কলকাতা : রবিনসন স্ট্রিটের ছায়া বাগবাজারে। স্বামীর দেহ আগলে পড়ে রয়েছেন স্ত্রী ও মেয়ে। বিছানায় স্বামীর কঙ্কালসার দেহ পড়েছিল তার পাশেই শুয়ে ছিলেন তাঁর স্ত্রী।
এই খবর সংগ্রহ করতে পৌঁছলাম বাগবাজারে। বাগবাজার ঘাট সংলগ্ন একটি বাড়ি, নাম ক্ষীরোদ মঞ্জিল। বৃহদাকার বাড়ির বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভেতরে আলো পর্যন্ত পৌঁছায় না। বাড়ির জানলাগুলি বহুদিন কেউ খোলেনি। তাও সাহস করে বাড়িতে ঢুকলাম। বাড়িতে প্রবেশের মুখে একটা গেট। ভেতরে বসে রয়েছেন এক বৃদ্ধ। তিনি নাকি বাড়ির কেয়ারটেকার। দীর্ঘদিন ধরেই এ বাড়িতে থাকেন। বাড়ির ওপরেই এরকম একটা কাণ্ড ঘটে গেছে, অথচ তিনি কিছুই টের পাননি। অবাক হলাম। জানতে চাইলাম কখনও গন্ধ পাননি ? এর উত্তরে তিনি জানালেন, ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে তিনি ওপরে উঠতেন না। উপরে যারা থাকেন তাঁরা তাঁকে উঠতে দিতেন না।
তাঁর মুখ থেকেই জানলাম, ৮৪ বছরের বৃদ্ধ দিগ্বিজয় বসু আগে অভিনয় করতেন। পরে শরীর খারাপ হতে বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় দিন কাটাতেন তিনি। যা বাড়িভাড়া পেতেন, তাই দিয়ে দিন চলত তাঁর। দিগ্বিজয় বাবুর স্ত্রী গৌরী ও মেয়ে, দুজনেরই মানসিক সমস্যা আছে বলে জানান তিনি। এসব কথা শুনতে শুনতে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। জানতাম না উপরে কি অপেক্ষা করছে। কিছুটা উপরে উঠতেই নাকে বীভৎস গন্ধ এল। অন্ধকার সিঁড়িতে হাতে টর্চ না থাকলে দিনের আলোতেও হোঁচট খেয়ে পড়ার জোগাড়। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে কোনও রকমে উপরে উঠলাম। উপরে উঠতেই আরেকটি গেট চোখে পড়ল। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। পর পর বেশ কয়েকটা ঘর। সবকটা ঘরে রয়েছে জিনিসপত্র। জামাকাপড় পড়ে রয়েছে সব দিকে। আধো আধো আলোতে যেটুকু দেখা যায়, সেখানেই আবর্জনার স্তুপ। কোনও সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এভাবে থাকা রীতিমতো অসম্ভব। এলাকার লোকজন বলছিলেন, দিগ্বিজয় বাবু সুস্থই ছিলেন। তাঁর কোনও মানসিক সমস্যা ছিল না। তারপর চোখে পড়ল একটি ঘর। সেই ঘরে একটি বিছানায় শুয়ে রয়েছেন এক বৃদ্ধা। সেই ঘরেও রয়েছে ওই গন্ধ। পরে জানা গেল, উনি দিগ্বিজয় বাবুর স্ত্রী।
আরও পড়ুন : রবিনসন স্ট্রিটের ছায়া বাগবাজারে
ঘরেই বিছানাতে স্বামীর কঙ্কালসার দেহের পাশেই শুয়ে ছিলেন স্ত্রী। সেই ঘরের দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে একটি ছবি। ছবিতে দেখা গেল, গলায় বেশকিছু মালা পড়ে বসে রয়েছেন এক ভদ্রলোক। উনি দিগ্বিজয় বসু। পুজোর সঙ্গে তন্ত্র সাধনা করতেন তিনি বলেও জানা গেছে। পাশের ঘর থেকে খুব চিৎকারের শব্দ। দিগ্বিজয় বাবুর মেয়ে বাড়িতে এত লোকের প্রবেশ মেনে নিতে পারছিলেন না। পুলিশ তাঁকে পাশের ঘরে বন্ধ করে তদন্ত চালাচ্ছিল। তা না করলে কাউকে কোনও ভাবেই বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতে দিচ্ছিলেন না তাঁর মেয়ে। স্থানীয়দের বক্তব্য, মেয়ের জন্যই বাড়ির ভেতরে কেউ প্রবেশ করতে পারত না। বাইরের লোক দেখলেই তাঁকে মারত। কখনও আবার গালিগালাজ করত সে। যদিও তাঁকে চাক্ষুষ দেখার সুযোগ আমরা পাইনি। পুলিশ তাঁকে পাশের ঘরে তালা বন্ধ করে রেখে দিয়েছিল। কিন্তু সেই মেয়ে বাইরে থাকলে হয়তো বাড়ির ভেতর আমাদের কাউকেই প্রবেশ করতে দিত না।
ক্ষীরোদ মঞ্জিলের ভেতর বেশিক্ষণ থাকা যাচ্ছিল না। তাছাড়া ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে গায়ে কাঁটা দিতে বাধ্য। বাগবাজারের এই বাড়িতে দিনের বেলাতেও গা ছমছম করে। সেই বাড়ি থেকেই এক বীভৎস অভিজ্ঞতার চিত্র বহন করে নিয়ে এলাম।