কলকাতা: সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের (Sourav Ganguly) আমল থেকে সিএবি (CAB) কর্তাদের মধ্যে নতুন রেওয়াজের মতো হয়ে গিয়েছে যে প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি নিছক কাচের বক্সে বসে খেলা দেখেন না। হয় এসি বক্সের এসি বন্ধ করে জানলা খুলে দেন, বা নেমে আসেন লোয়ার টিয়ারে। জগমোহন ডালমিয়ার সময়ে এসব ভাবাই যেত না। কর্তারা ক্লাব হাউসেই নিজেদের আবদ্ধ রাখতেন।
ব্যতিক্রমী সৌজন্য দেখিয়ে এবারে নব্বইয়ের সেই রঞ্জি ফাইনাল ম্যাচ কভার করা জনাদশেক সাংবাদিককে খেলা দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সিএবি প্রেসিডেন্ট (CAB President)। সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ প্রেসিডেন্ট স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়কে (Snehasish Ganguly) ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে দেখলাম তিনি নিজের ঘরে নেই। বক্সে নেই। কোথায়? না, দলবল নিয়ে লোয়ার টিয়ারে বসে খেলা দেখছেন। ঘনিষ্ঠরা জানেন, স্নেহাশিস হলেন সিনেমার পোকা। কোনও কোনও দিন মুড্ থাকলে ঝটাঝট মাল্টিপ্লেক্সে টানা দুটো ফিল্মও দেখে ফেলেন। শুক্রবার সকালের প্রাক লাঞ্চ ইডেন তাঁর কাছে নির্ঘাত কোনও ভয়ের ছবি বা অল টাইম ক্লাসিক হিসেবে পরিচিত হিচককের ‘সাইকো’ হিসেবে দেখা দিয়েছিল।
অসহ্য যন্ত্রণার সকাল। সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবে যাদের জন্য ক্লাবহাউস চত্বরে ফুলের জলসা আগাম তৈরি। তারা কিনা মাত্র ১৩ ওভারে ৩৪-৫। পরের পর বাংলার উইকেট পড়ছে আর ইডেন দর্শককে গভীর কৃষ্ণকায় দুশ্চিন্তা গ্রাস করছে, একশো হবে তো? নাকি আরও কম? এ তো তিনদিনে ম্যাচ শেষ হয়ে যাবে।
ঘরোয়া ক্রিকেট এবং টেস্ট এদেশে শুরু হয় সকাল সাড়ে ন’টায়। ইডেনসহ পূর্বাঞ্চল ব্যতিক্রম। এখানে প্রতিদিন খেলা শুরু সকাল ন’টায়। সমস্যা হলো ন’টা থেকে সাড়ে ন’টার মধ্যে তাজা উইকেটে ওই যে আধঘন্টা এবং অন্তত ৩৬/৪২ বল, সেটা কখনও কখনও সামান্য ভেজা ওল্ড ট্রাফোর্ড পিচ সমতূল্য। বাংলা জীবন্ত উইকেটের ছক কষেছিল নিজেদের পেস বোলিংয়ের কথা ভেবে। টস হারার পর সেটা এমন নিম্নচাপের মতো ধেয়ে এল যে কিছু ক্ষয়ক্ষতি অনিবার্য ছিল। দু’তিনটি এমন যা ডেলিভারি বিরাট কোহলিকেও সমস্যায় ফেলার মতো।
এর মধ্যে অবশ্য অভিমন্যু ঈশ্বরণের আউট হওয়ার ধরন পড়বে না। অনেক বছর ধরেই এত সম্ভাবনাময় তিনি। আইটি প্রোগ্রাম তৈরির মতো কার্যত গবেষণাগারে তাঁকে তৈরি করেছেন সিনিয়র ঈশ্বরণ। দেরাদুনে ছেলের নামে স্টেডিয়াম তৈরি করেছেন। যেখানে কিছুদিন আগে বাংলা খেলে এল। ভারতীয় ক্রিকেটে অভূতপূর্ব ঘটনা। কিন্তু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট গবেষণাগারও একটা বৈশিষ্ট তৈরি করতে অসমর্থ—বুকের খাঁচা। ওটা কেউ নিয়ে আসে। কেউ ধাক্কা খেতে খেতে, হেরে হেরে নিজেই সেই ইস্পাত নিজের মধ্যে জন্ম দিয়ে ফেলে। অভিমন্যুর নক আউট ম্যাচগুলোতে গত কয়েক বছর যা পারফরমেন্স, তাতে সেকেন্ড ইনিংসে তিনি বাংলা ব্যাটিংয়ের নেতৃত্ব না দিতে পারলে ধরে নিতে হবে দু’টোর একটা ক্যাটেগরিতেও তিনি পড়েন না। আর না পড়লে চক্রব্যূহ থেকে বেরোবেন কী করে?
দুপুর দুপুর তুলসীদাস বলরাম চলে যাওয়ার খবর শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল এই যে বাংলা টিমটা গত কয়েক বছর চ্যাম্পিয়ন না হতে পারলেও রঞ্জিতে দাপিয়ে খেলছে , তার বলরাম কে? বছরকয়েক আগে অকালপ্রয়াত সুভাষ ভৌমিক চমৎকার ব্যাখ্যা করতেন, চুনী ছিলেন গ্ল্যামারের রাজপুত্র। পিকে শুটিং এবং পাওয়ার ফুটবলের চলমান নমুনা। পাশাপাশি বলরাম ছিলেন বাড়ির সেই ভৃত্য যাকে আপাত চোখেই পড়ে না। কিন্তু যে না থাকলে মনে হয় বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। ফিউজটাই যে উড়ে গিয়েছে। মনোজের বাংলা টিমে ‘বলরাম ‘বাছতে বেশি সমস্যা হওয়া উচিত নয়। তিনি অনুষ্টুপ মজুমদার। অনুষ্টুপ ধরেও ছিলেন খেলাটা। তিনি ও শাহবাজ লম্বা সময় উইকেটে থাকা। আর শাহবাজ ও অভিষেক পোড়েল সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ করা দু’টো সম্পূর্ণ ভিন্ন পৃথিবী। কিন্তু অনুষ্টুপ–টিমের তথাকথিত নন গ্ল্যামার বয় ব্যাকফুটে কাঁধের ওপর থেকে এমন একটা শট খেলতে গেলেন যা সকালের পিচ বিচারে গ্ল্যামার শট। অবিকল এক শট বিকেলে সৌরাষ্ট্র ওপেনার খেলে পয়েন্ট দিয়ে বাউন্ডারি পেলেন। আর রঞ্জি চ্যাম্পিয়নদের জন্য নির্দিষ্ট ক্লাবহাউসের বক্স নাম্বার ওয়ান-এ বসে সম্বরণ-শরদিন্দু আর আইবি রায় তিনজনেই সরব হতাশায় একমত হলেন, এক শট। দু’রকম পরিণতি। শুধু দু’ঘন্টা আগে পরে বলে।
দুঃসহ সকালের প্রহর কাটিয়ে বাংলা এক একটা বাউন্ডারি পাচ্ছে আর শাঁখের আওয়াজে ভরে যাচ্ছে ক্লাবহাউস চত্বর। দেখা গেল শঙ্খনিনাদের দায়িত্বে থাকা তরুণের নাম অশোক চক্রবর্তী। নবদ্বীপ থেকে এসেছে। সচিনের ভারতবিখ্যাত ফ্যান সুধীর গৌতমকে যেমন বোর্ড বা তারকা প্লেয়ারদের কেউ না কেউ খেলা দেখার ব্যবস্থা করে দেয়, অশোককেও তাই। সিএবি আমন্ত্রণ জানায়। সমস্যা হল ইডেনের ভয়ঙ্কর সকাল ন’টার সুযোগ যদি শুক্রবার না তুলতে পারে বোলাররা। তাহলে শাঁখের আওয়াজ আর রঞ্জি ট্রফি দুটোই অনেক দূরের মনে হবে। বলা হয়নি–ভারতীয় ক্রিকেটসার্কিটে এমুহূর্তের সবচেয়ে বিষণ্ণ ব্যক্তিটির সঙ্গে তিনতলার লাঞ্চ রুমে দেখা হয়ে গেল। প্লেটে অনেকটা দই। শুনলাম কলকাতায় অতীতে খেলতে আসার সময় থেকে মিষ্টি দইয়ের প্রেমে পড়েন। প্লেটের লাল দই যত উজ্জ্বল দেখাক, মুখ খুব মলিন। তিনি সদ্য স্টিং অপারেশন-ধস্ত চেতন শর্মা। শুক্রবারের প্রথম দু’ঘন্টা বাংলার পক্ষে না গেলে জাতীয় নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যানের চেয়েও মলিন মুখ বাংলার ড্রেসিংরুমে নিশ্চিতভাবে পাওয়া যাবে।
উনাদকাতদের জবাব দেওয়ার জন্য বাংলার সেরা বাজি অবশ্যই আকাশদীপ। হাইকোর্ট এন্ড থেকে যে গতিতে তাঁকে এদিন বল করতে দেখলাম তাতে সম্বরণ ও মনোজদের দুই টিম মিলিয়ে তাঁকে এগারোতে কমাতে গেলে আকাশদীপকে রাখতে হবে। মিডল অর্ডারেও একটা জায়গা খুলবে মনোজের জন্য। আর কেউ এখনকার টিম থেকে? অনুষ্টুপ? শাহবাজ? মুকেশ?
আগামী তিন দিন বলবে। ফাইনালের চাপ নিতে পারলে তবে না সেরা একাদশে ঢোকার প্রশ্ন!