কতদিন ধরেই মাথার মধ্যে বাজে আলোর বেণু, শুনতে পাই স্পষ্ট, দেবতাগণ সানন্দে দেখলেন, দুর্গা মহিষাসুরকে শূলে বিদ্ধ করেছেন আর খড়্গনিপাতে দৈত্যের মস্তক ভূলুণ্ঠিত। অসুর মরেছে। তারপর দেহি সৌভাগ্যমারোগ্যং দেহি দেবি পরং সুখম্ । রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।। কতদিন আগেই তো সকালে উঠেই মনে হয় এই আলোই তো পুজোর দিনের আলো, শিউলি ফুলের গন্ধও তো কতদিন আগে থেকেই পাই আর সাদা মেঘেরা বলে দেয় মা আসছে। শুকতারা আর কিশোরভারতী বলে দিত পুজো আসছে। আর একদিন সত্যিই সকালে দেখতাম ঢাক বাজছে, কলা বৌ’কে চান করিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে, দুগ্গা ঠাকুর মণ্ডপে, মুখের আবরণ খুলে নেওয়া হয়েছে। আজও ঠিক তাই, রাত পোহালেই কলা বৌ-এর চান। এসেই গেল দুগ্গাপুজো। আমাদের দুই মহাপুরাণ রামায়ন আর মহাভারত, কিন্তু জমির দখল, পাঁচটা গ্রামের স্বত্ব, নারী, ভূমি এবং ক্ষমতার দখল, লড়াইয়ের গল্প। মধ্যে অনেক ভাল ভাল কথা আছে, কিন্তু মোদ্দা কথা ওটাই। কে বসবে সিংহাসনে, রাজত্ব কার? ভূমি কার? নারী কার? এই তো। কিন্তু সে গল্পের শেষে অন্যায়ের শেষ, পাপের শাস্তি, তমসো মা জ্যোতির্গময়, অন্ধকার কেটে আলো আসুক। গল্পের শুরুতেই, আখ্যানের গোড়াতেই পাপকে চিহ্নিত করা হয়েছে, পাপীকে চিহ্নিত করা হয়েছে, রাবণ যে অন্যায় করেছেন, তাকে বধ করেই যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা হবে, তা নিয়ে কোনও দ্বিধা শুরু থেকেই নেই। কৌরবরা যে ধূর্ত, তারা যে পাপী, তারা যে অন্যায়ভাবে পাণ্ডবদের বঞ্চিত করতে চাইছে, তা শুরু থেকেই বলা হয়েছে, শেষে আমরা দেখছি তাদের প্রত্যেকে নিহত, পাপের পরাজয়, ন্যায়ের উথ্বান হল শেষ কথা। দুর্গাপুজোও তাই, এক শক্তিশালী দৈত্য, অসুরের অত্যাচার থেকে বাঁচতে দেবতাদের সম্মিলিত শক্তির প্রকাশ দেবী দুর্গা, তিনি অসুরকে হত্যা করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করছেন, পাপীকে শাস্তি দিচ্ছেন। কত হবে নাস্তিকদের সংখ্যা এই বাংলায়? ৩৪ বছর বাম শাসনের পরেও বড়জোর ৪/৫ শতাংশ, বাকিরা বিশ্বাস করেন এই ন্যায় প্রতিষ্ঠায়, এই পাপীকে শাস্তি দেবেন দেবী, ভগবান, এই ন্যারেটিভ মেনেই বলেন পাপ কোরো না, এই ন্যারেটিভ থেকেই জন্ম নিয়েছে নরকের ছবি। সাধারণ ধর্মভিরু মানুষ অন্যায় করার আগে দশবার ভাবেন। একই কথা প্রযোজ্য অন্য ধর্মের মানুষজনদের ওপরে। তাঁরাও বিশ্বাস করেন, তাঁদের গড, তাঁদের আল্লা সব দেখছেন, তিনিই বিচার করবেন, তাঁর ওপরে কেউ নেই, তিনিই সর্বশক্তিমান। কয়ামতের দিন তিনিই হিসেব নেবেন। যাঁরা ধর্মে বিশ্বাস করেন, তাঁরা কি সত্যিই তাঁদের ভগবানের এই সর্বশক্তিমান অস্ত্বিত্বের কথা বিশ্বাস করেন? মনে করেন, যে অন্যায় করলে ভগবান, আল্লা, গড শাস্তি দেবেন, কারণ তিনি বা তাঁরা সর্বশক্তিমান? সত্যিই মন থেকে এই কথা বিশ্বাস করলে পৃথিবীতে এত ঝামেলাই থাকতো না। মহাদেব, শিব এক প্রবল ক্ষমতাশালী দেবতা, ধ্বংস তাঁর ত্রিশূলের ডগায়। তো তাঁর মন্দির যদি কেউ অন্যায়ভাবে দখল করে, তাহলে তিনিই সেই অন্যায়ের প্রতিকার করবেন। কাশীর শিবমন্দিরে বিধর্মীরা যদি কোনও অন্যায় জবরদখল করেই থাকে, তাহলে শিবজিই ব্যবস্থা নেবেন, এটা তো ভাবা উচিত। কিন্তু না ভক্তরা তো এভাবে ভাবে না, তারা নিজেরাই গুঁড়িয়ে দিতে চায় জ্ঞানবাপী মসজিদ, রক্ষাকর্তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে চায় অবোধ ভক্তের দল। রাম, বিষ্ণুর অবতার, তাঁর জন্মস্থান দখল করে রেখেছে শুধু নয়, তার ওপরে মসজিদ তৈরি করা হয়েছে, রাম অমন বলশালী রাবণ আর তার বিশাল বাহিনীকে কচুকাটা করতে পারলো, কিন্তু একটা মসজিদ ভেঙে ফেলতে পারলো না? ভক্তদের কোদাল কুড়ুল নিয়ে নামতে হল? আমাদের ভগবানকে অপমান করা হয়েছে, কোন ভগবান? যিনি নাকি সর্বশক্তিমান, আমাদের আল্লা, আমাদের পয়গম্বরকে অপমান করা হয়েছে, যিনি নাকি নিজেই সর্বশক্তিমান বা তাঁর দূত, অতএব মারমুখি ভক্তরা রাস্তায়, আল্লাকে, পয়গম্বরকে অপমান করা হয়েছে, তাই কুপিয়ে খুন করো, গুলি চালাও, গরু স্বয়ং ভগবতী, সেই মাংস খাচ্ছে? খুন করো, পিটিয়ে মেরে দাও। আসলে এই ভক্তদের এতটুকুও বিশ্বাস নেই ভগবানে, আল্লায়, গডে। পৃথিবীতে না খেয়ে মরেছে যত মানুষ, অসুখে বিশুখে মরেছে যত মানুষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মারা গিয়েছে যত মানুষ, তার থেকে ঢের বেশী মানুষ মারা গিয়েছে ধর্মবিশ্বাসীদের নিজেদের লড়াইয়ে, দাঙ্গায়, ক্রুসেডে, যুদ্ধে। কারণ যাঁরা ধর্ম বিশ্বাস করেন, তাঁদের বেশিরভাগেরই সত্যি করেই ভগবান, আল্লা, গডের সর্বশক্তিমান অস্তিত্বে বিশ্বাস নেই। অথচ সেই আমরাই আগামী দিন পাঁচেক দেখবো এক প্রকাণ্ড বলশালী অসুর ত্রিশূলের ডগায় বিদ্ধ হয়ে দেবী দুর্গার পায়ের তলায় পড়ে আছে। ভাগবান, আল্লা, গড-এ বিশ্বাসী মানুষজন তাঁদের নিজের নিজের ভগবানকে রক্ষা করার দায় নিজের কাঁধে নিয়েছেন, যাঁরা নাকি নিজেরাই বিশ্বের রক্ষাকর্তা। অথচ প্রত্যেক ধর্মে, তাঁদের পুরাণকথায়, তাঁদের ধর্মগ্রন্থে অহিংসা, সত্য, ন্যায়, সততার কথা বলা হয়ছে। গুড সামারিটান হওয়ার কথা বলা হয়েছে, বসুধৈব কুটূম্বকম-এর কথা বলা হয়েছে, নিজের রোজগারের এক অংশ গরীব আতুরদের দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে ধর্মের ভিত্তিতেই বিশ্বজুড়ে হানাহানি, হত্যা, রক্ত, ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। তাকিয়ে দেখুন প্রত্যেক ধর্মের অনুষ্ঠান উৎসবের দিকে, সে উৎসবে যাতে সবাই অংশ নিতে পারে, তার কত ব্যবস্থা। চার্চ থেকে সাহায্য যাবে তাদের কাছে যাদের ততটা নেই, মুসলমানরা জাকাত দেবেন, তাঁদের ফিরতা আছে, শিখদের তো বচ্ছরভোর লঙ্গর আছে, হিন্দুদের মোচ্ছবে হাজার হাজার মানুষকে খাওয়ানো হয়। এক এই দুর্গাপুজোয় কত মানুষের রোজগার, পুজোর আগে, পুজোর পরে সে রোজগার হাসি ফোটায় কত শত মানুষের মুখে, উৎসবে ঘুরতে থাকে এক সার্বজনীন অর্থনৈতিক চাকা, লক্ষ কোটি টাকার আবর্তনে কেউ বোনাস পায়, জামা কেনে, কেউ জামা বেচে লাভ করে, কেউ মিষ্টি বেচে, কেউ ঢাক বাজিয়ে, কেউ মন্ত্র পড়ে, ইলেক্ট্রিসিয়ানদের তো পোয়া বারো, ফুচকাওলা থেকে রেস্তোরাঁ সেই চাকা ঘোরে। একই ছবি রমজানের শেষে খুশির ইদে, সেই ছবিই আর ক’দিন পরে বড়দিনে। সেই উৎসবেই বেঁচে থাকা কি খুব অসম্ভব? একজন মানুষ যিনি দুগ্গাপুজোয় ক্ষীরকদম কিনে আনলেন, তিনিই কি বড়দিনে কেক কেনেন না? রমজানে হালিম? আমাদের বিজয়াতে আমরা কোলাকুলি করি না? সেই আনন্দে থাকেন না আমাদের বন্ধুরা? ইমানুল বা ইমতিয়াজ বা শামিমভাই? তাহলে কোন ফাঁকে ঢুকে পড়ে বিদ্বেষ? কোন ছল-চাতুরিতে আমরা ঘৃণা জমিয়ে নিতে থাকি ফুসফুসে? কোন আড়ালে আবডালে বিষাক্ত শব্দমালা জন্ম নেয়? আমরা সবাই হয়ে উঠি ওরা আমরা? সবচেয়ে বড় কথা কারা এই বিষ বয়ে আনছে? ছড়িয়ে দিচ্ছে সমাজে? আমি সব সমাজের কথাই বলছি, বিষ তো একধার থেকে ছড়ানো হয় না, এরা একে অন্যের পরিপূরক। পয়গম্বর নিয়ে কী লিখেছে জানা নেই, কিন্তু সালমান রুশদিকে হত্যার চেষ্টায় আনন্দিত হন এক মানুষ, কেন? হুসেইন-এর আঁকা স্বরস্বতীতে নগ্নতা খুঁজে বার করে সেই শিল্পীকে দেশছাড়া করা হয়, কারা করেন? আসলে এই সবাই মিলেমিশে থাকায়, সবার উৎসবে মেতে ওঠার, গরীব, বড়লোক, বিত্তবান প্রত্যেকের এক সামাজিক ভূমিকার কথাকে যারা অস্বীকার করতে চান, যারা খোপে খোপে আলাদা করে রাখতে চান মানুষকে, তারাই এই বিষ ছড়ান, তাঁদেরই বিষের ভার বহন করছে আধুনিক বিশ্বের মানুষজন। সারা পৃথিবীতে ধর্ম, বর্ণের থেকে জন্ম নেওয়া হিংসাকে রুখতে যে সারভেল্যান্স সিস্টেম, রাস্তাঘাট, ট্রেন, প্লেন সর্বত্র যে সুরক্ষা ব্যবস্থা তার একটা হিসেব বার করেছেন জাস্টিনা আলেকজান্ড্রা সাভা, তাঁর হিসেবে এই সুরক্ষা খাতে বিশ্বজুড়ে ৭২.৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে ২০২১ সালে। মানে কমবেশি ৬০ হাজার কোটি টাকা। চোখ বন্ধ করে ভাবুন, কত মানুষের খাবার জুটত, কত শিশুর দুধ, কত স্কুল হতো এই পয়সায়, কত কলেজ, চিকিৎসা পেত কত মানুষ। এক বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা খরচ কেন? কারণ অত্যন্ত ধার্মিক লোকজন তাঁদের ঈশ্বর, আল্লা বা গডের ওপর ভরসা না রেখে তাঁদের ধর্ম বাঁচানোর জন্য মানুষ খুন করছেন, বোমা ফাটাচ্ছেন, আগুন লাগাচ্ছেন। অথচ কী হতে পারত? তা কিন্তু শিখিয়েছে দক্ষিণ, মধ্য আর দক্ষিণ পূর্ব আফ্রিকার জনজাতি, যাদেরকে ইউরোপ অসভ্য, জংলি বলেছে বহুকাল। তাদের ভাষায় একটা শব্দ আছে উবুন্তু, বান্টু ভাষার এই শব্দের মানে হল, আমি আছি, কারণ তুমি আছো, আই অ্যাম বিকজ ইউ আর। সাহেবরা গিয়েছিল এক প্রত্যন্ত গ্রামে, তারা এক রাশ কমলা লেবু একটা জায়গায় রেখে বাচ্চাদের বলল, যাও যে আগে পৌঁছবে সে তত বেশি পাবে, ছোটবেলা থেকে প্রতিযোগিতার মানসিকতা তৈরি করার জন্যই সাহেবদের এই শিক্ষা দান। বাচ্চারা উবুন্তু উবুন্তু বলতে বলতে একসঙ্গে গেল ওই কমলা লেবুর স্তুপের কাছে, তারপর সবাই ভাগ করে নিল। উবুন্তু, মানে আমি আছি কারণ তুমি আছো, তুমি না থাকলে আমার অস্তিত্বই থাকবে না। প্রত্যেক ধর্ম এই উবুন্তুর কথা বলে গিয়েছে, বলে গিয়েছে সব্বাই মিলে বাঁচার কথা। আসুন এই উৎসবে সেই কথাই আমরা বলি। দুগ্গাপুজো এসে গেল, জোরসে বলুন উবুন্তু, উবুন্তু। আমি আছি কারণ তুমি আছো।