এখনও অন্তত দুটো বগি পড়ে আছে, যেখানে হাত পড়েনি। পড়েনি কারণ সেখানে কারও বেঁচে থাকার সম্ভাবনাই নেই। রেলমন্ত্রী, রেলমন্ত্রকের আপাতত প্রথম কাজ হল, রেললাইন সাফ করে রেল চলাচল শুরু করানো। এতদিন মৃত আর আহতের সংখ্যা বাড়ছিল, এখন নিখোঁজের সংখ্যা বাড়ছে। রেলমন্ত্রী সেই দুর্ঘটনার পরের দিন থেকে আজ পর্যন্ত ওখানেই আছেন, থ্যাঙ্ক গড দেশের মানুষ জানতে পেরেছেন, দেশের রেলমন্ত্রী নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি নন, দেশের রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব নামের এক প্রাক্তন আমলা। এবং কেউ কেউ এটাও জানতে পেরেছেন যে এই অশ্বিনী বৈষ্ণব ওড়িশা থেকেই রাজ্যসভা সদস্য হিসেবে সংসদে গিয়েছেন। কিন্তু এই দুধুভাতু মন্ত্রীকে পেছনে রেখে দেশের প্রধানমন্ত্রীই হয়ে উঠেছিলেন ডিফ্যাক্টো রেলমন্ত্রী, রেলের উন্নয়ন, নতুন সুরক্ষা ব্যবস্থা, নতুন কোচ ইত্যাদি নিয়ে যা যা বাওয়াল আপনারা শুনেছেন তার প্রায় সবটাই মোদিজিই বলেছেন। এ পর্যন্ত যতগুলো বন্দে ভারত ট্রেন চলেছে, সবকটার হরি ঝন্ডি দেখিয়েছেন তিনিই। ছবিটা দেখে নিন। (https://youtu.be/YhY6unb8UMk)
আমি যতক্ষণ আজ এই দুর্ঘটনা নিয়ে কথা বলব, ততক্ষণ আমার পাশে উনি এই হরা ঝান্ডা দোলাতেই থাকবেন, এটা বোঝাতে যে, আজ যা যা প্রশ্ন আমরা তুলব তার উত্তর এই মোদিজিকেই দিতে হবে, ঝান্ডা দেখানোর বেলায় উনি, ফটো তোলাবার বেলায় উনি আর মৃতদেহ গোনার জন্য অশ্বিনী বৈষ্ণব তা তো হতে পারে না। কাজেই আমাদের আজকের তোলা যাবতীয় প্রশ্ন নরেন্দ্র মোদিজিকেই উদ্দেশ্য করে, এবং উত্তরও আমরা ওনার থেকেই চাইব। প্রথম বিষয় হল ওনার সবকা সাথ সবকা বিকাশ, তো ওনার সরকার ২০১৪তে ২০ কিলোমিটার সেকেন্ড ক্লাসে রেল সফরের জন্য কত টাকা নিতেন? ৫ টাকা। হ্যাঁ, নেহেরুর সময় নয়, ২০১৪তে আসার পরে প্রথম রেল বাজেটের কথাই বলছি। এই যে পাশে দাঁড়িয়ে যিনি হরা ঝান্ডা দেখাচ্ছেন, ওনার রাজত্বকালের প্রথম বছরে ২০ কিলোমিটার যেতে ৫ টাকার টিকিট কাটতে হত। ২০২৩-এ কত টাকার টিকিট লাগে? ওই সেকেন্ড ক্লাসে ২০ কিলোমিটার যেতে এখন লাগে ৪০ টাকা। উনি কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন, যা এখনও অধরা, সেই তিনিই রেল টিকিটের দাম বাড়িয়েছেন ৮ গুণ। এই হল ওনার সবকা সাথ সবকা বিকাশ। দেশের সাধারণ মানুষ তো সেকেন্ড ক্লাসেই যায়, তাঁরা আট গুণ বেশি ভাড়া দিচ্ছেন। ওই যে বললাম দুটো বগি এখনও পড়ে আছে, ওগুলো ওই জেনারেল কম্পার্টমেন্ট সেকেন্ড ক্লাস বগি। ট্রেনের সামনের দিক, মানে ইঞ্জিনের পরেই থাকে ওই জেনারেল কম্পার্টমেন্ট, আর শেষের দিকেও থাকে। মানে ধাক্কা যে ধার থেকেই আসুক, মরবে ওই সেকেন্ড ক্লাস জেনারেল কম্পার্টমেন্টের মানুষ। যাঁরা আপাতত আটগুণ ভাড়া দিয়েই ট্রেনে চড়ছেন।
দ্বিতীয় বিষয় হল বেসরকারিকরণ। না এই বেসরকারিকরণ মোদিজির সময়ে নয়, কংগ্রেস আমলেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু তা ছিল ক্যাটারিং-এর বেসরকারি করণ, প্রিন্টিং প্রেসের বেসরকারিকরণ, কনজারভেন্সি, মানে সাফ সাফাইয়ের কাজের বেসরকারিকরণ ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু মোদিজি দায়িত্ব নেওয়ার পরে? গোটা ট্রেনও তুলে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি মালিকদের হাতে। মানে আমরা রেলপথ দিয়েছি, এবার আপনারা রেল চালান, যাত্রী সুরক্ষা মায়ের ভোগে। এরপর রেলের আরও কিছু দফতর, সিগন্যালিং থেকে ট্র্যাক মেনটেনেন্স দিয়ে দেওয়া হল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে। এরসঙ্গে যোগ হল আরও আরও দ্রুত গতি ট্রেন চালানোর গিমিক। এরই মধ্যে করোনা এবং টুক করে তুলে নেওয়া হয়েছে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য দেওয়া ছাড়, করোনা চলে গেছে, দেশের প্রবীণ মানুষেরা সেই ছাড় ফেরত পাননি। কিছুদিন আগে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে ছাড় ফেরানোর কোনও পরিকল্পনাও সরকারের নেই। এদিকে উনি মাঝে মাঝেই ওনার অশীতিপর মায়ের পা ধুয়ে দিয়েছেন, সেসব করার সময়ে আলাদা টিম নিয়েও গিয়েছেন, ছবি উঠেছে, মানুষকে বোঝানো হয়েছে যে উনি মাতৃভক্ত, প্রবীণদের সম্মান দেন। আসলে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী ফটো অপরচুনিটি চান, মানে তাঁর ফটো উঠবে, লোকে দেখবে, ব্যস। এর জন্য তিনি একলা গুহায় ধ্যান করেন, সামনে কম সে কম ১০০ ক্যামেরা, মন্দির প্রদক্ষিণ করেন, রেলের ঝান্ডা দেখান, এমনকী দুর্ঘটনাস্থলে আসেন, ওই ফটো অপরচুনিটির জন্যই। ক্যামেরা তুলে নিন, উনি হরগিজ যাবেন না, ছবিই না উঠলে গিয়েই বা কী লাভ?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | নেতাজিকে অপমান দেশের মানুষ মেনে নেবেন?
এরপরে আসুন সিএজি রিপোর্টে। গতবছর সেপ্টেম্বর মাসে সংসদে এই সিএজি রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছিল, রেললাইন পরিদর্শনের কাজে ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত গাফিলতি রয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ট্রেন বেলাইন হওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪২২টা। ৮৪ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে পয়েন্ট ঠিক জায়গায় না থাকার জন্য। আচ্ছা এই পয়েন্টটা কী? রেলের লাইন সমান্তরালভাবে চলে, আবার তার সঙ্গেই সোজা যেতে যেতে ডানে বা বাঁয়ের লাইনে চলে যায়, যেখান থেকে সেই লাইনকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়, সেটাকে পয়েন্ট বলে। খানিকটা এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে সোজা আসার সময়ে একটা সার্ভিস রোডে নেমে আসা বা সার্ভিস রোড থেকে বড় রাস্তায় উঠে পড়া। তো বেলাইন হওয়ার কারণ হিসেবে ৮৪ শতাংশ হল এই পয়েন্ট এর গন্ডগোল, সিএজি রিপোর্ট জানাচ্ছে। এবং এই দুর্ঘটনার পরে রেলের দুই আধিকারিকের কথা আমরা সবাই ইতিমধ্যে শুনেছি, সেখানে সাফ বলা হয়েছে পয়েন্ট গাড়িকে লুপ লাইনে ঠেলে দিয়েছে, মানে সিগনাল একদিকে আর পয়েন্ট আরেকদিকে ছিল। ওই সিএজি রিপোর্ট আরও জানাচ্ছে যে ৪২২টা দুর্ঘটনার ১৭১টা ঘটেছে রেললাইন দেখরেখে ভুল থাকার জন্য, ২১১টার জন্য দায়ী ছিল সিগনালিং ফেলিওর, সিগনাল কাজ করেনি। দুর্ঘটনার পরে ৩৫০টা দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার কথা ছিল, ১৮১টা পরিদর্শন করা হয়েছে, যেগুলো করা হয়েছে তার আবার ৬৩ শতাংশ রিপোর্ট জমাও পড়েনি, যে রিপোর্ট জমা পড়েছে তার ৪৯ শতাংশ ক্ষেত্রে তদন্তের পরে যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তা নেওয়া হয়নি। কে বলছে এসব? সিএজি রিপোর্ট, কোথায় এই রিপোর্ট জমা পড়ছে? সংসদে। রেলমন্ত্রী দফতরের মিটিংয়ে আর কোথা থেকে রোজগার হবে তা জানতে চাইছেন। এবং অন্য যা জানতে চাইছেন তা হল আর কোথায় কোথায় বন্দে ভারত চালানো যায়? কারণ মোদিজি ছবি তুলবেন, হরা ঝান্ডা দেখাবেন। ২০১৭ -১৮ সালে এক রেল সুরক্ষা ফান্ড তৈরি হয়েছিল, এক লক্ষ কোটি টাকার ফান্ড, তার ৫০ শতাংশও খরচ হয়নি, কারণ মোদিজিকে দ্রুতগামী ট্রেন চালাতে হবে। কলকাতা-বোলপুর সফরের জন্য আপনি এসি চেয়ার কারে ৩১৫ টাকা দিতেন, এখন বন্দে ভারতে সেই এসি চেয়ার কারের জন্য ৬৫০ টাকা দেবেন, সঙ্গে দু’ পিস কাঁচা পাউরুটি আর একটা ওমলেট, গুনে গুনে ৪টে আলুভাজা আর ৩টে কড়াইশুঁটি ফ্রি। ওনার মাথায় এখন বুলেট ট্রেন, দ্রুতগামী ট্রেনই শুধু নয়, আসল কথা হল দেশের উচ্চমধ্যবিত্ত আর বড়লোকদের জন্য যাতায়াতের ব্যবস্থা। রোজ নতুন ট্রেন চালু করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ৩ ঘণ্টা চার ঘণ্টা কম সময় নেবে। চাপটা ভাবুন? একট বন্দে ভারত ট্রেন কতগুলো ট্রেনের ড্রাইভার, রেল সিস্টেমের ওপর কতটা চাপ ফেলছে। একটা গাড়ি দ্রুত গেলে অন্যদেরও তো দ্রুত যেতে হবে। ড্রাইভাররা ছুটি পাচ্ছেন না, কর্মচারীদের কাজের সময় বাড়ছে। নতুন রিক্রুটমেন্ট নেই। রেলে গার্ড, ড্রাইভার, ট্রাফিক অ্যাসিসট্যান্ট, স্টেশন মাস্টার ইত্যাদি পদে ৩ লক্ষ ১১ হাজার পদ ফাঁকা পড়ে আছে। ১৮ হাজার গেজেটেড অফিসারদেরও ৩০০০-এর বেশি পদে লোক নেই। একজন স্টেশন মাস্টার বেড়েছে, তিনি এই যে আমার পাশে সবুজ ঝান্ডা নাড়িয়েই চলেছেন। লোকাল ট্রেনের অবস্থা দেখুন, মানুষ ঝুলছে সেখানে। প্যাসেঞ্জার ট্রেনে টয়লেটে যান, নরক হয়ে রয়েছে, উনি বন্দে ভারতে বায়ো টয়লেট বসাচ্ছেন, কাদের জন্য? এই প্রায় তিন শত মানুষকে আসলে খুন করা হল, ঠান্ডা মাথায় খুন করা হল, সিএজি রিপোর্ট তো তাই বলছে। রেলে দুর্ঘটনা হয় কেন? এক কথায় তিনটে কারণ, কর্মচারীদের গাফিলতি, দু’ নম্বর হল অন্তর্ঘাত, আর তিন নম্বর হল প্রশাসনিক ব্যর্থতা।
বুঝিয়ে বলি, কেউ যদি লাইন, ফিসপ্লেট খুলে দিয়ে থাকে, লাইন উড়িয়েই দেয়, তাহলে তো দুর্ঘটনা হবেই, এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো খুব শক্ত। এটা হল অন্তর্ঘাত। দ্বিতীয়টা হচ্ছে কর্মচারীদের, ঠিক করে রেল ট্র্যাক চেক না করা, সিগন্যাল সিস্টেমে নজর না রাখা। এখন সারা পৃথিবীতেই রেল চলাচলের জন্য অনেক বেশি বেশি আধুনিক ব্যবস্থা, অটোমেটিক সিগন্যালিং সিস্টেম ইত্যাদি কাজে লাগানো হচ্ছে যাতে হিউম্যান এররকে সামাল দেওয়া যায়। কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ হল প্রশাসনিক ব্যর্থতা। শূন্যপদের সংখ্যা বাড়ছে, কাজের চাপ বাড়ছে, লাইন বা বাকি ইনফ্রাস্ট্রাকচারের তুলনায় ট্রেন বাড়ছে। রাজনৈতিক গিমিকবাজি, রোজ নতুন ট্রেন চালু হচ্ছে, এখন তো আবার সুপার ফাস্ট বুলেট ট্রেন। ওদিকে সেগুলো চালানোর ইনফ্রাস্ট্রাকচার নেই। কাজেই অ্যাক্সিডেন্ট হচ্ছে। আর এই প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে বিরাট বিরাট অ্যাক্সিডেন্টকে হয় কর্মচারীদের গাফিলতি নাহলে ওই অন্তর্ঘাত বলে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে। গিমিকবাজি বন্ধ না করলে এরকম অ্যাক্সিডেন্ট আরও হবে। ইতিমধ্যেই রেলমন্ত্রী তাঁর প্রাথমিক তিনবারের মত পাল্টে জানিয়েছেন চতুর্থ সম্ভাবনার কথা, অন্তর্ঘাতের কথা, মানে সব দায় ঝেড়ে ফেলে এক অদৃশ্য শত্রুর দিকে আঙুল তোলা। হাতে আছে সিবিআই, তদন্তে পাঠিয়ে দাও, তদন্ত হতেই থাকবে, ততদিন পর্যন্ত বিজেপির নেতা মন্ত্রী এবং নরেন্দ্র মোদি এই দুর্ঘটনাকে অন্তর্ঘাত বলতে থাকবেন, দোষ ওনাদের নয়, দোষ পাকিস্তানের কিংবা আল কায়দার অন্তত মাওবাদীদের। এক অরাজকতার দিকে দেশকে নিয়ে চলেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী, এই অরাজক অবস্থার জন্য দায়ি উনি, ওনার দল। কিন্তু বলি হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ, যাঁরা আপাতত লাশ, নিথর দেহ মাত্র। গিনতি বেড়েই চলেছে।