পঞ্চায়েত ভোটে প্রতিটা হিংসার, প্রতিটা রক্তপাতের, প্রতিটা রক্তবিন্দুর জন্য দায়ী থাকবেন আমাদের নির্বাচন কমিশনার, বলেছেন আমাদের রাজ্যের রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। এবং এসব বলার পরেই তিনি নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগপত্রটি সই না করে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। রাজ্য সরকার নাম প্রস্তাব করেছে, রাজ্যপাল তাতে সায় দিয়েছেন, রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে তিনি শপথ নিয়েছেন, কাজ শুরু করেছেন, নির্বাচনের দিনক্ষণের ঘোষণা করেছেন, ৭৩ হাজার পঞ্চায়েত আসনের জন্য দেড় লক্ষ বিরোধী সমেত মোট সওয়া দু’ লক্ষের বেশি মনোনয়ন জমা পড়েছে। আট তারিখে ভোট, রাজ্যপাল নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগপত্র ফিরিয়ে দিয়েছেন। পণ্ডিতেরা বসে আলোচনা করছেন এই নিয়োগপত্র সই না করে ফেরত দেওয়ার ফলে কি নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ বাতিল হয়ে গেল? আর নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগই যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে তো নির্বাচন প্রক্রিয়াও বিশ বাঁও জলে, তাহলে নির্বাচন প্রক্রিয়াই তো অবৈধ, তাহলে নির্বাচন বাতিল, সওয়া দু’ লক্ষ মনোনয়নও বাতিল, তাহলে অন্য আরেকজনকে নিয়োগ করা হবে, তিনি আবার দিনক্ষণ ঘোষণা করবেন, আবার মনোনয়ন দেওয়া হবে। সেই কবে থেকেই বিশেষ করে আমাদের রাজ্যে নির্বাচনে রক্ত ঝরে, মানুষ মরে, সব জমানায়, সব জমানাতেই ভোট লুঠের গল্প আছে, তাহলে এই নতুন কমিশনার আসার পরে ফুল ফুটিবে কোকিল কুহুরব করিবে তেমন তো নয়, মানে বলতে চাইছি আবারও তো মনোনয়ন নিয়ে ঝামেলা মৃত্যু হতেই পারে। তাহলে কি আবার নির্বাচন বাতিল হয়ে যাবে? অবস্থাটা প্রায় সেইরকম আর সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, পঞ্চায়েত ভোট আদৌ হবে?
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্যই এই পঞ্চায়েতের ধারণার জন্ম তা তো নয়, ভারতবর্ষের গ্রামীণ সামাজিক ব্যবস্থার অঙ্গ হিসেবেই ছিল গ্রামের পাঁচ অভিজ্ঞ, জ্ঞানী মানুষের এক সম্মিলনী, যেখানে মানুষ আসতেন নির্দেশ নিতে, সমস্যার সমাধান করতে। বহু পরে আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোর এক্কেবারে তলার সারিতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রশাসনিক কাঠামো হয়ে দাঁড়াল আজকের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। আমদের রাজ্যের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয় বাম আমলে, কিছুদিন পরেই প্রত্যেক রজনৈতিক দল বুঝতে পারে পঞ্চায়েত দখলে থাকলেই রাজ্য দখলে থাকবে, আর সেই জন্যই পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধেকে ঘিরে দলীয় আনুগত্য তৈরি হয় ওই বাম আমল থেকেই। কাজেই যারা অনুগত নয় আর যারা অনুগত তাদের মধ্যে বিরোধ বাড়তে থাকে, ক্রমশ তা রক্তক্ষয়ী হয়ে ওঠে। ২০০৮-এ পঞ্চায়েত ভোটে ৭০ জনের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল, ২০০৩-এ ১১ শতাংশ আসনে কোনও নির্বাচন হয়নি। বাম জমানার অবসানের পর কি ছবি বদলেছে? না, এক্কেবারেই না। বরং আমরা ২০১৮তে দেখেছিলাম ৩৪-৩৫ শতাংশ আসনে কোনও নির্বাচনই হয়নি। এবার ছবিটা অপেক্ষাকৃত ভালো, কিন্তু একেবারে হিংসা থাকবে না, কেন্দ্রীয় বাহিনী এলেই হিংসা থেমে যাবে, নির্বাচন কমিশনার পাল্টে দিলেই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবে, এমন ভাবার কোনও কারণ আছে কি?
আরও পড়ুন: Aajke | ২০১৮-র মতো ভোট হবে না, বলেছিলেন অভিষেক, বাস্তবে কী হল?
সমস্যার গভীরে না গিয়ে রাজ্যপাল যে রাজনীতি করছেন তাকে ছেলেমানুষি বললেও কম বলা হবে। অন্যদিকে আদালতেরও কিছু রায় এসেছে, আদালতেই প্রশ্ন উঠছে, বিচারক প্রশ্ন করছেন, তাহলে নির্বাচন কি হচ্ছে? নির্বাচন কি করা যাবে? তাঁরা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন কত কেন্দ্রীয় বাহিনী আনতে হবে, এদিকে দিল্লির সরকার অতজন দিতে পারবে না জানিয়েছে, তাহলে কি আদালত অবমাননা হবে? তাহলে কি এই ইস্যুতে নির্বাচন বাতিল হবে? আদালত নির্দেশ দিয়েছে, ৬১৩৬৬টা বুথে ৪টে করে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাতে হবে, ৮ জুলাইয়ের মধ্যে লাগানো সম্ভব? যদি না লাগানো হয়, তাহলে কি নির্বাচন হবে না? তাহলে মোদ্দা ব্যাপার যা দাঁড়াচ্ছে, তাতে নির্বাচন হওয়া নিয়েই রাশি রাশি প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে রাস্তা দেওয়া গেছে? স্কুলে মিড ডে মিল চলছে? কৃষক সমিতিতে কম দামে বীজ সার পাওয়া যাচ্ছে? স্বাস্থ্যসাথীতে গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা হচ্ছে? গ্রামের মহিলারা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পেয়েছেন? প্রাণিবন্ধুরা আসছেন? এসব প্রশ্ন কি কোথাও শুনছেন? দেড় লক্ষ বিরোধী প্রার্থী অথচ গ্রামের উন্নয়ন বিকাশ নিয়ে আমরা দেড়খানা কথাও শুনতে পাচ্ছি না। বিরোধী নেতারা হয় আদালতে নাহলে রাজভবনে। এটা কি পরিকল্পনা করেই তৃণমূলকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা? আমরা মানুষকে প্রশ্ন করেছিলাম, ৮ জুলাই ভোট, আদালত আর রাজভবনে প্রশ্ন কেবল সিসিটিভি, কেন্দ্রীয় বাহিনী বা মনোনয়ন বা মনোনয়ন প্রত্যাহার নিয়ে। গ্রামের আলো, জল, রাস্তা, স্কুল, মিড ডে মিল, সরকারি প্রকল্প নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা কি শুনতে পাচ্ছেন? শুনুন মানুষ কী বলছেন।
বিরোধী দলের এক বিরাট অংশই লড়াইটা আদালত আর রাজভবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চায়, মূলত এ বাংলায় বিজেপি নেতাদের এটাই আপাতত কাজ। প্রতিটি বিষয়কে নিয়ে যাচ্ছেন আদালতে, বা রাজভবনে। কেন? কারণ এক, তাঁদের সংগঠন নেই কিন্তু তাঁদের খবরের কাগজের প্রথম পাতায় থাকতে হবে। দুই, এটা শর্টকাট পদ্ধতি, রোজ বয়ানবাজি চলবে আর রাজভবন তো সে কাজে হাত বাড়িয়েই রেখেছে। তিন হল একমাত্র মেঠো নেতা দিলীপ ঘোষকে টক্কর দিতে আদালত বা রাজভবনই শুভেন্দু সুকান্তের কাছে অনেক সেফ হেভেন। এরপর শুরু হবে নতুন আবেদনের পালা আমাদের প্রচার করতে দিচ্ছে না, তারপর আমাদের ভোট দিতে দিচ্ছে না এবং শেষে গণনাকেন্দ্রে কারচুপি। বিরোধিতার এক সহজ সরল ফর্মুলা। কিন্তু এই সহজ ফর্মুলায় আর যাই হোক তৃণমূলকে হারানো যাবে না, উলটে তাঁদের জায়গার অনেকটাই দখল নেবে বামদলগুলো।