কলকাতা: বলিউডের একসময়ের ভিলেন অজিত কে মনে আছে? ধর্মতলায় কেসি দাসের মোড় থেকে ইডেনমুখী হচ্ছি। বেশ কয়েকজনকে দেখলাম ‘জঞ্জির’-এর অজিতকে অনুসরণ করে একটা ডায়লগ নিজেদের মধ্যে বলতে- ‘মোনা ডার্লিং…ম্যাচ কিতনে বাজে খতম হোগা?’ অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর আসছে- ১ ঘন্টা, ২ ঘন্টা, খুব বেশি হলে ৩ ঘন্টা। যাঁরা উত্তরে বললেন ‘এক ঘন্টা’, তাঁদের প্রশ্নকর্তা পালটা বললেন, ‘স্মার্ট বয়’। ম্যাচ শুরুর আগে ৭০ দশকের কোনও হিন্দি মুভির চিত্রনাট্য যেন লাইভ দেখছি। রবিবাসরীয় সকালে আজ যে ক’জন ইডেনমুখী হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মনে করছিলেন একঘন্টা থেকে দু’ঘন্টার মধ্যে ম্যাচ শেষ হবে। মাত্র ৫ শতাংশ মনে করছিলেন মনোজের চওড়া ব্যাটে ভর করে মহাকাব্যিক কামব্যাক ঘটাবে বাংলা। ‘মিরাকল’ একবারই হয়, প্রতিবার হয় না। ২০০১-এর ইডেনে লক্ষ্মণ-দ্রাবিড় জুটির ক্রিকেটীয় রোমান্স ২০২৩-এ মনোজ-শাহবাজ জুটি ফেরাবেন এমন ধারনা হয়ত খুব কমজনই করেছিলেন। তাঁরা যে খুব একটা ভুল কিছু ভাবেনি সেটা ম্যাচের ফলাফলেই স্পষ্ট। চতুর্থ দিনের খেলা শুরুর আড়াই ঘন্টার মধ্যে ম্যাচ শেষ। বাংলাকে ৯ উইকেটে হারিয়ে আরও একবার রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন সৌরাষ্ট্র। জয়দেবের জয়ধ্বনি স্বর্গোদ্যান জুড়ে।
আজ ম্যাচ শুরুর প্রথমে কুয়াশার চাদরে ঢাকা ছিল স্বর্গোদ্যান। ফলে আরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যান মনোজ-শাহবাজরা। মনোজের ভুল কলে জয়দেব উনাদকাটের থ্রো-এ রান আউট হয়ে যান শাহবাজ। এরপর লড়াইটা আরও কঠিন হয়ে যায়। মনোজ বুঝে যান যা করতে হবে তাঁকেই করতে হবে। পিটারের ডেরা থেকে বাংলাকে বাঁচাতে তাঁকে ‘বিজয়’-এর ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু ৭০ দশকের অ্যাঙ্গরি ইয়ং ম্যান ‘বিজয়’ আর কোথায় হতে পারলেন মনোজ! শাহবাজ আউট হয়ে যেতেই জয়দেব উনাদকাটের বলে অসহায় আত্মসমর্পণ মনোজ তিওয়ারিরও। ব্যস…বাংলার ক্রিকেট অনুরাগীরা বুঝে গেলেন টিম ভেন্টিলেশনে চলে গিয়েছে। যেকোনও সময়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারে। শেষ উইকেটে মুকেশ কুমার এবং ঈশান পোড়েলের মধ্যে ৩৬ রানের একটা পার্টনারশিপ হয়, যার দরুণ ইনিংস হারের লজ্জা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পায় বাংলা। ১২ রানের লক্ষ্যমাত্রা ২ ওভার ৪ বলে ১ উইকেট হারিয়ে তুলে ফেলে সৌরাষ্ট্র।
ম্যাচ শেষে দুটি দৃশ্য চোখে পড়ল। একদিকে, সৌরাষ্ট্রের ক্রিকেটারেরা রঞ্জি ট্রফি জয়ের পর সেলিব্রেশন শুরু করে দিয়েছে। তাঁদের স্ত্রী-বান্ধবীরা কোরাসের সুরে গাইছিল- ‘ইস্ট অর ওয়েস্ট, সৌরাষ্ট্র ইস দ্য বেস্ট’। এরপর ক্লাব হাউস থেকে মাঠের দিকে ছুটে এসে তাঁদের মনের মানুষদের কাছে টেনে নেন, ভালোবাসার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হন, সাক্ষি থাকে স্বর্গোদ্যানের সবুজ গালিচা। অন্যদিকে, ঠিক উল্টো ছবি। অভিষেক পোড়েল মনোজকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। মনোজ তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও কান্না থামছেই না। একটু বাদেই ক্লাব হাউসের ডানদিকে সারিরবদ্ধভাবে দাঁড়ায় বাংলা দল। মনোজ দু’হাত জড়ো করে প্রনাম করছেন গ্যালারিতে থাকা দর্শকদের। বাংলা হারলেও মনোজকে স্যালুট জানাতে কার্পণ্য করেনি ক্রিকেটের নন্দনকানন। ক্ষণিকের জন্য মনে হল এটাই শেষ রঞ্জি ম্যাচ নয়তো মনোজের! চারটে রঞ্জি ফাইনাল খেলে ফেললেন। ইডেনে এই প্রথম রঞ্জি ফাইনালে মনোজ, কিন্তু তাতেও শিকে ছিড়ল না। ম্যাচ শেষে মনোজ নিজে বললেন, ‘গত চারটে রঞ্জি ফাইনালের মধ্যে এই ফাইনালে হার সবথেকে কষ্ট দিয়েছে। ইডেনে রঞ্জি ট্রফি জেতার আশায় বুঁদ ছিল গোটা বাংলা শিবির। ড্রেসিংরুমে ক্রিকেটারদের কান্না দেখলে বুঝতে পারতেন কতটা কষ্ট পেয়েছি আমরা।’
কিন্তু ক্যাপ্টেন যতই বলুক, কিছু ক্রিকেটারের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। গতকাল রাতে বাংলার একজন ক্রিকেটারকে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি পোস্ট করতে দেখা যায়। ছবি পোস্ট করা নিয়ে কেউ আপত্তি করবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দায়বদ্ধতার। ১৯৭০-এর দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচের আগে সুনীল গাভাসকর একবার এক ক্যামেরাপারসনকে ছবি তুলতে দেননি। কারণ হিসেবে জানিয়েছিলেন, ‘ক্যামেরার ফ্ল্যাশ চোখে পড়বে, পরের দিন গার্নার-মার্শাল-হোল্ডিংদের খেলতে সমস্যা হতে পারে।’ শোনা যায়, লিটল মাস্টারের এই কথা শোনার পর কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যান সেই ক্যামেরাপারসন। লর্ড রিলেটর এমনি এমনি গাভাসকরকে নিয়ে ‘ক্যালিপসো’ রচনা করেননি। শুনেছি ম্যাচ চলাকালীন শচীন তেন্ডুলকরও একেবারে অন্য জোনে চলে যেতেন। বলছি না বাংলার সেই ক্রিকেটার শচীন বা গাভাসকরের সমকক্ষ। কিন্তু ‘কমিটমেন্ট’-এর নিরিখে শচীন বা গাভাসকর এবং বাংলার সেই ক্রিকেটার পুরোপুরি ভিন্ন ঘরানার।
আরও পড়ুন: India vs Australia: ধর্মশালা থেকে সরতে চলেছে ভারত-অস্ট্রেলিয়া তৃতীয় টেস্ট
সৌরাষ্ট্রের অধিনায়ক জয়দেব উনাদকাট শেষদিন খোঁচা দিতে ভুললেন না। বললেন, ‘সৌরাষ্ট্রের ক্রিকেটারেরা আবেগকে নিয়ন্ত্রনে রেখে খেলতে পেরেছে। প্রথম ইনিংসে নাইটওয়াচম্যান হিসেবে নামা চেতন সাকারিয়া প্রায় ৫০-এর কাছকাছি বল খেলে ফেলেন। এটাই পার্থক্য গড়ে দেয়।’
পালটা দেন বাংলা অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারিও। বলেন, ‘টসে জিতলে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে খেলা যায়(সাংবাদিক সম্মেলনে প্রতিটি সাংবাদিক হেসে উঠলেন)। আমরা যদি টসে জিততাম, তাহলে খুব বেশি হলে ওঁদের ১২০-তে অল আউট করে দিতাম। কিন্তু ভাগ্য আমাদের সঙ্গে ছিল না এই ম্যাচে।’
রঞ্জি জিতে চেতেশ্বর পূজারাকে উৎসর্গ করলেন সৌরাষ্ট্রের অধিনায়ক জয়দেব উনাদকাট। ইডেন ছাড়ার আগে বলে গেলেন, ‘আমরা সবাই অনেক পরিশ্রম করেছি। আজ সেই পরিশ্রমের ফল পাচ্ছি। একটা কথা জেনে রাখুন এই যুগে সৌরাষ্ট্র শাসন করবে ভারতীয় ক্রিকেটকে।’
রঞ্জি ফাইনালে বাংলার হারের ময়নাতদন্ত করলে যে কারণগুলি উঠে আসবে সেগুলি হল-
১। টসে হেরে যাওয়া
২। বাংলার ওপেনার অভিমন্যু ঈশ্বরণের ধারাবাহিক ব্যর্থতা
৩। অতিরিক্ত অনুষ্টুপ নির্ভরতা
৪। সেমিফাইনালে দারুণ পারফর্ম করা প্রদীপ্ত প্রামানিকের জায়গায় আকাশ ঘটককে দলে নেওয়া
৫। ম্যাচ প্র্যাক্টিস না থাকা ৩২ বছরের সুমন্ত গুপ্তর নির্বাচন নিয়েও থাকছে প্রশ্ন
৬। ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে বাংলার বোলারদের নির্বিষ বোলিং
৭। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বেশ কয়েকটি ক্যাচ মিস
আগামিকাল আবার সূর্যোদয় হবে। বাঙালী আবার আশা দেখতে শুরু করবে রঞ্জি জয়ের। ইডেনে খেলা দেখতে আসা বারাসাতের ৭৬ বছরের অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী আশিস তালুকদার ভেজা চোখে গ্যালারিতে বসে বলতে থাকেন, ‘১৯৮৯-৯০ তে সম্বরণদের রঞ্জি জয় দেখেছিলাম গ্যালারিতে বসে। জীবিত অবস্থায় আরও একবার বাংলার রঞ্জি জয় দেখে যেতে চাই।’
তবে আগামীতে ফাইনালের শেষদিন (সেটা ৫ বছর পরেই হোক বা ১০ বছর) যেন কেসি দাস-হাইকোর্ট-রাজভবন বা আকাশবাণীর পাশ দিয়ে আসা ইডেনমুখী দর্শকদের বলতে না শোনা যায়- ‘মোনা ডার্লিং…ম্যাচ কিতনে বাজে খতম হোগা…’