যে কোনও দলেই দু’ ধরনের বিদ্রোহ, ক্ষোভ, বিক্ষোভ, দলত্যাগ ইত্যাদির ঘটনা থাকে। এক আদর্শগত, দুই ধান্দার জন্য, মানে পাতি নিজের আখের গোছানোর জন্য বিদ্রোহ, দলত্যাগ ইত্যাদি হয়। উপরে ওই আদর্শ ইত্যাদির মোড়ক দেওয়ার চেষ্টা হয় বটে কিন্তু মানুষ সেসব জানেন, বোঝেন। ধরুন অমন যে রাজপুত্র, মাধবরাও সিন্ধিয়া, দশ পুরুষ বসে খেলেও টাকা ফুরোবে না তিনিও যে স্রেফ মন্ত্রিত্ব আর ক্ষমতার লোভে দল ছেড়েছেন তা তো আমরা জানি। হরিয়ানাতে একসময় এক দিনেই বার তিনেক দলবদল করে ফেলেছিলেন এক রাজনৈতিক নেতা, রাজনৈতিক আলোচনায় সেই থেকে আয়ারাম গয়ারাম-এর প্রচলন। আদর্শের ভিত্তিতে দলত্যাগ বা দলে বিদ্রোহ হয়েছে, কিন্তু সেসব বড়ই প্রাচীন, পুরনো ঘটনা। ধরুন চন্দ্রশেখর বা মোহন ধারিয়া, কংগ্রেসের তরুণ তুর্কি। কিন্তু তাঁরা ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারি করার বিরোধিতা করেছেন, জানতেন তাঁদের জেলে পোরা হবে, তারপরেও প্রতিবাদ এবং জেল। বামফ্রন্টের সুবর্ণ সময়ে দল এবং মন্ত্রিত্ব থেকে সরে এসেছেন অশোক মিত্র বা শঙ্কর সেন, অন্য দলে যাননি, পদত্যাগ করে নিজেদের অবস্থানের কথা জানিয়েছেন দলকে, সাংবাদিক ডেকে নৌটঙ্কি করেননি। বিজেপির প্রথম সারি থেকে সরে গেছেন কে এন গোবিন্দাচারিয়া, দলের বিরুদ্ধে সমালোচনা আছে কিন্তু তা প্রকাশ্যে নয়, বা অন্য দলে যোগও দেননি। কিন্তু সেসব এখন অতীত, এখন বিদ্রোহের মধ্যে স্পষ্ট দেখা যায় লোভ, দেখা যায় ধান্দাবাজি, দেখা যায়, তা আরও ইন্টারেস্টিং হয়ে ওঠে যখন সে বিদ্রোহ হয় শাসকদলের মধ্যে। তো আজ সেই ‘বিদ্রোহ, বিদ্রোহ’ নৌটঙ্কিই বিষয় আজকে, তৃণমূলের বিদ্রোহী মুখ।
তা হলে প্রথম মুখ হুমায়ুন কবীর, না না, আইপিএস হুমায়ুন কবীর নয়, মুর্শিদাবাদের হুমায়ুন কবীর। ওনার রাজনৈতিক যাতায়াত খানিকটা এই রকমের— কংগ্রেস টু তৃণমূল, তৃণমূল টু কংগ্রেস, কংগ্রেস টু তৃণমূল, তৃণমূল টু বিজেপি এবং শেষে বিজেপি টু তৃণমূল। সিপিএম বা আর এসপিতে যান নি, সম্ভবত তাঁরা নেয়ওনি। মাঝেমধ্যেই কিছু না পেলেই তিনি দল বদলান। আপাতত তিনি আবার সেই বিদ্রোহের মুখ। দল ছাড়ব, পদত্যাগ করব বলার পরেই বুঝেছেন, হাওয়া তাঁর দিকে নেই, সঙ্গে সঙ্গে আবার পাল্টি, জানিয়েছেন, যা বলেছি ভুল বলেছি, আর ভুল বলিব না। মানে ওনার বিদ্রোহের এবারের সময়কাল ছিল পাক্কা এগারো ঘণ্টা। তো এহেন হুমায়ুন কবীরের পরের নাম হল মনোরঞ্জন ব্যাপারী, বাতাসে বারুদের গন্ধ। লেখালেখি করতেন, রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তাও নিশ্চয়ই ছিল, ক্ষিতি গোস্বামী মহাশ্বেতা দেবীর অনুরোধেই একটা রাঁধুনির চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিলেন, সেখানে হাতা খুন্তি নিয়ে সাহত্যিকের ছবি আমরা দেখেছি।
আরও পড়ুন: Aajke | পঞ্চায়েত, কোর্টে জিতল বিরোধীরা, মাঠে জিতবে কে?
তারপর পরিবর্তন এল, তাঁকে লাইব্রেরিতে চাকরি দেওয়া হল। ২০২১-এ বিধায়ক হিসেবে দাঁড় করানো হল, তিনি জিতলেন, এরপর তাঁকে দলিত সাহিত্য আকাদেমি তৈরি করে তার মাথায় বসানো হল। এই পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তাঁর নিজের উইশ লিস্ট ছিল, মানে তিনি চেয়েছিলেন তাঁর লিস্টের কিছু মানুষ টিকিট পাক। পায়নি। অতএব তিনি বিদ্রোহী। এর আগে ২০১৮তে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের গুন্ডামি তিনি দেখেননি? দেখেছেন। শিক্ষা দুর্নীতিতে তৃণমূলের ভূমিকা তিনি দেখেননি? দেখেননি পার্থ-বান্ধবীর বাড়ি থেকে কোটি টাকা উদ্ধারের ছবি? তিনি কি বিচলিত হয়েছেন? না, তেমন খবর আমাদের কাছে নেই। এবারে বিচলিত মনোরঞ্জন জানিয়েছেন যে তিনি দলের যাবতীয় পদ থেকে পদত্যাগ করছেন, কিন্তু জানাননি যে ওই দলের মন্ত্রীর দেওয়া চাকরির পেনশনটা কেন তাঁর দরকার? জানাননি ওই দলেরই নির্দেশে দলিত সাহিত্য আকাদেমির মাথায় বসে থাকা পদটা তিনি ছেড়ে দিচ্ছেন কি না। তবে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, পেটের তাগিদেই বিধায়ক পদ থেকে তিনি ইস্তফা দিচ্ছেন না। এর আগেও বারদুয়েক তিনি প্রকাশ্যেই দলের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন বটে, তবে তার সবটাই স্থানীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। এবারেও তাঁর বিদ্রোহে কোথাও অভিষেক বা মমতার নাম নেই, মানে খুঁটি বাঁচিয়েই বিদ্রোহের ধ্বজা তুলেছেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী। দেখা যাক এ বিদ্রোহ কতদূর এগোয়। কিন্তু আমরা মানুষের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, ঠিক এই সময়ে রাজনৈতিক দলবদল বা দল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার যে ঘটনা আমাদের সামনে আসছে তা কি আদর্শের ভিত্তিতে না কি তা নিছকই ধান্দাবাজি? শুনুন মানুষ কী বলছেন।
এক অদ্ভুত আঁধার নেমেছে পৃথিবীতে। আদর্শ, নীতি, নৈতিকতা সব একে একে গড়ের মাঠে ঘোড়া বা খচ্চরদের সঙ্গে ঘাস খেতে চলে গিয়েছে। যাদের হাতে দেশ, তাদের কোনও কথাই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। তাঁদের প্রতিটা কথায় থাকে সূক্ষ্ম প্যাঁচপয়জার, সেসব বাক্য মাণিক্য থেকে ঝরে পড়ে লোভ, লালসা আর ধান্দার টুকরো। অথচ তারাই আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি, আমরা এই মহান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাদের হাতেই তুলে দিয়েছি দেশ চালানোর দায়িত্ব। কিন্তু প্রবঞ্চনার, ঠকে যাওয়ারও তো এক সীমা আছে? মানুষ ঠকতে ঠকতে ঠকতে যেদিন মিথ্যেগুলোকে ধরে টান দেবে, সেদিন লন্ডভন্ড হবে এই ব্যবস্থা। ততদিন চলুক এই বিদ্রোহ বিদ্রোহ খেলা, নৌটঙ্কি।