সাহিদুলের মন কি বাত শুনলেন না মোদিজি। সাহিদুল প্রত্যাখ্যান করলেন রাজ্যপালের দেওয়া সন্মান এবং উত্তরীয়। কে সাহিদুল? অনেকেই জানেন, অনেকেই জানেন না, তাই একটু পরিচয় দেওয়া যাক, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পুরি গ্রামের বাসিন্দা সাহিদুল পেশায় ট্যাক্সি ড্রাইভার। তিনটে ট্যাক্সি ছিল, তিনি প্রায় বিনা চিকিৎসায় তাঁর বোনের মারা যাওয়ার পরে একটা হাসপাতাল তৈরি করেছেন। তিনটে ট্যাক্সির মধ্যে দুটো বেচে দিয়েছেন, নিজের আয়ের পয়সা ঢেলেছেন, আরও কিছু মানুষজন এগিয়ে এসেছেন, হাসপাতালের আউটডোরের কাজ শুরু হয়েছে। সেই সাহিদুল লস্কর গতকাল আমন্ত্রিত ছিলেন রাজভবনে। নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদিজির মন কি বাত অনুষ্ঠানের ১০০তম পর্ব প্রচারিত হবে সেই উপলক্ষে সাহিদুল ইসলাম, রুদ্রনীল ঘোষ সহ আরও কিছু মানুষ হাজির ছিলেন রাজভবনে। তাঁদের সম্বর্ধনা দেওয়া হবে, রাজ্যপাল নিজে পরিয়ে দেবেন উত্তরীয়। সেই অনুষ্ঠানে রুদ্রনীল ঘোষের চোখের সামনেই সাহিদুল দেখালেন তাঁর রিড় কি হাড্ডি, তাঁর শিরদাঁড়া। তিনি বললেন, আমিও আমার মন কি বাত প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, সেই সুযোগ পাইনি তাই এই উত্তরীয় আমি প্রত্যাখ্যান করছি। দৃশ্যটা ভাবুন, রাজ্যপাল মঞ্চে, সাহিদুল লস্করের নাম ডাকা হয়েছে, তিনি মঞ্চে উঠেছেন। রাজ্যপাল উত্তরীয় পরাতে গেলেন, সাহিদুল হাতজোড় করে তা প্রত্যাখ্যান করলেন। শুধু তাই নয়, খোলা গলাতেই জানালেন, তাঁকে দু’ দু’ বার উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দিল্লিতে, একবারও তিনি সুযোগই পাননি মন কি বাত মোদিজিকে বলার। কেবল আমলারা তাঁর এই হাসপাতাল তৈরির ইচ্ছে নোটপ্যাডে টুকে নিয়েছেন, মোদিজি সেই লিখিত স্ক্রিপ্ট পড়ে দিয়েছেন, কিন্তু ওয়ান ওয়ে কমিউনিকেশনে বিশ্বাসী মোদিজির সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই সাহিদুল লস্করের কথা হয়নি। তিনি ভেবেছিলেন অন্তত ১০০তম এই অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর মন কি বাত খুলে বলতে পারবেন, এখানেও সেই সুযোগ নেই দেখে তিনি হাতজোড় করে রাজ্যপালকে জানান তিনি এই উত্তরীয় প্রত্যাখ্যান করছেন, তিনি খালি গলাতেই সেই কথা উপস্থিত দর্শকদের জানান।
সাহিদুল যখন তাঁর শিরদাঁড়া সোজা করে প্রতিবাদে শামিল, তখন জানতে মন চায় আমাদের সাতে পাঁচে নেই দাদা রুদ্রনীল ঘোষ তাঁর হারিয়ে যাওয়া শিরদাঁড়ার কথাই কি ভাবছিলেন? কারণ অনুষ্ঠানের আগেই রুদ্রনীল কোট আনকোট যশস্বী প্রধানমন্ত্রীর এই ১০০তম মন কি বাতের যে বিরাট সফলতা তা নিয়ে আমাদেরও বাইট দিয়েছেন। আচ্ছা বিরাট সফল এই মন কি বাত দেখেছেন ক’জন? শততম অনুষ্ঠান যাতে মানুষ দেখেন তার জন্য বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব নির্দেশ জারি করেছিলেন, সর্বত্র এই অনুষ্ঠান মানুষকে শোনাতে হবে। না, সেরকম কোনও প্রচেষ্টা আমাদের চোখে পড়েনি, একমাত্র রাজভবনে এক বিরাট আয়োজন করা হয়েছিল, যাকে আমাদের রাজ্যপাল বলেছেন অমৃতকালে অমৃত বচন। মানে আমরা যে সময়ে আছি সেটা অমৃতকাল আর ১০০তম মন কি বাত-এ মোদিজি যা বলেছেন তা হল অমৃত। আসছি সে আলোচনাতেও। ১০০তম মন কি বাত আবার কেবল ভারতীয় ২২টা ভাষাতেই নয়, ফরাসি, চিনা, ইন্দোনেশিয়ান, টিবেটান, বার্মিজ, বালুচি, আরবি, পশতু, পারসিয়ান, দারি এবং সোয়াহিলি ভাষাতেও অনুবাদ করে প্রচার করা হয়েছে। এই ১০০তম অনুষ্ঠান ক’জন শুনল তার সঠিক হিসেব আমাদের কাছে নেই, নিশ্চয়ই পরে তা পাওয়া যাবে। কালকেরটা বাদই দিলাম, এমনিতে এই অনুষ্ঠান দেখে ক’জন সেটা নিয়ে কটা কথা বলে নিই।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | কেজরিওয়ালের বাড়ি সারাতে ৪৫ কোটি
সেন্টার ফর স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটি (এসএসডিএস)-এর এক রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে সেই তথ্য। তাতে বলা হচ্ছে দেশের পাঁচ ভাগ জনতার তিন ভাগ মানুষ ১০০ এপিসোডের একটা এপিসোডও কোনওদিন শোনেননি। মানে ১৪০ কোটি মানুষের ৮৪ কোটি মানুষ একদিনের জন্যও শোনেননি। দেশকে পাঁচটা ভাগ করে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল, তার মধ্যে দক্ষিণ ভারতে জনসংখ্যার ৭৫ ভাগ মানুষ একদিনও শোনেননি এই অনুষ্ঠান, উত্তর পশ্চিম ভারত, এমনকী পূর্ব ভারতেও ৬০ ভাগের কিছু বেশি মানুষ একদিনের জন্যও এই অনুষ্ঠান শোনেননি। এমনকী উত্তর ভারত বা পশ্চিম ভারতেও ৫০ শতাংশ মানুষ একদিনের জন্যও এই অনুষ্ঠান শোনেননি। সমীক্ষার ফল বলছে, বিজেপিকে সমর্থন করে এমন পরিবারের ৫১ শতাংশ মানুষ একদিনের জন্যও মোদিজির মন কি বাত শোনেননি। প্রায় প্রতিটা অনুষ্ঠান শুনেছেন এমন মানুষ ক’জন? সমীক্ষা বলছে দেশের ৫ শতাংশ মানুষ কমবেশি রোজ এই অনুষ্ঠান শুনেছেন। ৬২ শতাংশ মানুষ একদিনও শোনেননি এই অনুষ্ঠান। কেন শোনেননি? মন কি বাত-এ কী বলা হয় যে মানুষ শুনবেন? গরিব মানুষজন তাঁদের জীবন আর জীবিকার লড়াইয়ে ক্লান্ত, প্রতিদিন হেরেই যাচ্ছেন, আরও গরিব হচ্ছেন, তাঁদের সময় কই? মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের টিকে থাকার লড়াই, সন্তানের শিক্ষা এক বিপুল খরচের বোঝা। তারপর বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, তাদের সময় কোথায় এবং উচ্চবিত্ত কোটিপতি বিলিওনিয়ারদের এসব বকওয়াস শোনার দরকারই নেই, কাজেই মন কি বাত শোনার মানুষ নেই। আসলে দেশের মানুষ কিছু বলতে চায়, সে কথা শোনার সময় কোথায় শাসকদের? মোদিজি নিজের সেই কল্পিত রেল স্টেশনে, কল্পনার কেটলিতে চা বিক্রির গল্প, স্কুল থেকে ফেরার পথে পুকুর থেকে কুমির ধরার গল্প ইত্যাদির সঙ্গে জুড়ে নিতে চান কিছু সাধারণ মানুষের সত্যিই বড় কাজগুলোকে। আমলাদের বলা হয়েছে তাদের খুঁজে বার করো, দিল্লিতে এনে তাদের কণ্ঠ রেকর্ড করো, তারপর মন কি বাত-এ গুঁজে দাও। মোদিজির জীবন সংগ্রামের সঙ্গে সেই লড়াইকে এক করে দাও, তাই এক অদ্ভুত ওয়ান ওয়ে কমিউনিকেশন তৈরি করেছেন তিনি, তিনি একাই বলে যাচ্ছেন তাঁর মন কি বাত। ভালো ভালো কথা কিন্তু কাজের কথা?
ধরুন ডিমনিটাইজেশন, কবে এল মন কি বাতে? ২৬তম এপিসোডে ২৭ নভেম্বরে, মাথায় রাখুন ডিমনিটাইজেশন হয়ে গেছে ৮ নভেম্বর। তার মানে মোদিজি যখন রেকর্ডিং করছেন, তখন আমাদের মাছের বাজার থেকে সবজি বাজার শুনশান, মানুষ এটিএম-এর সামনে দাঁড়িয়ে। ১৯ দিনে মোদি সরকার বুঝে ফেলেছে সমস্যা অনেক গভীরে, কিন্তু হাত থেকে তির বেরিয়ে গিয়েছে। সেদিন মানে ওই ২৭ নভেম্বরে তিনি বলেছিলেন, এ এক কঠিন লড়াই, মানুষের কষ্ট হবে কিন্তু মানুষ তাঁর সঙ্গে আছে, কিছু মানুষের গলায় আমরা শুনেওছিলাম কালাধন, ব্ল্যাক মানিকে জব্দ করতে মোদিজির এই ডিমনিটাইজেশনে তাঁদের কষ্ট হলেও তাঁরা সঙ্গে আছেন, এবং মোদিজি ওই ২৭ নভেম্বরেই বলেছেন ৫০ দিনের মধ্যেই ফল পাওয়া যাবে। ৫০ দিন পরে তিনি ২৯ জানুয়ারি আবার হাজির হলেন মন কি বাত নিয়ে, ডিমনিটাইজেশন নিয়ে একটা কথা? না, বলেননি। ২৮তম এপিসোডে ২৯ জানুয়ারি ২০১৭তে মন কি বাত অনুষ্ঠানে তিনি ২৬ জানুয়ারি নিয়ে দু’ একটা কথা বললেন। যে সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়াতে হাজির থাকেনি হিন্দু মহাসভা, যে সংবিধানকে আরএসএস মেনেই নেয়নি তা নিয়ে আরএসএস-এর প্রচারক নরেন্দ্র মোদি কীই বা বলবেন? তবুও বলতে হয় বলে দু’ চারটে কথা বললেন। ৩০ জানুয়ারি গান্ধীজিকে হত্যা করেছিল আরএসএস–হিন্দু মহাসভার নাথুরাম গডসে, তা নিয়ে কোনও কথা? না, তিনি কেবল বললেন গান্ধীজির পুণ্য তিথি, তাই ওই দিন শহীদ দিবস পালন করা হবে, দেশের বীর শহীদদের নামে বেলা ১১টায় দু’ মিনিটের মৌনতা। এই ক’টা শব্দ, ব্যস, তারপর তিনি চলে গেলেন শিক্ষার্থীরা কীভাবে পরীক্ষা দেবে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায়। না, ডিমনিটাইজেশন নিয়ে একটা কথাও বলেননি।
মোদিজি কৃষি বিল এনেছিলেন সেপ্টেম্বর ২০২০তে, করোনার মধ্যেই মাত্র এক বেলার আলোচনায় পাশ হয়ে গিয়েছিল সেই বিল। তারপর এক বছরের বেশি সময় কৃষকরা রাস্তায়, তাদের জলকামান দিয়ে আটকানোর চেষ্টা হয়েছে, লাঠিচার্জ করে আটকানোর চেষ্টা হয়েছে। এই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পরে ৭০০-র বেশি কৃষক মারা গিয়েছেন, কিন্তু নরেন্দ্র মোদি একটা কথাও বলেননি তাঁর মন কি বাতে। কৃষি বিল ফেরত নেওয়া হল, ২৯ নভেম্বর ২০২১। তার আগের দিনেও মোদিজি মন কি বাতে করেছেন, ২৮ তারিখের মন কি বাতে তিনি কি বলেছেন, কেন এই বিল ফেরত নেওয়া হচ্ছে? না, বলেননি, সেদিনও বলেননি, পরেও বলেননি যে কেন কোনও আলোচনা ছাড়াই চুপ করে ফেরত নেওয়া হয়েছিল তিনটে কৃষি বিল? একই কথা নাগরিকত্ব বিল নিয়ে, পাশ তো করানো হল, কিন্তু সারা দেশে প্রতিবাদের সামনে সেই আইন লাগু করার হিম্মত হল না মোদি সরকারের। মোদিজি তা নিয়ে একটা কথাও বলেছেন মন কি বাতে? না, বলেননি, বলবেনও না। এক মেগালোম্যানিয়াকের সলিলকি, স্বগতোক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ এই মন কি বাত। যেখানে তিনি একাই বলে চলেছেন তাঁর মন কি বাতে, শুনছে কে? সমীক্ষাই বলছে ৫ শতাংশ মানুষ, মানে ১৪০ কোটির ৭ কোটি মানুষ, একদিনও শুনছে না ৬২ শতাংশ মানুষ, ৮৬.৮ কোটি মানুষ। হে মহামহিম রাজ্যপাল, দেশের ৮৬ কোটি মানুষ অমৃত বাচন শুনছে না, তারা ভাত চাইছে, চাকরি চাইছে, স্বাস্থ্য চাইছে, শিক্ষা চাইছে, সাহিদুল তার হাসপাতালের জন্য এক বিরাট পরিকল্পনা করেছে, এক ট্যাক্সি চালকের স্বপ্ন। কুমির ধরা, যে স্টেশন ছিল না, সেখানে চা বেচার মতো ঢপবাজি নয়, রুদ্রনীল ঘোষের মতো নীল বাতি আর লক্ষ টাকা মাইনে নেওয়ার ইচ্ছে নয়, সাহিদুল তার পরিকল্পনা নিয়ে তাঁর মন কি বাত বলতে চাইছে, আম জনতার মন কি বাত, কেউ কি শুনবেন?