কলকাতা: মৃত ব্যক্তির মতো খেলার মাঠের সদ্য জীবননাশ হওয়া ইভেন্টেরও রাইগার মর্টিজ সেট ইন করার নির্দিষ্ট সময় লাগে। সেই সময়টুকুর মধ্যে অঘোষিত শবদেহের কাছাকাছি গেলে নীরব ভাষা উদ্ধার সম্ভব। যা জীবদ্দশার সংলাপের মতোই তাৎপর্যপূর্ণ।
তা সোমবার ইডেনে ঢুকে দেখা গেল জৌলুসে ভরা ফুলের ডেকরেশন তুলে নেওয়া হয়েছে। প্রকৃত অর্থে বাংলার একমাত্র রঞ্জিজয়ী টিমের মাল্যবান ছবিসহ ফ্লেক্স মাটিতে নামানো। ক্লাবহাউসের দোতালা কার্যত জনমানবশূন্য। বিয়েবাড়ি চলতে চলতে আজ ম্যাচের নির্দিষ্ট শেষ দিন উত্তেজনার শিখরে পৌঁছে মালাবদলের লগ্ন হিসেবে ধার্য ছিল। ধরে নেওয়া ছিল রঞ্জি ট্রফি তুলবেন মনোজ তেওয়ারি। তেত্রিশ বছরের অভিশপ্ত ক্ষত জুড়িয়ে বিয়েবাড়ি নাচবে গাইবে। আর বর-কনেকে যেমন আশীর্বাদ করে, সেভাবেই বঙ্গজ ক্রিকেটের শ্লাঘা পুনরুদ্ধারে আওড়াবে, আন্ড দেন দে লিভড হ্যাপিলি দেয়ার আফটার।
কোথায় কী! দুপুর দুপুর ইডেন ঢুকে দেখা গেল স্বপ্নের হেলিকপ্টার ক্রাশের নীরবতা চত্বর জুড়ে। মৃত্যুশোকের পেটে একটা বিতর্কের পিনও ঢুকে রয়েছে। সিএবি প্রধান জানতেন ম্যাচ শেষে ভাঙা হৃদয় নিয়ে রঞ্জি ট্রফি তুলে দেবেন সৌরাষ্ট্রের হাতে। জানতেন না যে প্রথম দিনের প্রথম ঘন্টার মতোই একটা ডেলিভারি অতর্কিতে সিম করে তাঁকে সরিয়ে দেবে সেই সম্মান থেকে। বলবে আইপিএল গভর্নিং কউন্সিল মেম্বার দেবেন ট্রফি। পরিষ্কারভাবে ঘরের মাঠে সৌরভদের ক্রীড়াসংস্থাকে অপদস্থ করা। কিন্তু ইডেন পরিবেশ এতই মলিন যে শেষকৃত্য না হয়েও যেন বাসনার মৃত চিতাভস্ম বাষ্পের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে।
কাজি নজরুলের জীবনের শেষ কয়েকবছরের জন্মদিনে কলকাতার বিখ্যাত দৈনিকের অনিবার্য শিরোনাম থাকত, ফুলের জলসায় নীরব কেন তুমি কবি? বাংলা ক্রিকেটের হেডকোয়ার্টারে সরেজমিন ঘুরতে গিয়ে মনে হল ফুলের জলসায় নীরব কেন তুমি বাংলা?
চূড়ান্ত শোকাবহ ঘটনারও যেমন নির্দিষ্ট ব্যাকরণ থাকে তেমনি বাংলার একপেশে হারেরও রয়েছে। কোথায় দেখলাম ম্যাচ শুরুর আগেই বাহারি সাজসজ্জায় নাকি টিমের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। যুক্তিটা ননসেন্স বললেও কম বলা হয়। বাংলাকে ডুবিয়েছে ত্রিভুজের মিশেল। টস হারলে তার জন্য প্ল্যান বি তৈরি রাখতে না পারা। ত্রুটিপূর্ণ দল নির্বাচন। এবং ঘরের মাঠের বাড়তি চাপের মুখে জনাকয়েকের সহজবোধ্য চোকিং।
বাংলা আইসিইউ-তে ঢুকে যায় ম্যাচের প্রথম প্রহরে। আরও নিখুঁত বললে ফাইনাল মীমাংসিত হয়ে যায় সকাল ৯-৯.৩৫। বল যে পরিমান সিম ও সুইং তখন করছিল, বাকি ম্যাচে আর করেনি। ইডেনে অন্য সেন্টারের তুলনায় আধ ঘন্টা আগে খেলা শুরু হয় বলে প্রথম ব্যাট করলে ওটাই অনিবার্য বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল। রঞ্জি জেতা ও হারার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপত্যকা। প্রশ্ন হল, বাংলা কি তার জন্য আদৌ তৈরি ছিল? নাকি ধরেই নিয়েছিল তারা টস জিতে সৌরাষ্ট্রকে প্রথম ব্যাট করাবে। অথচ আবহাওয়া বিচারে ক্রিকেটে এমন প্ল্যান বি অহরহ তৈরি হওয়ার কথা। হয়েও থাকে। নিরানব্বই বিশ্বকাপের সময় জাতীয় বিতর্কের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল তেন্ডুলকরের ব্যাটিং পজিশন। তিনি ওপেন করতে চাইছিলেন। কিন্তু কপিলসহ গোটা ভারতীয় ক্রিকেট মহল বলছিল, কাজটা একেবারেই উচিত হবে না যেহেতু প্রথম ব্যাট করলে ইংল্যান্ডে বল বাড়তি সিম ও সুইং করবে। আমার সেরা ব্যাটসম্যানকে কেন আমি সবচেয়ে কঠিন সময়ে ঠেলব? তার চেয়ে তাকে চার নম্বরে খেলব যখন পরিস্থিতি একটু সহজ হয়ে আসবে। শেষমেশ কিছু ম্যাচ শচীন জেদ করে ওপেন করেন। কিছু ম্যাচ মিডল অর্ডার খেলেন।
ক্রিকেটে কথাটার প্রচলন নেই। কিন্তু এতবার ব্যবহার হয়েছে যে হয়ে যাওয়া উচিত ছিল– মর্নিং ওয়াচ ম্যান। নাইট ওয়াচম্যান যেমন কঠিন অবস্থা থেকে দিতে সাময়িক পরিত্রানের বিকল্প ব্যবস্থা, এটাও তাই। প্রশ্ন হল, বাংলা কি এমন প্ল্যান বি প্ৰতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা ভেবেছিল?
কেন ওই কঠিন সময়ে নিয়মিত ব্যাটারদের এগিয়ে না দিয়ে আকাশদীপ বা অভিষেক পোড়েলদের সে আগে পাঠাল না? দু-তিন উইকেট যেত। যেত। আধুনিক ক্রিকেট তো হরদম ফ্লেক্সিবিলিটির শিক্ষাই দেয়। তারপর নিয়মিত ব্যাটসম্যানেরা ভালো কন্ডিশনে ব্যাট করত। কে বলতে পারে যে টেলএন্ডারদের শুরুতে তারা ভাবেনি তাদের এগিয়ে দিলে সৌরাষ্ট্র হতবুদ্ধি হয়ে পড়ত কিনা?
আর একটা জিনিস বাংলার মতো টিম যারা রঞ্জি জিততে চাইছে তাদের দলনির্বাচনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। মরশুমের শুরুতে প্রেসার প্লেয়ার ও নন প্রেসার প্লেয়ার বেছে ফেলা। যদি মনে হয় অভিমন্যু ঈশ্বরণ ওই ট্যালেন্ট নিয়েও চাপের মুখে অনিশ্চিত —হয় তাঁর জুড়ি এমন কাউকে দিতে হবে যে প্রেসারে রান করে। অথবা ভাবতে হবে শুধু লিগ ম্যাচে রান করার জন্য অভিমান্যুকে নেব? নাকি তাঁর ব্যাপারে একটা পরিষ্কার বোঝাপড়ায় আসব?
ক্রিকেট অসামান্য বোকা বানানোর খেলা। এই রঞ্জি ফাইনালের সুপারফ্লপ দক্ষিনি হয়ত কোনওদিন ভারতকে পাকিস্তান ম্যাচে জিতিয়ে দিলেন। কিন্তু বাংলাকে একটা সময় পর আবেগহীনভাবে ঠিক করতে হবে চাপের মুখে আমার ম্যাচ উইনার কারা? কাদের পেছনে আমি লগ্নি করব? ম্যাচ টেম্পরামেন্ট নেই বলে কাকে জামাইআদরে আর পুষব না?গতকাল প্রাক্তন বাংলা অধিনায়ক বলছিলেন, আমার নামটা লিখবেন না, কিন্তু এমনই তো হওয়ার ছিল। বাংলা তো সাড়ে পাঁচজনের টিম। মনোজ, অনুষ্টুপ, আকাশদীপ, সুদীপ, মুকেশ, শাহবাজ। আর আধখানা অভিমন্যু। সাড়ে পাঁচজনে কি রঞ্জি জেতা যায়? কথাটা শুনতে খারাপ কিন্তু আয়নায় গালের কাটা দাগটা দেখায়। যাকে মেনে নিয়ে মেক আপ করতে বসাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
অরুণ লাল এই টিমকে দিয়েছেন ফিটনেস। লক্ষ্মীর অবদান –ম্যান ম্যানেজমেন্ট। এমন হারের পরেও ড্রেসিংরুম গরল বাইরে বেরোতে না দেওয়া। কিন্তু এবার তাঁকে রিয়ালিটি চেকে নামতে হবে। চাপের মুখে সত্যি চলবে কে? সেই উত্তরটা সৎভাবে নিজেকে বার করতে হবে। সেরা কোচেরা জানেন, এই উত্তর খুঁজে পাওয়াটাই আসল। বাকি সব বেকার। তবে এই টিমকে দুরছাই করার কারণ নেই। দিনের শেষে ঘরোয়া ক্রিকেটের রানার আপ হওয়া ইয়ার্কি নয়। শপিং মলে কিনতেও পাওয়া যায় না।
লক্ষ্মী -মনোজেরা অবশ্যই জানেন নাইট শিবিরে বারবার আলোচিত শাহরুখ খানের প্রিয় শায়েরির কথা।
গিরতে হেয় শের সওয়ারি ময়দানি জং মে
ও জিসম কেয়া গিরে যো ঘুটনোকি বল চলে।
যারা হাওয়া আর ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয় পড়ার সম্ভাবনা তাদেরই বেশি থাকে।
যারা এমনিতেই হামাগুড়ি দিচ্ছে তাদের আর পড়ার ভয় কোথায়?
গত তিন বছরে দু’বার ফাইনাল একবার সেমি ফাইনাল। খুব প্রকাশ্য ভাবেই এটা ঘোড়ার পিঠে চড়ে স্বপ্নকে তুলে নেওয়ার বীরোচিত চেষ্টা। হয়ত আবার ব্যর্থ হওয়া। ফের ঘোড়া থেকে পরে মাটির সজ্জায়। তা বলে স্বপ্নের কি সূর্যাস্ত হয়ে গেল নাকি? মনে হয় না। লক্ষ্মী -মনোজেরা জানেন, যুদ্ধ থামিয়ে দিলে আর বীর কীসের? অনেক কঠিন ম্যাচে লোকলজ্জার হার দুর্দান্ত লার্নিং ম্যানুয়েলও খুলে দেয়। আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে, শিক্ষাটা না দিলে নিজে থেকে শিখতে না।
সময়ের নিয়মে আবার বসন্ত আসবে। আবার ইডেনে বসবে ফুলের জলসা।