না, নরেন্দ্র মোদী সংসদে যাচ্ছেন না এমন নয়, সংসদের অধিবেশনে যাচ্ছেন না, বিরোধীদের মুখোমুখি হতে চাইছেন না। এক ভীরু কাপুরুষের মতো বিরোধীদের সমস্ত প্রশ্নের থেকে বাঁচার জন্যই ওঁর এই পরিকল্পনা। এবং সেটাও কিছু নতুন নয়, উনিই সেই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে এক গ্লাস জল খেয়ে সাক্ষাৎকার ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। উনিই সেই একমাত্র ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি সাংবাদিক সম্মেলনে বসেন না। উনিই সেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি নির্বাচনের মতো এক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে এক সিনেমা অভিনেতাকে দিয়ে সাক্ষাৎকার দেওয়ানোর ব্যবস্থা করেন, যেখানে তাঁকে যে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রশ্ন করা হয়েছিল তা হল আপনি আম চুষে খান, চেটে খান না কামড়ে খান। উনিই সেই একমাত্র ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি তাঁর গোটা শাসনকালের মধ্যে তিনখানা কৃষি বিল এনে ফেরত নিতে বাধ্য হয়েছেন, নাগরিকত্ব বিল পাস করানোর পর তা লাগু করার সাহস পর্যন্ত দেখাতে পারেননি, যিনি নিজে ২০০০ টাকার নোট চালু করে আলতো করে তা বাজার থেকে তুলে নিয়েছেন। উনিই সেই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আছে, হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা করানোর অভিযোগ আছে। উনিই সেই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে দেশে বিদেশে হাসাহাসি হয়। উনিই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি সর্বসমক্ষে বারবার মিথ্যে বলেন এবং ধরা পড়ে যান, উনিই সেই প্রধানমন্ত্রী যিনি সর্বসমক্ষে বার বার হাস্যকর তথ্য আর তত্ত্ব তুলে ধরেন, যা শুনে মানুষ হাসে। হ্যাঁ, এরকম প্রধানমন্ত্রী আমার স্বদেশের, আমি লজ্জিত। কিন্তু দু’কান কাটার তো লজ্জাবোধ থাকে না, তাই কিছু অন্ধ দু’কান কাটার দল এখনও তাঁকে সমর্থন করে। সেই তিনি দেশের বড়, মেজো, ছোটখাটো কোনও ঘটনাতেই বিচলিত হন না। বিরোধী দল, বিরোধী নেতা তাঁকে কী বলল তা নিয়েও তাঁর কোনও মাথাব্যথা নেই। তিনি বিশ্বগুরু হয়ে ওঠার তালেই রয়েছেন, কোটি কোটি টাকার উপহার নিয়ে যাচ্ছেন, নজরানা দিচ্ছেন বহুমূল্য উপহার, বদলে পাচ্ছেন আলিঙ্গন, পাচ্ছেন খেতাব, হ্যান্ডশেক। ব্যস, উনি মনে মনে ভাবছেন উনি বিশ্বগুরু হয়ে উঠেছেন। দেশে মানুষ মরল না বাঁচল, না খেতে পেয়ে অভুক্ত থাকল, নারী ধর্ষিতা হল, শীতে বা গরমে মানুষ মারা গেল, মূল্যবৃদ্ধি হল এসব নিয়ে ওঁকে কথা বলতে দেখবেন না, যদি না সামনে ইলেকশন থাকে। সামনে নির্বাচন থাকলে উনি ৮০ কোটি মানুষকে এক বেলার আনাজ দেওয়ার কথা চিৎকার করে বলবেন, তাঁর চিৎকার শুনে মনে হবে এ যেন কোনও বাপকেলে সম্পত্তি বেচে গরিব সেবা করা হচ্ছে।
সেই হেন নরেন্দ্র মোদি হঠাৎই বিচলিত, হঠাৎই কিংকর্তব্যবিমূঢ়, কী বলবেন, কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। পাটনায় বিরোধীরা জোট বৈঠকে বসলেন, উনি বললেন ওটা কিছু দুর্নীতিবাজ মানুষের আখড়া, তারা বসছে ইডির ভয়ে, সিবিআই-এর ভয়ে। দেশের সমস্ত বিরোধী দলের নেতারা দুর্নীতিবাজ, ইডি সিবিআই-এর ভয়ে এক জায়গায় আসছে, কিন্তু তাদের মধ্যে থেকে সেই একই দুর্নীতির আরোপ নিয়েই সুড়ুৎ করে যেই ওনার দলে যাচ্ছে ওমনি তারা সব ওয়াশিং পাউডার নিরমায় ধোয়া দেবশিশু। ওই পাটনার বৈঠকের পরে দেশে ফিরেই বিশ্বগুরু থেকে নির্বাচন ম্যানেজার বনে যাওয়া মোদিজি ইম্ফল, মণিপুরে গেলেন না, গেলেন ভোপালে। সেখানে তখন চলছে মেরা বুথ মজবুত-এর প্রোগ্রাম, সেখানে গিয়ে কর গুনে তিনি বিরোধীদের ঘোটালার কথা বলা শুরু করলেন এক্কেবারে হিসেব দিয়ে। দু’ দিন পরে তাঁরই হিসেবে ৭০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিতে জড়িত অজিত পাওয়ার, ছগন ভুজবল, প্রফুল্ল প্যাটেলদের বুকে জড়িয়ে জোটে নিলেন। প্রফুল্ল প্যাটেলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দাউদ ইব্রাহিমের নাম। মানুষ কী বলবে? মিডিয়া তো কেনা তবুও বাকি যারা আছে তারা কী বলবে? মোদিজির বয়েই গেছে, নির্বাচনে জিতলে তবে তো ময়ূরকে দানা খাওয়াবেন আর নিজে আম খাবেন। এই পর্যন্তও মোটামুটি ঠিক ছিল, দেশের আমজনতার বড় অংশ ওঁর মন্ত্রমুগ্ধ সমর্থক আর আমাদের মতো মানুষজনেরা ভাবছিলাম, ওই বিরোধীরা নিজেদের মধ্যেই খাওয়াখাওয়ি করেই মরবে আবার ৫ বছরের জন্য আমাদের কপালে লেখাই আছে ওই স্ট্রিট স্মার্ট প্রধানমন্ত্রীর শাসন। কিন্তু তার মধ্যেই বিরোধীরা ডেকে দিল বেঙ্গালুরুর বৈঠক, মোদি–শাহ ভেবেছিলেন এনসিপি ভাঙার পরে, আপ কংগ্রেসের ঝগড়ায় ব্যস্ত বিরোধীরা আর ওসব বৈঠকে বসবে না। কিন্তু বৈঠক ডাকা হল, আপ জানাল আসবে, শরদ পাওয়ারও জানালেন আসবেন। ঠিক এই সময় থেকে আমাদের ৫৬ ইঞ্চ কা সিনা কুঁকড়োতে লাগল।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মণিপুর এবং আমাদের বোবা প্রধানমন্ত্রী
প্রথমত, ঠাকুমার ঝুলি থেকে এনডিএ-কে বের করে তার এক বৈঠকের ঘোষণা দিলেন ওই দিনেই যেদিনে বিরোধীরা বেঙ্গালুরুতে বসছেন এবং জানিয়েও দেওয়া হল যে বিরোধীদের মাত্র ২৬? আমরা বসব ৩৮টা দলকে নিয়ে, হুঁ হুঁ বাওয়া, দেখো আমি বাড়ছি মাম্মি। কিন্তু আবার মারাত্মক চমক, বৈঠকের শেষে বিরোধীরা জানালেন তাঁদের জোটের নাম ইন্ডিয়া, বলতে শুরু করলেন লড়েগা ইন্ডিয়া, জিতেগা ভারত। এর পরে পরেই মণিপুরের সেই ভয়ঙ্কর ভিডিও ভাইরাল হল, সারা দেশ এতদিন যাঁরা যে রাজ্যের গাঁজা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে কখনও আলোচনা করেনি, তাঁরা জেনে গেলেন, দু’ মাস ধরে চলতে থাকা মেইতেই আর কুকি জো-দের জাতি দাঙ্গার কথা, মহিলাদের নগ্ন করে প্যারেড করানোর মতো বর্বর ঘটনার কথা আর সবথেকে বড় কথা যেটা দেশের মানুষ জেনে ফেলল তা হল ওই দু’ মাস ধরে চলতে থাকা নারকীয় দাঙ্গার সমস্ত তথ্য লুকিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং, দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। হ্যাঁ, ওঁরা ৪ মে-র ঘটনা ৪ মে-তেই জেনেছেন, ৫ মে-র ঘটনা ৫ মে-তেই জেনেছেন। প্রতিটা তথ্য জানার পরেও কেবল নির্বাচনের জয়ের অঙ্ককে সামনে রেখেই সবটা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু তাঁদের এই চেষ্টা বানচাল হয়ে গেছে। অতএব সংসদের দুই কক্ষে লোকসভায়, রাজ্যসভাতে বিরোধীরা দুটো দাবি করছেন। প্রথমটা হল ২৬৭ রুল অনুযায়ী আলোচনা হোক, এই রুলে বলা আছে গুরুতর এই আলোচনার কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকবে না। আর দু’ নম্বর দাবি, প্রধানমন্ত্রীকে বিবৃতি দিতে হবে। অদ্ভুত ব্যাপার তাই না? আমাদের দেশের চওকিদার কাম চায়ওয়ালা কাম প্রধানসেভক এমনিতে কত কথা বলেন, অনর্গল কথা বলেন। তাঁর পুকুর থেকে মগরমচ্ছ ধরা, সেনাপ্রধানদের মেঘের আড়ালে র্যাডার এড়িয়ে বিমান চালানোর পরামর্শ দেওয়া, করোনা তাড়ানোর জন্য তালি দেওয়া থালি বাজানো নিয়ে অনর্গল কথা বলেন। কিন্তু দেশের এক রাজ্যে যেখানে ওনার দলেরই শাসন আছে, ডাবল ইঞ্জিনের সরকার আছে, সেই রাজ্যে ১৫০ জনের বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন, নারীদের গণধর্ষণ করা হয়েছে, নগ্ন করে প্যারেড করানো হয়েছে, ৪০০ জনের মতো গুরুতর আহত, তাঁর দলেরই কুকি উপজাতির বিধায়ক গণধোলাই খেয়ে বিছানায় শয্যাগত, ২৫০-র বেশি উপাসনালয় পুড়েছে, ৬০ হাজারের বেশি মানুষ গৃহহারা তা নিয়ে একটা কথাও সংসদে বলতে রাজি নন, বলেননি।
সেই সংসদের নতুন ভবন উদ্বোধনের দিনে মাথায় ছাই মেখে কত ভড়ং দেখিয়েছেন, কিন্তু ১৫০ মানুষের মৃত্যুতে অবিচল দেশের প্রধানমন্ত্রী, কারণ উনি জানেন ওঁর কিচ্ছু বলার নেই, আর যদিও বা কিছু বলেন তাতে ওঁর নিজের অতীত সামনে আসতে বাধ্য। যদি আজ এন বীরেন সিংকে উনি এই জাতি দাঙ্গার জন্য পদত্যাগ করতে বলেন, তাহলে ওনার নিজের অতীতের কথাই উঠবে। এমনকী এন বীরেন সিংও জিজ্ঞেস করতেই পারেন যে, আপনার সময়ে ১১০০ মানুষ মারা গিয়েছিল, আপনি কি পদত্যাগ করেছিলেন? আপনার সময়েও বিলকিস বানু গণধর্ষিতা হয়েছিল আপনি কি পদত্যাগ করেছিলেন? আপনার সময়েও তো লক্ষ মানুষ বাড়ি ছেড়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল, আপনি কি পদত্যাগ করেছিলেন? না, উনি সেদিন পদত্যাগ করেননি, আজ কোন মুখে এন বীরেন সিংকে পদত্যাগ করতে বলবেন? সারাক্ষণ ভয়েই আছেন সাংবাদিকরা, বিরোধীরা তাঁর কালো অতীতের কথা না তুলে ধরে। এই একই অন্যায় তিনি করেছিলেন, সেখানে লড়িয়েছিলেন হিন্দু মুসলমানকে, এখানে এন বীরেন সিং লড়াচ্ছেন হিন্দু আর খ্রিস্টানদের। গুজরাতে পাইপগান, তরোয়াল, ত্রিশূল ব্যবহার হয়েছিল, পেট্রল আর বোমা ছিল, মণিপুরে অটোমেটিক আর্মস, মণিপুরে বুলডোজার, মণিপুরে পুলিশ মিলিটারির পোশাক পরেই দাঙ্গা করা হয়েছে। এটুকুই যা তফাৎ, কাজেই উনি লোকসভায় আসতে ভয় পাচ্ছেন, সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়াটা তো ওঁর কুষ্ঠিতে লেখা নেই। এবং এই বিচলিত হওয়ার আরেক নমুনা হল ওঁর আবোল-তাবোল বলা বেড়ে যাওয়া। গতকাল উনি বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোটের কথা বলতে গিয়ে ৩টে ইন্ডিয়ার কথা বলেছেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন আর পিএফআই, পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া। পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নাকি ইসলামিক টেররিস্টদের সঙ্গে যুক্ত এক সংগঠন। মোদিজির ইন্ডিয়া শুনেই এই তিন সংগঠনের নাম মনে এসেছে তিনি এদের সঙ্গে বিরোধী জোটের তুলনা করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন, দেখ, কেবল পণ্ডিত হলেই হয় না মনটাকে উঁচু করতে হয়, শকুন অনেক উঁচুতে ওঠে বটে কিন্তু নজর থাকে ভাগাড়ে। এই কথা তিনি বিদ্যাসাগরকেও বলেছিলেন। সত্যিই শকুন উপর থেকে পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখে না, সে খোঁজে মৃতদেহ, ভাগাড়। আমাদের নরেন্দ্র মোদির ইন্ডিয়া শুনে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির কথা মনে পড়েনি, সংবিধানের আর্টিকল ১-এ লেখা ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত, শ্যাল বি আ ইউনিয়ন অফ স্টেট, এটাও ওনার মনে পড়েনি। ওঁর নিজের স্লোগান মেক ইন ইন্ডিয়া মনে পড়েনি, চক দে ইন্ডিয়া মনে পড়েনি, খেলেগা ইন্ডিয়া, জিতেগা ইন্ডিয়া মনে পড়েনি, ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়ার কথা মনে পড়েনি, লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউসের কথা মনে পড়েনি যেখান থেকে ওঁর গুরুদেব সাভারকর গ্রেফতার হয়েছিলেন, ইন্ডিয়ান মজলিসের কথা মনে পড়েনি, ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডমের কথা মনে পড়েনি, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর লেখা দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগলের কথা মনে পড়েনি, কী মনে পড়ল? ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর পিএফআই-এর কথা। সাধে কি আর মানুষ বলে, শকুনের চোখ ভাগাড়ের দিকে।