে মোদিজি কতটা সেনসিটিভ? তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি বিবিসির ডকুমেন্টারি রিলিজের সময়ে, ২০০২ এর দাঙ্গা, ডকুমেন্টারি রিলিজ হচ্ছে ২০২২-এ, কিন্তু তাকে আটকানোর জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করলেন মোদি-শাহ। বিবিসির ঘরে রেইডও হয়ে গেল, এমন নয় যে রেইডের বিষয় ২০২২-এ তৈরি হয়েছে, যা নিয়ে রেইড তা ২০১৯-এও করাই যেত। ফেলে রেখে দিয়েছিলেন, ডকুমেন্টারি বন্ধ করা গেল না, রেইড হল। আজ মণিপুরের এই ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী মুখ খুললেই সেদিনের অতীত বেরিয়ে আসবে। সেদিন যে রক্ত লেগেছিল হাতে সে রক্তের দাগ তো মোছা যায়নি, তা আরও গাঢ় হয়ে বসবে মণিপুরের ঘটনায় মুখ খুললে। এই পৃথিবীতে অপরাধ করলে তার বিচার অন্য কোথাও হয়? অনেকে তা বিশ্বাস করেন, আমি করি না, এই পৃথিবীতেই তার বিচার চলতে থাকে। যে রক্তাক্ত অধ্যায়ের জন্য দায়ী আমাদের প্রধানমন্ত্রী, সেই মৃত্যু, সেই ধর্ষণ তাঁকে তাড়া করে বেড়াবেই, পিছু ছাড়বে না। মিথ্যে বলেছিলেন, নিজের বিবাহিত স্ত্রীর নাম লুকিয়ে রেখেছিলেন, সে সত্যি সামনে এবং সেই লজ্জা তাঁকে বিদ্ধ করে প্রতিদিন, প্রতিবার নমিনেশন ফাইলের আগে সেই লুকিয়ে রাখা নাম তাঁকে লিখতে হয়। আজও সেই রক্তমাখা হাতের দিকে তাকান না মোদিজি? সেই রক্তাক্ত ইতিহাস মনে পড়ে না? মনে পড়ে বলেই তিনি এন বীরেন সিং সরকারকে ফেলে দিতে পারেন না, মণিপুর নিয়ে কথা বলতে পারেন না, বলতে চান না। সেই ম্যাকবেথ, ডানকানের রাজার রক্তমাখা হাতের দিকে তাকাচ্ছেন লেডি ম্যাকবেথ, শিউরে শিউরে উঠছেন, ঘুমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে সেই হত্যার কথাই বলছেন। ম্যাকবেথও বুঝতে পারছেন, পাপ বাপকেও ছাড়ে না, তিনি বলছেন “I am in blood/ Stepped in so far that, should I wade no more, / Returning were as tedious as go o’er.” ফেরার পথ নেই, আমার হাত রক্তে মাখা। হ্যাঁ, মোদিজি শেক্সপিয়ারের সেই ট্রাজেডির নায়ক, হাত রক্তে মাখা, এক দেশের প্রধানমন্ত্রী, সেই দেশের দেড়শো জনের মৃত্যু, অসংখ্য ধর্ষণ আর নারীদের নগ্ন করে প্যারেড করানোর পরেও কথা বলতে পারছেন না, কিন্তু জানেন ভাল করেই এক রাশ রক্তের মধ্যে তিনি অসহায়, একা।