ফলাফল হাতে এসে গিয়েছে। এবার যদি আপনি ভাবেন সবটাই হল রিগিং বুথ দখল, মাস্তানি, গুন্ডামি ইত্যাদির ফল, তাহলে ভাবতেই পারেন, তাহলে আর বেশি আলোচনার অবকাশও নেই। এটা যখন আসলে মানুষের মত নয় তখন এ ফল কেন হল, কোন ভোট কোনদিকে গিয়েছে ইত্যাদি আলোচনার কোনও অর্থই নেই। কিন্তু যদি মনে হয় এই ভোটের হিংসা এই ফলাফলের খুব একটা হেরফের করেনি, এ ছিল কিছু সামান্য এলাকাতে দখল আর প্রতিরোধের কাহিনি, এই মাস্তানি আর হিংসা দিয়েই এই ফলাফলকে ব্যাখ্যা করা যাবে না বরং আরও অনেক কিছু আছে যা এই ফলাফল আমাদের সামনে এনে হাজির করল, হ্যাঁ যদি এমনটা মনে করেন, তাহলে আসুন কয়েকটা বিষয় আলোচনা করা যাক। যাঁরা এই ফলাফলের পুরো কৃতিত্ব ভোট লুঠ, গুন্ডামি মাস্তানিকে দিতে চান, তাঁদের বলব আপনারা আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দক্ষিণ দিনাজপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রামের দিকে তাকান। না নমিনেশনের সময়, না ভোটের দিন এইসব জেলা থেকে কোনওরকম বড় অভিযোগ এসেছে, না মৃত্যুর খবর এসেছে, এইসব জেলার ফলাফল কেমন? প্রত্যেকটাতে শাসকদল জিতেছে, বিপুল সমর্থন নিয়ে জিতেছে কেবল নয়, হারানো জমিও ফিরে পেয়েছে উত্তরবঙ্গে, পুরুলিয়ায়, বাঁকুড়ায় আর ঝাড়গ্রামে। অন্যদিকে যেখান থেকে বিরাট অভিযোগ সেই পূর্ব মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, মালদা, নদিয়াতে তবু বিরোধী দলের কিছু হলেও অগ্রগতি আছে। বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম কিছু আসন পেয়েছে, যা তারা গতবার পায়নি। অন্তত এই তথ্যই প্রমাণ করে, যথেষ্ট গন্ডগোল, হানাহানির পরেও ভোটের বাক্স অন্য সুরেই কথা বলেছে, অন্তত একতরফা ভোট হয়নি। তার মানে এই হানাহানি না করলেও তৃণমূল কংগ্রেসের ফলাফলে তেমন বিরাট কোনও হেরফের হত না। আর সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল কোন কোন সত্যিকে সামনে এনে দাঁড় করাল?
প্রথম যে সত্যিটা আমাদের সামনে হাজির তা হল শাসকদলের শীর্ষনেতাদের মাথায় যা আগেই ঢুকেছিল, যা তাঁরা আগেই বুঝেছিলেন, তা তাঁরা তলার সারির নেতাকর্মীদের বোঝাতে পারেননি, বা বোঝালেও তা তাঁরা কানেও নেননি। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রতিটা মিটিংয়ে বলে চলেছেন, শান্তিতে ভোট হোক, মানুষ আমাদের সমর্থন করবেন, আমরা জোর করে জেতার কোনও চেষ্টা করব না, দলীয় শৃঙ্খলার কথা বলেছেন, বলেছেন দলত্যাগীদের দলে নেওয়া হবে না। বাস্তবে হলটা কী? অযথা ভোট লুঠে নামলেন অতি উৎসাহী কিছু মানুষ, যেখানে দুটো কম আসন পেয়েও পঞ্চায়েত দখলেই থাকত, সেই পঞ্চায়েতকে বিরোধী শূন্য করার তীব্র ইচ্ছে নিয়ে তাঁরা নেমে পড়লেন সকেট বোমা আর পাইপগান নিয়ে। কোনও প্রয়োজন ছিল, পঞ্চায়েতে একমাত্র সিপিআইএম-এর জিতে আসা প্রার্থীকে দলত্যাগ করানো? তাও আবার কাউন্টিং বুথের মধ্যেই? কোন প্রয়োজনে খাবারের বদলে ব্যালট পেপারই কচকচ করে চিবিয়ে খেলেন তৃণমূল প্রার্থী? ওই যে আমাকে জিততে হবে, জিততেই হবে, পঞ্চায়েতকে বিরোধী শূন্য করতে হবে।
আরও পড়ুন: Aajke | ঔদ্ধত্য বনাম ঔদ্ধত্য
সে এক সময় ছিল, ভরা বাম জমানায় ভোটের সময় বাবুল গুহ নামে এক সিপিএম নেতা এই ছাপ্পা ভোটের নেতৃত্ব দিতেন, বিরোধীরা চোখ বুজে জিতবে বা সিপিএম চোখ বুজে জিতবে এমন আসনের দিকে তাঁর নজরও থাকত না। মার্জিনাল আসনে, সাতসকাল থেকে পড়ন্ত বিকেলে টুঁ শব্দটি না করে বুথ পিছু ৩০-৪০টা ভোট দিয়েই রেজাল্ট বদলে দিতেন, দলকে জেতানোর জন্য, মিউনিসিপালিটিকে বিরোধীশূন্য করার জন্য নয়। কিছুটা এগিয়ে থাকার জন্য। কিন্তু আপাতত ক্ষমতার ব্যাটন যাঁদের হাতে তাঁদের এই মাত্রাজ্ঞান নেই, অতএব যা হওয়ার তাই হচ্ছে। দুধ, সর, মাখন, ঘি সবই নাগালের মধ্যেই ছিল কিন্তু তা খেতে গিয়ে দশ দিগন্ত কাঁপিয়ে আওয়াজ হল, কংগ্রেসি গুন্ডারা এর থেকে অনেক কম শব্দ করেই ৭২-এ বরাহনগরে জ্যোতি বসুকে হারিয়েই দিয়েছিল। এই মুহূর্তে হাতে ফলাফল, তৃণমূল নেতারা দেখুন, ভাবুন এই বিরাট হাঙ্গামা না করলে ক’টা আসনের ফারাক হত? আসলে অতি উৎসাহী কিছু মানুষ, তাঁর ওপরের নেতাকে জানান দিতে চান তিনি কী বিরাট কাজই না করেছেন, একটা জেলা পরিষদের আসনে জেতানোর জন্য ৪টে বুথ এবং বুথ সংলগ্ন এলাকাকে কাঁপিয়ে দিয়েছেন। শব্দ হয়েছে প্রবল, কাজের কাজ হয়েছে এত সামান্য যে তা ধর্তব্যের মধ্যেই পড়বে না। আমরা মানুষকে প্রশ্ন করেছিলাম, এই হিংসা, খুনোখুনির মধ্যে শাসকদলের কর্মী সমর্থকরা না জড়ালেও ভোটের ফলাফল কি অন্যরকম হত? রাজ্যজুড়ে তৃণমূলের এই বিপুল জয় কি কেবল ভোট লুঠ করে সম্ভব?
গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত হল মানুষের মতামত। সেই মতামত হতে হবে মুক্ত ও স্বাধীন। পেটো বন্দুক দিয়ে মানুষের মতামতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা কোনওদিনই খুব একটা কার্যকরী নয়। হিসেব দেখছিলাম, ন’টা জেলা পরিষদ বিরোধী শূন্য, সেখানে দু’ চারটে বিরোধী থাকলে শাসকের মর্যাদা বাড়ত বই কমত না, এটা শাসককেই বুঝতে হবে। যেমন বিরোধীদেরও বুঝতে হবে যে ও তো সব ভোট লুঠের ফল, এই বলে এক বিপুল মানুষের রায়কে অগ্রাহ্য করার মধ্যে এক অহমিকা থাকে, এক পলায়নী চতুরতা থাকে, কিন্তু তা দিয়ে আগামী দিনে ফিরে দাঁড়ানো, ঘুরে দাঁড়ানো বা প্রতিরোধ গড়ে তোলা, কোনওটাই হয় না।