অনুরাগ ঠাকুরের নামের পিছনে তো ঠাকুর আছে, তাই বলে তিনি কি কবি হয়ে উঠবেন? যে একটি ছড়া লিখেছেন, ওই গোলি মারোঁ শালোঁ কো ইত্যাদি, তা ভাইরাল হয়েছে বটে তবে তা কবিতা হয়ে তো ওঠেনি। ঠিক সেইরকম নামের পেছনে বোস থাকলেই তো নেতাজি হওয়া যায় না, নামের পেছনে বোস নিয়েও এক মানুষ স্বৈরাচারী হয়ে উঠতেই পারেন, হয়েই উঠতে পারেন ধনখড় সাহেবের সমকক্ষ বা তাঁর থেকেও বড় কিছু। কারণ এই রাজ্যপাল পদে বসানো হয় হিস মাস্টার্স ভয়েজদেরকেই। এবং তাদের মধ্যে থেকেই বেছে নেওয়া হতে পারে কোনও এক বা দুজনকে যাঁদেরকে আরও বড় পদের জন্য বাছাই করা হবে, কাজেই আপাতত যিনি জি হুজুর তাঁকে রাজ্যপাল করা হল, তারপর তিনি আরও লালায়িত হলে এবং নিজের উপযোগিতা প্রমাণ করতে পারলে আরও বড় উচ্চতায় যেতে পারবেন। অতএব আসনে বসেই তাঁরা নিজেদের আনুগত্য প্রমাণ করার কাজে নেমে পড়েন। এক অ্যাপেন্ডিক্স-এর মতো শরীরের অংশ, যা মাঝেমধ্যে প্রবল ব্যথার কারণ হতে পারে, আর কেটে দিলে শরীরের কিছুই এসে যায় না, তেমনিই রাজ্যপাল নামক পদ মাঝেমধ্যে বা ক্রমাগত এক নির্বাচিত সরকারের কাজে বাগড়া দেওয়ার কাজ চালাতেই থাকে, যে পদ উঠে গেলে কারও কিচ্ছু যাবে আসবে না। সেই কবেই আন্নাদুরাই বলেছিলেন রামছাগলের কাছে তার দাড়ি যতট জরুরি, ততটাই জরুরি দেশের এই রাজ্যপাল পদ। আপাতত বাংলার রাজ্যপাল আবার শিরোনামে। তাই বিষয় আজকে ধনখড়ের পথেই বাংলার রাজ্যপাল।
বাংলার নতুন রাজ্যপাল আনন্দ বোস কিন্তু শুরুতেই তাঁর কাজকর্ম নিয়ে নেমে পড়েননি। বরং উল্টোটা। মুখ্যমন্ত্রী হাতেখড়ি দিচ্ছেন, শিক্ষামন্ত্রীর এবং রাজ্যপালের যৌথ খামারের মতো যৌথ হাসির ছবি তো আমরা দেখেছিলেম। কিন্তু সে সব ছবি আপাতত ছবি শুধু পটে লেখা, স্মৃতির ঝোলায়। কারণ সম্ভবত কাঁথির খোকাবাবু। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, দিচ্ছিলেন, না না না, এ আবার কী? রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এমন হাসিখুসি কেন? কেন টুইট আসছে না ঘনঘন? কেন তিনি শিউরে শিউরে উঠছেন না আইন শৃঙ্খলার হাল দেখে? কেন তিনি তাঁর অসন্তোষ প্রকাশ করছেন না প্রত্যেক বিষয়ে? কেন তিনি ক্রমাগত চাপ তৈরি করছেন না আমলাদের ওপর? মোদ্দা কথা হল কেন তিনি এক নির্বাচিত সরকারকে অপদস্থ করার, ফেলে দেওয়ার বিরাট ষড়যন্ত্রের হিসসেদার হয়ে উঠছেন না? হ্যাঁ শুভেন্দু অধিকারী এসব প্রশ্ন নিয়েই বেজায় নারাজ ছিলেন রাজ্যপালকে নিয়ে। তো এতদিনে গাছে ফল ধরেছে, উনি কাজ শুরু করেছেন।
আরও পড়ুন: Aajke | ‘জনজোয়ার’-এর পাল্টা রোড শো, চাপে কাঁথির খোকাবাবু?
রামনবমী, হনুমান জয়ন্তীতে হনুমানেরাও গোলযোগ বাঁধাল, উনিও ছুটে গিয়ে উদ্বেগ জানালেন, কিন্তু উদ্বেগে ফল দিল না। কাজেই শিক্ষা, এমনিতেই শিক্ষা ব্যাপারটা এ রাজ্যে বেশ বিতর্কের, দুর্নীতির আখাড়া বললেও কম বলা হয়, তো সেদিকটা তো আদালত, ইডি, সিবিআই দেখছে, আমাদের আনন্দ বোস সাহেব উচ্চশিক্ষা নিয়ে পড়লেন। উপাচার্য নিয়োগের সাধারণ চলতি নিয়মকে তাকে রেখে নিজেই জানিয়ে দিলেন এই ভিত্তিতে এনাদের উপাচার্য বানানো হল। সাহেব এ রাজ্যের একটা গ্রাম পঞ্চায়েতে দাঁড়ালে জামানত জব্দ হবে, নোটার চেয়েও কম ভোট পাবেন, তিনি নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা না করেই নিজের ক্ষমতা জাহির করছেন, কেন? ওই যে ভিমরুলের মতো উড়তে হবে, কামড়াতে হবে। ভিমরুল কেন কামড়ায়, তার তো বিশেষ কারণ থাকে না, তার হুল আছে বিষ আছে, যাকে পাবে তাকে কামড়ানোর অধিকার আছে। কিন্তু রাজ্যপাল হল রিমোট কন্ট্রোলড ভিমরুল, ওপার থেকে নির্দেশ আসছে, উনি তা তামিল করছেন। রাজ্যপাল সিদ্ধান্ত নেবেন নির্বাচিত মন্ত্রিসভার সঙ্গে পরামর্শ করে, এই বেসিক নিয়মটাকেই বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে বার বার। এবং তাই বিরোধীরা, মানে যে যখন বিরোধী ছিলেন তাঁরাই, বিরোধিতা করেছেন রাজ্যপালের এই নোংরা ভূমিকার। এমনকী নরেন্দ্র মোদিও, তিনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন রীতিমতো বিরোধ বেঁধেছিল রাজ্যপালের সঙ্গে। তিনিই চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, রাজনৈতিক কারণে রাজ্যপালকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই কবেই দেশের প্রথম কেরলের কমিউনিস্ট সরকার ভাঙা হয়েছিল ওই রাজ্যপালের সুপারিশে। আমরা মানুষের কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, এক নির্বাচিত সরকারের কাজে ক্রমাগত বাধা দিতে থাকা এই রাজ্যপাল পদটা তুলে দেওয়াই কি উচিত নয়? মানুষ কী বলছেন শোনা যাক।
রাষ্ট্রপতি পরোক্ষভাবে নির্বাচিত, প্রধানমন্ত্রী থেকে বাকি মন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীরা নির্বাচিত, বিচারকদের নিয়োগ পদ্ধতি আছে, আপনি চাইলেই তো কাউকে বিচারক করা যায় না, বাকি বিভিন্ন পদের যোগ্যতার মাপদণ্ড আছে। কিন্তু এই রাজ্যপাল, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ। দিল্লিতে ফেডারেল সরকারের যাকে মনে হবে সেই রাজ্যপাল, কাজেই এত বিশাল মাইনে, পদ, সুযোগ সুবিধে, বিশাল বাংলো, সব মিলিয়ে এক দুর্দান্ত প্যাকেজের বিনিময় মূল্য তো থাকবেই। কিন্তু আমজনতার পয়সায় এই অপ্রয়োজনীয়, অগণতান্ত্রিক পদকে নিয়ে ভাবার সময় এসেছে, এই পদের অপব্যবহারই এই চিন্তার অন্যতম কারণ।