রাজ্যপাল নিয়ে কী আবার জটিলতা শুরু হল এই বাংলায়? সময় বলবে, কিন্তু আলোচনা তো দরকার। আবার ঠিক এই সময়েই আবার নতুন করে রাজ্যপাল নিয়োগ হল বিভিন্ন রাজ্যে, সেই তালিকাও আলোচনাযোগ্য। তাই আজ আলোচনা রাজ্যপাল নিয়ে। বেশ কয়েকবার আগেই বলেছি, আবার বলছি, আত্তুক্কু থ্যাডিয়াম, নাত্তুক্কু গভর্নারম থেভাইল্লাই। বলেছিলেন ডিএমকে প্রতিষ্ঠাতা, তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী, যাঁকে সব্বাই শ্রদ্ধা করতো সেই সিএন আন্নাদুরাই। তামিল ভাষায় এই কথার মানে হল, ছাগলের দাড়ি ছাগলের জন্য জরুরি নয়, রাজ্যপাল পদটিও দেশের জন্য জরুরি নয়। কখন বলেছিলেন? ১৯৫২-তে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির গভর্নর শ্রী প্রকাশ সংখ্যালঘু কংগ্রেস দলের নেতা চক্রবর্তি রাজাগোপালাচারীকে সরকার তৈরি করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। রাজাগোপালাচারি তখন এমনকি নির্বাচিত বিধায়কও ছিলেন না। রাজ্যপাল শ্রী প্রকাশ তার আগে কংগ্রেস দলের হয়েই বিভিন্ন সরকারি পোস্টে ছিলেন এবং এসবের ফলাফল কী হলো? তামিলনাড়ু থেকে কংগ্রেস দলটাই উঠে গেল।
পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস বিরোধী হাওয়াতে ধোঁয়া দিয়েছিলেন রাজ্যপাল ধরমবীর। ধরমবীর গো ব্যাক মুখে মুখে ফিরেছে, কংগ্রেস দল ক্ষমতা হারিয়েছে শুধু তাই নয়, মানুষের সমর্থন হু হু করে কমেছে সেই তখন থেকেই। মানুষ নির্বাচিত করে সরকারকে, মুখ্যমন্ত্রী একটা নির্বাচিত পদ, সেখানে দিল্লি থেকে একজন এসে পোদ্দারি মারবে, এটা যে কোনও সচেতন মানুষের কাছে অপমানজনক মনে হতে বাধ্য, ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। একবার নয়, বহুবার বহু রাজ্যে যে যখন ক্ষমতায় এসেছেন, তারাই রাজ্যপাল পদের অপব্যবহার করেছেন। যার গায়ে লেগেছে তারা তখন বিরোধিতা করেছেন, আবার তারাই যখন ক্ষমতায় এসেছেন, তখন একই গল্পের পুনরাবৃত্তি।
উদাহরণ প্রচুর আছে, আমরা বরং মোটাভাইয়ের উদাহরণটাই দিই। ২০১২, নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি তখন ভাইব্র্যান্ট গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার, রাজ্যে রাজ্যপাল কংগ্রেসের নেতা কমলা বেনিওয়াল, একসময় রাজস্থানের উপমুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, কেন্দ্র সরকার ২৬/১১ র ঘটনার পর National Counter Terrorism Centre তৈরি করেছে। মোদিজি তার বিরাট প্রতিবাদ করছেন। তাঁর বক্তব্য, কেন্দ্র সরকার রাজ্যের কাজে দখলান্দাজি করছে, রাজ্যপাল কংগ্রেস সরকারের হয়ে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছেন। আজ্ঞে হ্যাঁ ২০১২, তিনি হুবহু এই কথা বলছেন, “grab power through the backdoor”। পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করছেন, মোদিজি বলছেন। তাঁর আশঙ্কা, “It’s a conspiracy to grab power through the backdoor… Already several opposition leaders are in CBI’s dragnet, now they are bringing in NCTC…” ভাবুন একবার, মোদিজি বলছেন, এমনিতেই সিবিআই দিয়ে ভয় দেখানো হচ্ছিল, এখন NCTC আনা হচ্ছে। ডঃ ওম নাগপাল স্মরণে এক সেমিনারে গিয়ে তিনি বললেন এবং কাগজে ছাপা হলো –
Modi also demanded Sarkaria Commission’s report on Centre-state relations and Justice Madan Mohan Punchhi’s report on Centre-state financial relations be implemented
“A meeting of Inter-state Council should be called immediately, and (it should be) twice a year,” Modi said.
Quoting Punchhi report, he said governors should not be a political person but the Centre, unfortunately, always thrusts on Gujarat not only a political person but someone who had a different political ideology.
অর্থাৎ সারকারিয়া কমিশনের রিপোর্টে কেন্দ্র ও রাজ্য সম্পর্কে যা বলা আছে বা বিচারপতি মদন মোহন পুঞ্চি কমিটির রিপোর্টে যা বলা আছে, তিনি তা লাগু করার কথা বললেন। কী বলা আছে বা কী কী বলা আছে, তা পরে বলছি। কিন্তু ভাবুন মোদিজি বলছেন, সারকারিয়া কমিশনের সুপারিশ লাগু করতে হবে। তিনি বলছেন, আন্তঃরাজ্য কাউন্সিলের বৈঠক বছরে অন্তত দু’বার করতে হবে। ওই বক্তৃতাতেই আমাদের প্রধান সেবক নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি বলছেন যে পুঞ্চি কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী রাজ্যপাল হিসেবে একজন রাজনৈতিক, মানে রাজনীতির মানুষকে কখনোই মনোনীত করা উচিত নয়, কিন্তু কেন্দ্র আমাদের ওপর আমাদের বিরোধী রাজনীতির একজনকে চাপিয়ে দিচ্ছে। অবাক হবেন না, এসব কথা বলছেন নরেন্দ্র মোদি। এবার সিনেমার নেক্সট সিন, মোদিজি প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যে রাজ্যে রাজ্যপাল নিযুক্ত হয়েছে, প্রতিটা নিযুক্তি রাজনৈতিক শুধু নয় ১০০% দলের। আরএসএস-এর লোকদের পাঠানো হয়েছে রাজ্যপাল হিসেবে। তাঁরা রাজ্যে গিয়ে একটাই কাজ করছেন, সেখানকার বিজেপি দলের হেডকোয়ার্টারের কাজ। ওখান থেকে উসকানি দেওয়া হচ্ছে, সরকার ভাঙার পরিকল্পনা হচ্ছে, ভাঙা হচ্ছে। মোদিজি মিথ্যে বলেন, ডাহা মিথ্যে বলেন আবার প্রমাণিত, তিনি মিথ্যেবাদী।
আসলে শুরু থেকেই রাজ্যপাল পদটি ওই রামছাগলের দাড়ির মতই অনাবশ্যক, একে কেবলমাত্র, কেন্দ্রে শাসক দলের ইচ্ছেমত কাজে লাগানোই হল, আসল উদ্দেশ্য। কিছুটা লোকাল থানার খোঁচরদের মতো এই পদকে ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের দিয়ে অনাবশ্যক বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে। প্রায় কোনও রাজ্যপালই তার ব্যতিক্রম নয়। ব্যতিক্রম নয় এটা কে বলছেন? বলছেন আমাদের কাঁথির টাচ মি নট খোকাবাবু। তিনি কিছুদিন ধরেই বলার চেষ্টা করছিলেন বাংলার বর্তমান রাজ্যপাল তেমন সক্রিয় নন, ওনার যতটা অ্যাকটিভ হওয়ার কথা উনি ততটা অ্যাকটিভ নন, মানে ধনখড় সাহেব যেভাবে নিয়ম করে প্রতিদিন রাজ্য সরকারের পিছনে লাগতেন, যেভাবে এক রাজ্যের নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাঁদের নেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলেই যেতেন, সেটা বর্তমান রাজ্যপাল তো করছেন না। যেই তিনি একটা রাজ্য সরকার বিরোধী বক্তব্য রাখলেন, ব্যস, ওমনি টাচ মি নট খোকাবাবু উল্লসিত, বললেন এই তো রাজ্যপাল ট্র্যাকে ফিরে আসছেন, মানে রাজ্যপালকে কেন্দ্র যে নির্দেশ দিচ্ছে, এতদিন পরে এইবার তিনি পালন করছেন। সত্যি সত্যিই বর্তমান রাজ্যপাল আনন্দ বোস তা করেন কিনা, তা আমরা দেখব, নজর রাখব। কিন্তু করলে, তা নতুন কিছু হবে না, আমরা চমকে উঠব না। বরং আমাদের অবস্থান আরও শক্ত পোক্ত হবে। আমরা যাঁরা মনে করি রাজ্যপাল এক অতিরিক্ত পদ, যা রাজ্যের নির্বাচিত প্রতিনিধি বা মানুষের নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধেই কাজ করার জন্যই তৈরি। মজার কথা হল, কংগ্রেস আজ এই কথা বলছে, কিছুদিন আগে পর্যন্ত তারা এই রাজ্যপালকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচিত সরকার ভেঙেছে, বিভিন্ন কারণে অকারণে নাক গলিয়েছে, সেদিন আজকের শাসকদল সেদিন বিরোধিতা করেছিল। খোদ নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, সক্রীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে রাজ্যপালের মনোনয়ন হওয়াটা কাম্য নয়। এখন তিনি সরকারে, গতকালই বেশ কিছু রাজ্যে রাজ্যপাল বদল হল, নতুন রাজ্যপাল এলেন, আসুন দেখা যাক তাঁরা কারা? ব্রিগেডিয়র বি ডি মিশ্র। টিভিতে এনাকে বহুদিন ধরেই মোদি সরকারের পক্ষে সরাসরি কথা বলতে দেখা গিয়েছে। ২০২২-এ তাঁকে মেঘালয়ে রাজ্যপাল করে পাঠানো হয়েছিল, এবার অরুণাচল প্রদেশে। কেন? এত তাড়াতাড়ি রদবদল কেন? হাজার হোক ইনি পলিটিসিয়ান নন, আর এবারে মেঘালয় ঝুলে গেলেও যেতেই পারে, কাজেই এখন থেকেই ঘুঁটি সাজিয়ে রাখলেন মোটাভাই, মেঘালয়ে গেলেন ফাগু চৌহান। ইনি কে? ঝানু রাজনীতিবিদ, বিহারে ১৯৮৫-তে দলিত মজদুর কিসান পার্টি দিয়ে যাত্রা শুরু, প্রথমবার এমএলএ হন নিজের তৈরি দলের, ১৯৯১-তে জনতা দলের টিকিটে। তারপর বিজেপিতে গেলেন, ১৯৯৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বিজেপির বিধায়ক, এরপর বিহারের রাজ্যপাল, এবারে মেঘালয়ে, হাং পার্লিয়ামেন্টে রাজ্যপালের খেল দেখানোর দায়িত্বে। মহারাষ্ট্রের নতুন রাজ্যপাল রমেশ বইস, বিজেপির পুরনো নেতা, সঙ্ঘের সঙ্গে দারুণ সখ্যতা, তিনবারের এমপি, অটলবিহারি মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী। আগে ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল হয়েছেন, এবার আরও ক্রুশিয়াল স্টেট মহারাষ্ট্র। কারণ সেখানের রাজ্যপাল বিজেপির কেবল নয়, আরএসএস-এর প্রচারক ভগত সিং কোশিয়ারীর সঙ্গে সিন্ধ্যে সরকারের বনিবনা হচ্ছিল না আর এই ভগত সিং কোশিয়রি আবার নীতিন গড়করির ভারি বন্ধু মানুষ, সব মিলিয়ে ওনাকে সরানো হল, আনা হল রমেশ বইসকে। বিহারে ফাগু চৌহানের জায়গায় আনা হল রাজেন্দ্র বিশ্বনাথ আরলেকরকে, ছোটবেলা থেকে আরএসএস করা আরলেকর গোয়া বিজেপির সভাপতি ছিলেন, মনোহর পারিক্কর মারা যাওয়ার পর সবাই ভেবেছিল, ওনাকেই মুখ্যমন্ত্রী করা হবে, হয়নি, সেই সময়েই ওনাকে হিমাচল প্রদেশের দায়িত্বে পাঠানো হয়েছিল, এবার বিহারে। লা গণেশন, কদিনের জন্য বাংলায় অস্থায়ী রাজ্যপাল ছিলেন, উনিও আরএসএস-এর প্রচারক ছিলেন, তারপর তামিলনাড়ুতে বিজেপির রাজ্য সভাপতি, তারপর মণিপুরের রাজ্যপাল, এবার নাগাল্যান্ডে। অনুসূইয়া উইকিয়ে মধ্যপ্রদেশের বিজেপি নেত্রী, বিধায়ক হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন, ওনাকে ছত্তিসগড়ে রাজ্যপাল করে পাঠানো হয়েছিল, এবার মণিপুর। ১৯৭১-এ জনসঙ্ঘতে যোগ দেওয়া বিশ্বভূষণ হরিচন্দ্রন পরবর্তীতে বিজেপির হয়ে ওড়িশার চিলকা থেকে দু’বার, একবার ভুবনেশ্বর সেন্ট্রাল থেকে নির্বাচিত বিধায়ক। এরপর তাঁকে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যপাল করে পাঠানো হয়। এবার অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যপাল করা হল একমাস হল অবসর নেওয়া সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আবদুল নাজিরকে, তিনি বাবরি মসজিদ মামলার বিচারক ছিলেন। বলা বাহুল্য, সেই রায় মোদি সরকারের পক্ষে গিয়েছিল। এবার বাকিটা বুঝে নিন, সমঝদারকে লিয়ে ইশারা কাফি হ্যায়। অসমে পাঠানো হল গুলাবচাঁদ কাটারিয়াকে, তিনি উদয়পুর থেকে বিজেপির এমপি ছিলেন, রাজস্থান বিধানসভার এমএলএ ছিলেন, মন্ত্রীও হয়েছেন, অসমে রাজ্যপালের তেমন কোনও ভূমিকা নেই, কিন্তু গুলাবচাঁদ রাজস্থানে বিজেপির কাছে সমস্যা হয়ে উঠেছিলেন, তিনি বিধানসভায় বিরোধী দলের নেতা ছিলেন, স্বভাবতই আগামী নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রীর দাবিদার, সেই জটিলতা কাটাতেই তাঁকে রাজ্যপালের সুখজীবন দেওয়া হল। ঠিক একইভাবে হিমাচলের রাজনীতি সাফ সাফাইয়ের জন্য উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেতা, একদা মোদি মন্ত্রিসভার সদস্য শিভ কুমার শুক্লাকে হিমাচলপ্রদেশে রাজ্যপাল করে পাঠানো হল। কোয়েম্বাটর থেকে একদা নির্বাচিত বিজেপি সাংসদ সিপি রাধাকৃষ্ণণকে ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল করে পাঠানো হল। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির হয়ে লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের মেম্বার লক্ষণ প্রসাদ আচার্যকে সিকিমের রাজ্যপাল করে পাঠানো হল এবং লেফ্টেন্যান্ট জেনারেল ত্রিভুবন পত্রনায়ককে অরুণাচল প্রদেশে পাঠানো হয়েছে রাজ্যপাল করেই, যিনি শাসক দলে ঘনিষ্ঠ বটে। কিন্তু সেই অর্থে সদস্য নন। এই রাজ্যপাল তালিকা বলে দিচ্ছে, সেদিন নরেন্দ্র মোদি যা বলেছিলেন, তা হয় মিথ্যে ছিল, আর নাহলে সেই বক্তব্য ছিল শুধু কথার কথা, যাকে বলে জুমলা।