পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক মহলে বহু আলোচনার মধ্যে যা সবথেকে বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হল, এই নির্বাচন শুভেন্দু অধিকারীকে কতটা প্রভাবিত করল। মানে তাঁর নেতৃত্ব থাকবে কি না, তাঁর বিধানসভা থাকবে কি না, পূর্ব মেদিনীপুর তো কেবল শুভেন্দু অধিকারীর জেলা নয়, এই জেলা থেকেই তাঁর পিতাশ্রী শিশির অধিকারী এবং ভ্রাতাশ্রী দিব্যেন্দু অধিকারী সাংসদ, তৃণমূলের সাংসদ, তো সেই সাংসদ পদের কী হবে? তাঁদের টিকিট দেওয়া হবে? তাঁরা জিতে আসতে পারবেন? এই নির্বাচনের রেজাল্ট কি শুভেন্দু অধিকারীকে খানিক ব্যাকফুটে ফেলে দিল? এরকম হাজারো প্রশ্ন নিয়ে আমাদের বাংলার ছোট, বড়, সেজ, মেজ ও বড় সাংবাদিকেরা মাথা ঘামাচ্ছেন। এবং দৃশ্যতই ফ্রাস্টেটেড শুভেন্দু অধিকারী মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে যা খুশি তাই বলে চলেছেন। আসলে এরকম হয়, ঘটি হারালে বা গরু হারালে এরকমই হয়ে থাকে। না, আমরা বুঝতে পারিনি, আমাদের মতো আরও অনেক সাংবাদিকরা বিজেপির হাল যে এতটা খাস্তা, এতটা খারাপ তা বুঝতে পারেনি। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারী জানতেন, তিনি কিন্তু বিলক্ষণ বুঝেছিলেন কী হতে চলেছে, তাই তাঁর প্রথম পরিকল্পনা ছিল ইডি আর সিবিআই পাঠিয়ে সবটা ম্যানেজ করা। সেটা যখন হল না তখন তিনি আদালতের দরজায় কড়া নাড়লেন, যে কোনওভাবে যদি নির্বাচনটাকেই বাতিল করা যায়, বিভিন্ন কসরৎ দেখানোর পরে যখন সেটাও হল না তখন তিনি অন্য আরেক কসরতে নেমেছিলেন, এমন এক অবস্থা তৈরি করো, যাতে করে রাজ্যে ৩৫৫ ধারা প্রয়োগ করে নির্বাচিত রাজ্য সরকারকেই ফেলে দেওয়া যায়, আর রাজ্য সরকার পড়ে গেলে নির্বাচনও হবে না। তাঁর মুখেই শুনুন। (বাইট) কিন্তু তারপরেও নির্বাচন হয়েছে, আমাদের হাতে ফলাফলও এসেছে, তাই বিষয় আজকে হল পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং অসহায় কাঁথির খোকাবাবু।
রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নতুন কোনও ব্যাপার নয়, আমরা ভারতবর্ষে এই রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বহু বহু উদাহরণ দেখেছি। আর এটাও তো ঠিক যে যাঁর সেই যোগ্যতা আছে তিনি তাঁর উপযুক্ত পদ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করবেন, এ তো অন্যায় নয়। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া থেকে জর্জ ফার্নান্ডেজ, অজিত পাওয়ার থেকে শুরু করে হিমন্ত বিশ্বশর্মাদের তো আমরা দেখেছি। কিন্তু গা ঘিন ঘিন করে তাদের দেখলে, যাদের না আছে যোগ্যতা না আছে সেই ধৈর্য বা বুদ্ধি, কিন্তু যাঁরা নেমে পড়েন মাঠে কেবল উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে। চাকর, ড্রাইভার, থেকে বাস কনডাকটারের রোলে দিব্য ফিট করে গিয়েছিলেন আমাদের চোখে আঙুল দাদা, হঠাৎ তাঁর তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছে হল। আর ওই একই সময়ে মমতার বদান্যতায় যিনি বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী হয়েছেন তাঁর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছে হল। এবং বিজেপি যারা দেশ জুড়ে এইরকম ট্যালেন্ট খুঁজে বেড়াচ্ছে, তাঁদের চোখে পড়ে গেলেন কাঁথির খোকাবাবু। সঙ্গে কিছু দুর্নীতিরও অভিযোগ ছিল, সব মিলিয়ে সোনায় সোহাগা, বিজেপি গ্যাস বেলুনে হাওয়া ভরে দিল, উনি উড়তে শুরু করলেন। ওনার দৌলতে যদি বিজেপির লাভ হয় তো ভালো, না হলে বিজেপি অন্য কোনও ট্যালেন্ট খুঁজে নেবে, এই ছিল হিসেব।
আরও পড়ুন: Aajke | পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল কোন কোন সত্যিকে সামনে এনে দাঁড় করাল?
একজন রাজনীতিবিদ যাঁর গণতন্ত্রের প্রতি কোনও দায় নেই, চিরটা কাল স্পেনের খ্যাপা ষাঁড়ের মতো রাজনীতি করে এসেছেন, যিনি মাত্র গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ঘোষণা করেছিলেন, ৫ কোটি টাকা দেওয়া হবে সেই জেলাকে যারা জেলা বিরোধী শূন্য করে তুলতে পারবে। কেমন করে? যেমন করে পারা যায় তেমন করে, এটাই ছিল তাঁর নির্দেশ। ফলত মুর্শিদাবাদও ছিল বিরোধী শূন্য, যে মুর্শিদাবাদে এবারে বিরোধীরা ১৪টা জেলা পরিষদের আসন পেয়েছে। বিধানসভা নির্বাচন আসতেই তিনি হঠাৎ সেকুলার থেকে সনাতনী হয়ে গিয়েছিলেন, প্রকাশ্যেই জানিয়েছিলেন, ওই সনাতনীদের ভোট পেলেই চলবে, দরকার নেই মুসলমান ভোট। তীব্র বিষ ছড়িয়ে এমনকী নন্দীগ্রাম জিতে নিলেন। কিন্তু ওই যে বললাম স্পেনের খ্যাপা ষাঁড়, চোখ কেবল ওই লাল পতাকার দিকে, বিধানসভায় ওনার চোখ ছিল নন্দীগ্রামের দিকে, অতএব অবকি বার দোশো পারের জায়গায় ৭৭টা আসন, এবং মুখ্যমন্ত্রী নয়, তিনি হলেন বিরোধী দলনেতা। বিরোধী দলনেতা হওয়া ইস্তক রাজ্যের সরকার ফেলে দেব, ৩৫৫ লাগু হবে, ৩৫৬ লাগু হবে, সিবিআই পাঠাব, ইডিকে দিয়ে গ্রেফতার করাব কেবল বলছিলেন না, বিশ্বাস করছিলেন। ধনখড় সাহেব ধুনো ভালোই দিতেন, সে ধোঁয়ায় তৃপ্ত হতেন শুভেন্দু, নতুন রাজ্যপাল অনেক সময় নিলেন মাঠে নামতে, কিন্তু সবকিছুর পরে নিজের বিধানসভায় ১০ হাজার ভোটে পিছিয়ে। পূর্ব মেদিনীপুরে বিরাট পরাজয় মাথায় নিয়ে নিজের পলিটিকাল কেরিয়ারে নিজেই গ্যামাক্সিন ঢেলেছেন, এখন দিন গোনার পালা। আমরা মেদিনীপুরের মানুষজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই যে বিরাট পরাজয়, এর দায় কি শুভেন্দু অধিকারীর নয়? এর পরে কি উনি লোকসভায় কাঁথি বা তমলুক ধরে রাখতে পারবেন? শুনুন মানুষ কী বলেছেন।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি হেরেছে, তাদের আদিবাসী ভোট রাজবংশী ভোট ভেঙেছে, তাদের উত্তরবঙ্গের হেজিমনি গেছে, তিনজন মন্ত্রীই তাঁদের জায়গাতে হেরেছেন, কিন্তু শুভেন্দুর বিষয়ই আলাদা। তিনি পঞ্চায়েত দেখেই মিডিয়াকে বলে দিলেন হলদি নদীর ধারে তিনি পদ্ম ফুটিয়েছেন। জেলা পরিষদের ফলাফল আসার পরে বোঝা গেল, পদ্ম ধুয়ে গেছে, ওনার নিজের বিধানসভা এলাকাতেও ১০ হাজার ভোটে পিছিয়ে পড়েছেন। আমরা বঙ্গবাসীরা এরপরের সার্কাস দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে রইলাম, আমাদের দেখার ইচ্ছে তমলুক বা কাঁথি লোকসভার আসনে কুণাল ঘোষকে, কুণাল বনাম শুভেন্দুর ঘমাসান লড়াই জমবে ভালো। এবং হেড স্ট্রং শুভেন্দু আটকেই থাকবেন এই পূর্ব মেদিনীপুরে। কতকিছুই তো ভাবি, কতকিছুই তো সত্যিও হয়ে যায়, এমনটা সত্যি হলে জোড়া মোষ, থুড়ি, জোড়া পাঁঠা, থুড়ি জোড়া মুরগি বলি দেব, মাগো মা, মুখ তুলে তাকাও।