হায় ধরিত্রী, তোমার আঁধার পাতালদেশে
অন্ধ রিপু লুকিয়েছিল ছদ্মবেশে…
অন্তরে তোর গুপ্ত যে পাপ রাখলি চেপে
তার ঢাকা আজ স্তরে স্তরে উঠল কেঁপে।
যে বিশ্বাসের আবাসখানি
ধ্রুব বলেই সবাই জানি
এক নিমেষে মিশিয়ে দিলি ধূলির সাথে,
প্রাণের দারুণ অবমানন
ঘটিয়ে দিলি জড়ের হাতে!
রবিঠাকুরের এই কবিতাখানি ছোট্ট মেয়েটা কোনওদিন পড়েনি হয়ত, হয়ত কেন, পড়েইনি। তা হলে তুরস্কের নিষ্প্রাণ ভূমিতটে, ধ্বংসের চার দেওয়ালের মাঝে এমন করে আগলে রাখা, মাত্র সাত বছরেই এমন করে স্নেহের ছায়ায় বাঁধল কীভাবে আস্ত দুনিয়াটাকে? সব হারানোর নিদারুণ কষ্টের মাঝেও সে এমন করে হাসে কেমনে? সাত বছর, এমন কীই বা বয়স! সংসারের মাথায় নিশ্চিন্ততার ছায়া দেওয়া বটগাছটা নেই, মাতৃস্নেহ এক লহমায় কেড়ে নিয়েছে ভয়াল ভূমিকম্প। তবুও সে হাসে খিলখিলিয়ে, এমন মায়াভরা চোখের দৃষ্টিতে হাপুস নয়নে কাঁদিয়ে দেয় দুনিয়াটাকে। হাহাকার, আর্তনাদ ছাপিয়ে জীবনের জয়গানে মুখরিত হয় তুরস্ক তথা গোটা বিশ্ব।
আরও পড়ুন: India vs Australia: নাগপুরে নয়া মাইলফলক স্পর্শ মহম্মদ শামির
একের পর এক ভূমিকম্প আর আফটারশকে মরিয়মের খেলাঘর ভেঙেচুরে খানখান হলেও, উঠোনের সাজানো খেলনাবাটি তছনছ হলেও, দুচোখে কী আশ্চর্য স্বপ্নের সোপান বেঁধেছে মেয়েটি। বই-খাতা যে কোথায় উড়ে গিয়েছে, সুখের ঘরকন্না নিমেষে ধূলিসাত হয়েছে, বেঁচে থাকার যাবতীয় নির্মাণ অসুখ হয়ে ঝরে ঝরে পড়ছে তুরস্কের মাটিতে, তবুও মরিয়ম নির্লিপ্ত। ভাই-অন্ত একরত্তির চারপাশের পরম নিশ্চিন্তের দেওয়ালের ইট, চুন, সুড়কি নিমেষে ধূলিকণায় পরিণত হয়েছে, তবুও তার চোখে জল নেই। ঠোঁটভরা হাসিতে ছোট্ট মেয়েটি বুঝিয়ে দিতে চাইছে, দেশজুড়ে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে থাকলেও ভাইকে আগলে যে রাখতেই হবে, বাবা-মা তো কোথায় হারিয়ে গেছে, ভাই যদি কেঁদে ওঠে, খাওয়ার বায়না করে, ওর যে বড্ড কষ্ট হবে। তাই তো ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, সান্ত্বনার এমন মোলায়েম স্পর্শ দিদি ছাড়া ভাইকে দেওয়ার যে আর কেউ অবশিষ্ট নেই। ভাইকে নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপে বন্দি রেখেই দূর থেকে মরিয়মের কানে আসে বেঁচে থাকার আর্তি, হায় আল্লাহ…
মরিয়মও মনে মনে সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করে, ভাইয়ের যেন কষ্ট না হয়, নিজের হাজার কষ্টেও ঠিক এমনি করেই ভাইকে আগলে রাখবে। আসুক না ঝড়, আসুক তুফান ভারী, মরিয়মের কাছে হার মানবে ধ্বংসের তাণ্ডবলীলাও। মরিয়মও যদি পড়ত রবিঠাকুর, নড়ে উঠত তার ঠোঁট,
উপর তলায় হাওয়ার দোলায় নবীন ধানে,
ধানশ্রীসুর মূর্ছনা দেয় সবুজ গানে।
দুঃখ সুখে স্নেহে প্রেমে
স্বর্গ আসে মর্ত্যে নেমে।
ঋতুর ডালি ফুল ফসলের অর্ঘ্য বিলায়,
ওড়না রাঙে ধূপছায়াতে
প্রাণনটিনীর নৃত্যলীলায়।
লেখ্যমাধ্যম, দৃশ্যমাধ্যম পেরিয়ে সামাজিক মাধ্যমের নিমেষে দুনিয়ার কাছে পৌঁছে যাওয়ার ঝটিকা ব্যবস্থায় ভাইকে আগলে রাখা মরিয়মের কাছে পৌঁছে যায় উদ্ধারকারী দল। সাত বছরের দিদির স্নেহছায়ায় ঢাকা চার বছরের ফুটফুটে ভাইকে উদ্ধার করে। বুকে চেপে রেখে গোটা একটা দিন আহারহীন, জলহীন মৃত্যুপুরীতে বাস করলেও মরিয়মের চোখে একফোঁটা জল দেখেনি গোটা বিশ্ব। চমকে উঠেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রস আধানম ঘেব্রেয়াসুসও। নিজের টুইটার হ্যান্ডেলে শেয়ার করেছেন মরিয়মের ভিডিও। সঙ্গে লিখেছেন, এমন সাহসী মেয়েটিকে অশেষ শ্রদ্ধা। রাষ্ট্রসঙ্ঘের এক প্রতিনিধি মহম্মদ সাফাও শেয়ার করেছেন ওই ছবি। তিনি লিখেছেন, ১৭ ঘণ্টা ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়ে রয়েছে নিজেই। বয়স মাত্র সাত বছর। তা সত্ত্বেও একহাত দিয়ে ভাইকে আগলে রেখেছে সে।
মরিয়ম আর তার ভাইকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ওরা ভাল আছে। সুস্থ আছে। ধ্বংসের মাঝে ঠিক এভাবেই যুগে যুগে মরিয়মরা রূপকথা লেখে, অস্তিত্বের দুই মলাটের মাঝে কাহিনি বোনে, ছোট্ট দিদি হয়েও ততোধিক ক্ষুদ্র ভাইয়ের প্রাণে মায়ের মমতা, বাবার প্রশ্রয়ের হাত রাখে, যে হাত কম্পন-দস্যুর টুঁটি টিপে ধরে অবলীলায়, প্রকৃতির রুদ্ররোষেও পশমের মতো নরম ভালবাসারই জয় হয়।
মরিয়ম, তোকে কুর্নিশ, কপালে একরাশ স্নেহচুম্বন। শেষে সেই রবিকবিকেই স্মরণ,
বিপুল প্রতাপ থাক না যতই বাহির দিকে
কেবল সেটা স্পর্ধাবলে রয় না টিকে।
দুর্বলতা কুটিল হেসে
ফাটল ধরায় তলায় এসে
হঠাত্ কখন দিগব্যাপিনী কীর্তি যত
দর্পহারীর অট্যহাস্যে
যায় মিলিয়ে স্বপ্ন মতো।