বেশ কিছুদিন ধরে মূলত বিজেপি এবং অধীর কংগ্রেস হাইকোর্টেই পড়ে আছেন। কোথায় থাকছেন, খাচ্ছেন, চান করছেন কে জানে, সকাল হলেই তাঁদের বা তাঁদের উকিলদের দেখা যাচ্ছে হাইকোর্ট চত্বরে। মাঝেমধ্যেই হাইকোর্টের পিছনে এক হাইকোর্টেশ্বর শিব আছে, সেখানেও নাকি পুজো দিচ্ছেন। চাহিদা এবং ইচ্ছে অনুযায়ী রোজ আদালতে মামলা আনা হচ্ছে, লক্ষ্য একটাই, আপাতত এই নির্বাচন প্রক্রিয়া বন্ধ হোক। একজন ভুয়ো নমিনেশন ফাইল করেছে সেটা বাতিল করুন থেকে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হোক পর্যন্ত আবেদন নিয়ে মামলা। এবং মাঝেমধ্যে মনেই হচ্ছিল, তাহলে এক নির্বাচিত সরকারের দরকার কী? নির্বাচনেরই বা দরকার কী, একটা দিল্লির সরকার থাকুক আর একজন করে রাজ্যপাল, চুকে যায় ল্যাঠা। কিন্তু আমাদের দেশের সংবিধান তো এমন এক শাসন ব্যবস্থার কথা বলেনি। বলেনি যে সরকারের প্রতিটা কাজ নিয়ন্ত্রণ করবে আদালত বা রাজ্যপাল। হতাশ বিরোধীদের সেটাই চাহিদা, সেটাই তাঁরা একবার রাজভবনে গিয়ে বলছেন, একবার হাইকোর্টে। ঝামেলাও কম, এক বাড়ি অন্যবাড়ির লাগোয়া। তার চেয়ে অনেক কষ্টকর রাস্তায় নামা, অনেক কষ্টকর মানুষকে বোঝানো। বরং সোজা উপায় হল সাতসকালে পরোটা বেগুনভাজা খেয়ে আদালতে মামলা ঠুকে রাজভবনে চলে যাওয়া। বিনা খাটনিতে হেডলাইন। আজ প্রায় সেই কথাই বলেছেন হাইকোর্টের বিচারপতি। বলেছেন, আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা বন্ধ করুন। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচন হচ্ছে, ৮ তারিখেই হচ্ছে, এক দফাতেই হচ্ছে। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, পঞ্চায়েত ভোট হবে? ভোট হবে না, ভোট পিছোবে, ভোট হবে।
আদালতের প্রজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার নেই কিন্তু রায় নিয়ে আলোচনা করার অবকাশ তো আছেই। আদালত তো দেশের আইন কানুনের কথা বলবে, দেশের সংবিধান রক্ষার কথা বলবে। কিন্তু কিছুদিন যাবত যাবতীয় আলোচনা, মন্তব্য বা রায় দেখে মনে হতেই পারে যে আদালতকে এক প্যারালাল রাজ্য সরকার চালানোর দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। কিন্তু আজ সকালে হাইকোর্টে স্পষ্ট জানানো হল প্রশাসন প্রশাসনের মতো চলবে, নির্বাচন কমিশন নির্বাচন করাবে, আইন শৃঙ্খলা নিয়ে কিছু প্রশ্ন ছিল, এক নির্দিষ্ট সংখ্যক কেন্দ্রীয় বাহিনীর কথা আদালত বলেছিল, সেই সংখ্যক কেন্দ্রীয় বাহিনী মেলেনি, তাই পাশাপাশি রাজ্য থেকে সেই বাহিনী আনা হচ্ছে। এবার নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সেই বাহিনীকে ব্যবহার করে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সপন্ন করানো। কিন্তু এই যে পান থেকে চুন খসলেই খবরের কাগজের হেডলাইন লোভী মানুষদের ভিড় ওই হাইকোর্ট চত্বরে, তাদের উদ্দেশে কড়া বার্তা দিলেন বিচারপতি, সাফ জানালেন, হেডলাইন হওয়ার জন্য মামলা করবেন না, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে মামলা করবেন না।
আরও পড়ুন: Aajke | সায়নীর জিজ্ঞাসাবাদ এবং দিনভর নাটকের পিছনের আসল গল্প
আজই বামেদের ১৯ জনের নমিনেশনের আর্জি খারিজ করা হয়েছে, প্রায় একইভাবে আইএসএফ-এর রায় আগামিকাল সম্ভবত খারিজ হবে, খারিজ করা হয়েছে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের আবেদন। ভাবা যায়! কোনও সুস্থ মানুষ আদালতে গিয়ে আবেদন করতেও পারেন যে হুজুর ধর্মাবতার রাজ্যে ৩৬৫ ধারা লাগু করে রাষ্ট্রপতি শাসন বলবৎ করার নির্দেশ দেওয়া হোক। সেই আবেদনও একজন করলেন, তা খারিজ হল। এবং এখানেই সেই প্রশ্ন আবার উঠবেই, বিরোধীদের এক অংশ কেন এই অসংলগ্ন মামলা করে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন? সেই দুষ্টু ছাত্রটার মতো যে পড়াশুনো করে না আর পরীক্ষা আসলেই মনপ্রাণ দিয়ে ভগবানকে ডাকে, ঠাকুর পরীক্ষাটা বাতিল করে দাও। তাকিয়ে দেখুন, ডিসেম্বরে ৮৩ বছর বয়সে পা দেবেন শরদ পাওয়ার, গতকাল তাঁর এক্কেবারে কাছের লোকজন, ভাইপো সমেত এক বিরাট অংশ চলে গিয়েছে বিজেপি শিবিরে। আজ উনি রাস্তায়, আজ উনি মানুষের সামনে। বলছেন, ওসব কোর্টকাছারি পরে হবে আপাতত মানুষের কাছে যাব, আবার নতুন করে তৈরি করব দল। হ্যাঁ, এটাই গণতন্ত্রের শেষ কথা, আমাদের রাজ্যের হতাশ বিরোধী দলের শিকড়বিহীন নেতাদের এই সত্য বুঝতে হবে। দেশের প্রতিটা সংকটে, প্রতিটা স্বৈরাচারী আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে নয়, জয় এসেছে মাটি থেকে, মানুষের কাছ থেকে। আমরা প্রশ্ন করেছিলাম মানুষজনকে, বিরোধী দলগুলোর তরফে লাগাতার মামলা করা হচ্ছিল আদালতে, আজ হাইকোর্টের বিচারপতি বললেন আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবেন না, হেডলাইন পাওয়ার জন্য ব্যবহার করবেন না। এই কথাগুলোর নিয়ে আপনাদের মতামত কী? শুনুন মানুষ কী বলেছেন।
সংসদীয় গণতন্ত্রের কিছু বিকৃত রূপ আছে। সংখ্যাগুরুবাদ তার মধ্যে অন্যতম, কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে থাকলে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। আমলাতন্ত্রও সেরকম এক খারাপ দিক, যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধি আমলাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পুলিশতন্ত্রে গণতন্ত্র তার ধারণা হারায় তেমনি এক বিপদ হল জুডিসিয়াল অ্যাকটিভিজম, বিচারবিভাগীয় অতিতৎপরতা, যেখানে দেশের নির্বাচিত নেতা বা প্রশাসন ক্রমশ বিচার বিভগের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যা একইভবে গণতন্ত্রের মূল ধারণার বিপরীত। এক গণতান্ত্রিক দেশে নির্বচিত প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আইন অনুযায়ী প্রশাসন মানুষের জন্য কাজ করবে এবং বিচার বিভাগ সেই আইনের দিকে নজর রাখবে এটাই কাম্য। আজ কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিলেন, আমরা এই রায়কে স্বাগত জানাচ্ছি।