কাক নাকি সব বোঝে। সে আপনি মানুন বা না মানুন, ফুটপাথে টিঁয়া থেকে কমপিউটারে হরোস্কোপ, খনার বচন থেকে নস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যৎবাণী নিয়ে মানুষ মাথা ঘামাবেই ঘামাবেই। কেন? কারণ মানুষের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, আপনি যত বড় খাঞ্জা খাঁই হন না কেন, পরের মুহূর্তে কী ঘটবে আপনি জানেন না, আর তার সঙ্গে যুক্ত হয় জীবনের নানান টানাপোড়েন। মাধ্যমিক পরীক্ষা থেকে চাকরি, লটারি থেকে শরিকি সম্পত্তি, সব মিলিয়ে এই অনিশ্চয়তা থেকে জন্ম নেয় ভবিষ্যৎ জানার প্রবল ইচ্ছে আর সেটাকে ঘিরেই জ্যোতিষ, মন্ত্র, কবচ, মাদুলি, আংটি, টিঁয়াপাখি। আর সেই তালিকাতে আপাতত একটু পিছিয়ে আছে বটে, কিন্তু আছে কাকচরিত্র, কাক নাকি সব জানে। তাই তাদের ডাক ফলো করলেই, মানে কোন সময় কোনদিক থেকে কাক ডাকল তা জানলেই নাকি জানা যাবে কী হতে চলেছে। সামান্য নমুনা দিই।
দিনের প্রথম প্রহরে কাক ডাকলে (সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত প্রথম প্রহর)
এ সময় বাড়ির পূর্ব দিকে ডাকলে- মনোবাসনা সিদ্ধ হবে।
এ সময় বাড়ির দক্ষিণ দিকে ডাকলে- সুখবর পাবেন।
এ সময় বাড়ির উত্তর দিকে ডাকলে- শত্রুর শত্রুতা বৃদ্ধি পাবে।
এ সময় বাড়ির পশ্চিম দিকে ডাকলে- আয় উপার্জন বৃদ্ধি পাবে।
এ সময় বাড়ির নৈঋত কোণে ডাকলে- ব্যবসায় লাভবান হবেন।
এ সময় বাড়ির ঈশান কোণে ডাকলে- আত্মীয় আসবে।
এ সময় বাড়ির অগ্নি কোণে ডাকলে- সু-সন্তান জন্ম নিতে পারে।
এ সময় বাড়ির বায়ু কোণে ডাকলে- শুভ সংবাদ পাবেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: ইউ পি মে কা বা?
দিনের দ্বিতীয় প্রহরে কাক ডাকলে (সকাল ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত দ্বিতীয় প্রহর)
এ সময় বাড়ির পূর্ব দিকে ডাকলে- শুভ সংবাদ পাবেন।
এ সময় বাড়ির দক্ষিণ দিকে ডাকলে- দুঃখ কষ্ট দূর হবে নতুবা সন্তান জন্মাবে।
এ সময় বাড়ির উত্তর দিকে ডাকলে- কেউ শত্রুতা করবে।
এ সময় বাড়ির পশ্চিম দিকে ডাকলে- কোন প্রভাবশালী লোকের সাক্ষাৎলাভ হবে ও উপার্জন বৃদ্ধি পাবে।
মানে কাকও জানে প্রভাবশালী লোকের সঙ্গে দেখা হলে লাভ হয়, উপার্জন বৃদ্ধি পায়। আমি কোথা থেকে জানলাম? কাকচরিত্র বলে চটি বই পাওয়া যায়, কলেজ স্ট্রিটে যান কিংবা পেতেও পারেন রেলের কম্পার্টমেন্ট-এ। তবে কাকেরও তো রকমফের আছে, দাঁড়কাক, পাতিকাক, কাকও তো বহু রকমের। কাজেই কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের ব্যান্ডেল লোকালের কাকচরিত্র না মিলিলে আমি দায়ি নহে। এবং কখনও এর একটাও মিলেছে কি না তাও আমার জানা নেই। তবে কাকচরিত্র বলে বইয়ে এমন লেখা আছে। কাক ধূর্ত, কাক চালাক, কাক কর্কশ কিন্তু কাক ছাড়া নাগরিক জীবন অচল, তারা নোংরা খায়, খুঁটে খায়, তাদের জন্যই খানিক সাফসুতরো হয় আমাদের পরিবেশ। কিন্তু নোংরা যতই খাক, কাকেদের দেখে কিন্তু সেটা বোঝার উপায় নেই, চকচক করে তাদের রং, কী জেল্লা, আর কী কেতা, ঘাড় ঘুরিয়ে যখন দেখে, তখন মনে হয় মহাজ্ঞানী, তবে তা মুখ খোলা অবদি। মুখ খুললেই কাকচরিত্র এক্কেবারে পরিষ্কার। আজ চতুর্থ স্তম্ভে কাকচরিত্র নিয়ে যা বলার তা এখানেই শেষ, এবার অন্য বিষয়ের অবতারণা যার সঙ্গে এই কাকচরিত্রের কোনও সম্বন্ধই নেই, কিন্তু বলার পরেও যদি আপনারা কোনও সম্বন্ধ খুঁজে পান, তাহলে তা অনিচ্ছাকৃত। তো চলুন চতুর্থ স্তম্ভের দ্বিতীয় পর্যায়ে।
শ্রী শুভাপ্রসন্ন মাত্র কদিন আগে ২১ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছেন, এই দাওয়াত, পানি, জি ইত্যাদি শব্দ ঢুকিয়ে ওপার বাংলার মানুষেরা বাংলা ভাষাকে কলুষিত করছেন। সেই মঞ্চেই তাঁর বক্তব্যের পরেই রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শুভাপ্রসন্নের এই কথা উড়িয়ে দিয়েছেন, বলেছেন ভাষায় শব্দ যোগ হবে, বহু প্রতিশব্দ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই কথা শ্রী শুভাপ্রসন্ন আজ প্রথমবার বললেন না, এর আগেও বহুবার বলেছেন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে এক আলোচনা সভায় তিনি এই কথা আরও রুঢ় ভাবেই বলেছিলেন, আবার ২১ ফেব্রুয়ারি বললেন, যে একুশে ফেব্রুয়ারি সালাম বরকত জব্বার শফিউর রফিক প্রাণ দিয়েছিলেন। সমস্যা হল এইসব নামগুলো বাঙালি মানুষের কি না তা নিয়েও তো শ্রী শুভাপ্রসন্নের যথেষ্ট সন্দেহ থাকা উচিত, কিন্তু এই পাঁচ যুবক বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন সেটাও তো সত্যি, সেটাই তো ইতিহাস। এই পাঁচ যুবক জলকে পানিই বলতেন, দাওয়াত দিতেন, সেটাও তো সত্যি। শ্রী শুভাপ্রসন্নের শিল্পমাধ্যম ভাষা নয় চিত্র, ছবি, সে ছবিতে জল বয়ে যায়, এক বাঙালি তাকেই পানি বলে, ভাষা বা ছবির তো তাতে কিছুই যায় আসে না। কিন্তু শ্রী শুভাপ্রসন্ন তাহলে এমন কথা বললেন কেন? যে কোনও ভাষায় বহু সহস্র লক্ষ শব্দ ঢুকে পড়ে অনায়াসে, তারপর তা সেই ভাষার অঙ্গ হয়ে যায়, এ তো স্বাভাবিক। শ্রী শুভাপ্রসন্ন বলেছেন, কোট আনকোট মুখ্যমন্ত্রী ভোটে লড়েন, আমার সেই দায় নেই। তা এই ভোট শব্দটা নিয়ে শ্রী শুভাপ্রসন্নের মত কী? বা ধরুন ওনার আর্টস একর, ভারি যত্ন করে তৈরি করেছেন, গ্যালারি, সেমিনার হল, গেস্ট হাউস, নাম দিয়েছেন আর্টস একর, শিল্প গ্রাম নয়, আর্টস একর। তো আর্টস শব্দটা কী? একর শব্দও তথৈবচ, আর যাই হোক বাংলার আদি শব্দ নয়, তাহলে শ্রী শুভাপ্রসন্নের আপত্তিটা বিদেশি শব্দ নিয়ে নয়, ওনার আপত্তি যে শব্দ থেকে মুসলমান মুসলমান গন্ধ বের হয় তা নিয়ে। তো সেটা সাফ জানালেই হয়, নিজের অবস্থান ঠিক করুন, আদিত্যনাথ যোগীর পথে চলবেন আবার ২১ ফেব্রুয়ারির মঞ্চ আলো করে বসবেন দুটো তো হয় না। এক ভাষা, এক রাষ্ট্র এক নেতা আমরা শুনেছি, খানিক দেখছি, জানি তো বটেই কিন্তু মানি না, আমাদের বাংলায় পানিও বয়ে যায়, জলও।
সমরেশ বসুর বিখ্যাত গল্প আদাব, কয়েকটা লাইন পড়ি, “সুতা মজুর গলা বাড়িয়ে দেখল পুলিশ অফিসার রিভলবার হাতে রাস্তার উপর লাফিয়ে পড়ল। সমস্ত অঞ্চলটার নৈশ নিস্তব্ধতাকে কাঁপিয়ে দুবার গর্জে উঠল অফিসারের আগ্নেয়াস্ত্র। গুড়ুম, গুড়ুম। দুটো নীলচে আগুনের ঝিলিক। উত্তেজনায় সুতা-মজুর হাতের একটা আঙুল কামড়ে ধরে। লাফ দিয়ে ঘোড়ায় উঠে অফিসার ছুটে গেল গলির ভিতর। ডাকুটার মরণ আর্তনাদ সে শুনতে পেয়েছে। সুতা-মজুরের বিহ্বল চোখে ভেসে উঠল মাঝির বুকের রক্তে তার পোলামাইয়ার, তার বিবির জামা শাড়ি রাঙা হয়ে উঠেছে। মাঝি বলছে— পারলাম না ভাই। আমার ছাওয়ালরা আর বিবি চোখের পানিতে ভাসব পরবের দিনে। দুশমনরা আমারে যাইতে দিল না তাগো কাছে। পড়ে দেখুন শ্রী শুভাপ্রসন্ন, অসংখ্য শব্দ যা আপনার বাংলা মনেই হবে না কিন্তু এই গল্প বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ছোটগল্প। এভাবেই শব্দরা আসে বহু ভাষা থেকে, তারপর সে তাঁর নিজের অবয়বে বয়ে যায়, আমাদের ঘেরাও এখন সাহেবদের অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে। আপনি তো ভাটপাড়ার বৈদিক ব্রাহ্মণ মাননীয় শ্রী শুভাপ্রসন্ন, নারকেল ছাড়া আপনার পুজো শুরুই হবে না, তো ওই নারকেলও কিন্তু বাংলা শব্দ নয়। সংস্কৃত যেহেতু মূলত উত্তর ভারতের ভাষা ছিল তাই সংস্কৃতে শুরুর দিকে নারকেলের কোনও প্রতিশব্দও ছিল না, এদিকে হিন্দু ধর্মের রীতি মেনেই সব পুজোতেই নারকেল আছে, তো সেই নারকেল এসেছে পর্তুগিজ ভাষা থেকে, ভেঙেচুরে নারিয়েল, নারকেল। পর্তুগিজরা আমাদের দেশে আলু এনেছিল, তারা বলতো বাটাটা, মুম্বাইয়ের ফুটপাথে বাটাটা বড়া পাবেন, আলুর চপ। পর্তুগিজরা বাটাটা আনল দক্ষিণে, সমুদ্রতীরে, সেই আলুর বীজ বাংলায় আনল ইংরেজরা, যে আলু ছাড়া বাঙালির রান্নাই হবে না, বীরভূমের আলু পোস্তও মুছে যাবে খাবারের তালিকা থেকে। আনারস, আচার, কফি, সাবু সবই এসেছে রোনাল্ডোর দেশ থেকে, রোনাল্ডো প্রেমীরা খবর রাখেন? আলপিন থেকে আলকাতরা, বালতি থেকে বেহালা এসেছে ওই পর্তুগাল থেকে, এমনকী বাঙালিদের পাতের শুরুতে যে শুক্তো তারও নাকি আদি নিবাস ওই পর্তুগাল, আমাদের মা দিদারা অবশ্য ঐ শুক্তোতে দুধ আর বড়ি দিয়ে চেহারাই পালটে ফেলেছেন। কিনু গোয়ালার গলি মনে আছে?
বেতন পঁচিশ টাকা, সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি।
খেতে পাই দত্তদের বাড়ি ছেলেকে পড়িয়ে।
শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই, সন্ধেটা কাটিয়ে আসি,
আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: দেশদ্রোহী সাভারকর, ভারতরত্ন সাভারকর
ওই কেরানি কিন্তু এসেছে পর্তুগিজ ভাষা থেকেই, সদাগরির সওদাগর এসেছে ফার্সি শব্দ থেকে, বেতন সংস্কৃত, মজুরি হলে ফারসি হয়ে যেত। আপিস আর ইস্টিশন ইংরিজি, দায় সংস্কৃত দেয় শব্দ থেকে নেওয়া কিন্তু দাবি হলেই তা হয়ে যাবে আরবি। তাস খেলেন নাকি? সেখানে আবার ওলন্দাজরা হাজির, ডাচ। তাদের কাছ থেকেই টেক্কা, ইস্কাবন, রুইতন, হরতন এসেছে। আমরা বলি বটে তুরপের তাস, সেই তুরুপও কিন্তু ডাচেদের কাছ থেকেই পাওয়া। তাস বললেই তাস, পাশা, দাবার কথা চলে আসে এক লহমায়। তাহলে বলি, তাস এল ওলন্দাজদের হাত ধরে, পাশা কিন্তু চীনের হাত ধরে, আর দাবা এক্কেবারে ভারতের খেলা। শকুনি পাশা খেলায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন, চ্যাম্পিয়ন যাকে বলে, সেই শকুনি ছিলেন গান্ধাররাজ, গান্ধার মানে আজকের আফগানিস্তান। মানে পাশা চীন থেকে গিয়েছিল আফগানিস্তানে, সেখান থেকে ভারতে, বেজায় নতুন এই খেলায় তাই কি হেরে ভূত হয়েছিলেন যুধিষ্ঠির? এত শত উদাহরণ দিলাম আপনাদের জন্য, শ্রী শুভাপ্রসন্নের জন্য নয়, তিনি এসব বিস্তর জানেন।
তাহলে? তাহলে সম্ভবত তাঁর ভারি পরিচিত কুণাল ঘোষ খানিক খোলসা করেছেন। উনি জানতে চেয়েছেন, কোট আনকোট, “শুভাদা কি কোনও কমিটিতে যেতে চান বা ওনার কি কোনও জমি দরকার আছে?” বলতে চেয়েছেন, এসবই হল নিজের অবস্থান বদলানোর চেষ্টা। এক সময়ে আমরা বলতাম নন্দন মানে পক্ক দাড়ি, পক্ক কেশ, অবশ্যই শ্রী শুভাপ্রসন্ন এবং সে সময়ের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে নিয়েই একথা বলা হত। এরপরে শ্রী শুভাপ্রসন্ন যথাসময়ে নিজের অবস্থান বদল করেছেন, আমরা সে বৃত্তান্ত জানি, এবার কি তাহলে আবার অবস্থান বদলের চেষ্টা? হতেই পারে। মানুষ দেখছেন, শুনছেন, বুঝেও ফেলবেন।
আমরা বরং আরেকবার কাক চরিত্রে ফিরে যাই, যার সঙ্গে এতক্ষণের কথার কোনও সম্পর্কই নেই। কাক সুযোগসন্ধানী, সে কিছু পাবার জন্যই ডাক ছাড়ে, কিছু পাবার জন্যই সে তাঁর অবস্থান বদলায়, ওই যে শুনুন নৈঋত কোণ থেকে কাক উড়ে গেছে ঈশান কোণে, ডাকছে কা কা কা, সম্ভবত আবার কোনও প্রভাবশালী মানুষের সঙ্গে দেখা হবে আজ, লাভ হল না লোকসান কাল জানাব, আপাতত এখানেই শেষ করছি আজকের চতুর্থ স্তম্ভ।