সঙ্ঘের গুগলি। মহারাষ্ট্রের কুর্সিতে তির-ধনুক রেখেই রাজ পদ্মের। অথবা বালাসাহেব ঠাকরের পাদুকা সিংহাসনে রেখে একনাথ শিণ্ডেকে বকলমে রাজত্ব তুলে দিল বিজেপি। তাবড় সংবাদ মাধ্যমকে বোকা বানিয়ে মারাঠা মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন শিণ্ডে। যাঁকে কলের পুতুল করে রাজ্য শাসনের তলোয়ার হাতে রাখল সঙ্ঘ শিবির। এ যাবৎকালের সেরা চমক দিল বিজেপি নেতৃত্ব। যাতে সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না।
একসময় বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও রাতারাতি শরদ পাওয়ারের এনসিপি এবং কংগ্রেসের ছকে সংখ্যালঘু হয়েও মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন উদ্ধব ঠাকরে। তারপর থেকে ব্ল্যাক মেলিংয়ের রাজনীতির হাড়িকাঠে মাথা দিয়ে একের পর এক হিন্দুত্ব বিরোধী পদক্ষেপ করেছেন উদ্ধব। অথচ, তাঁর দলের যেসব বিধায়ক জিতে এসেছেন, তাঁরা তাঁদের এলাকায় বালাসাহেবের আদর্শ ভাঙিয়েই করেকম্মে খেয়েছেন। তাই সবথেকে অসুবিধায় পড়েছিলেন তাঁরাই, বিশেষত রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে আজও বালাসাহেব ঠাকরেকে ভগবানের রূপে পুজো করা হয়। তাই শিবসেনার ভিতরে সিঁদ কাটতে বেগ পেতে হয়নি বিজেপিকে থুড়ি সঙ্ঘকে। কারণ, গ্রামীণ এলাকার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সঙ্ঘ দীর্ঘদিন ধরে এর বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে এসেছে। তাই শিণ্ডের নেতৃত্বে যখন ভাঙনের ডাক ওঠে, গোটা মারাঠা রাজ্যের কোথাও উদ্ধবের পক্ষে শিবসৈনিকরা দাঙ্গা-হাঙ্গামা করেননি।
অথচ এর আগে মুম্বইসহ মারাঠা রাজ্যে যখনই হিন্দুত্ব নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠেছে, তখনই ত্রিশূল হাতে ভাঙচুর, মারদাঙ্গা এমনকী একাধিকবার ফতোয়া জারি পর্যন্ত হয়েছে। মুম্বইয়ে ঘটা একের পর এক দাঙ্গায় হাত লাগিয়েছে শিবসেনা। বিহারি খেদাও থেকে অবৈধ বাংলাদেশিদের বিতাড়নের আন্দোলন করেছে তারা। তাতে বস্তি জ্বালানো থেকে খুন পর্যন্ত হতে হয়েছে অনেককে। শিবসেনার অধিকাংশ নেতাকে তখন বাহুবলি আখ্যা দেওয়া হতো। সেই হিন্দুত্ব থেকে উদ্ধব ঠাকরে কুর্সির টানে বালাসাহেবের চিরশত্রু কংগ্রেস ও এনসিপির সঙ্গে হাত মেলানোয় দলের অভ্যন্তরেই ঘোর অসন্তোষ ছিল। তার প্রধান কারণই হল, উদ্ধবের সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক ক্ষমতা ছিল না। তিনি ছিলেন জোটের পুতুল।
আরও পড়ুন: Devendra Fadnavis: মন্ত্রী হবেন না, মুখ্যমন্ত্রী শিণ্ডের পাশে থাকবেন, বার্তা ফড়নবীশের
ইতিহাস বলে, বালাসাহেবের সঙ্গে বিজেপির ঘনিষ্ঠতার কারণই হল উগ্র হিন্দুত্ব। কিন্তু, তিনি কোনওদিন ক্ষমতার গদি আঁটা চেয়ারে বসেননি। বসতে চাননি। কিন্তু, মারাঠা সাম্রাজ্যের রিমোটটি ছিল তাঁর হাতেই। বিজেপি রাজ করলেও বালাসাহেব ছিলেন অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক। এককথায় কিং মেকার। এবং তা শুধু নিজের রাজ্যেই নন, রাজধানী দিল্লির রাজনীতির চাবিকাঠিও নিজের হাতে রেখেছিলেন।
সেই একই খেলা এবার খেলল বিজেপি। নেপথ্যে সঙ্ঘ। তাই বাইরে থেকে বিরাট ঔদার্যের দৃষ্টান্ত রেখে জাদুছড়ি নিজেদের কাছে রাখল তারা। এতে সুবিধা কী? প্রথমত, শিণ্ডে গোষ্ঠীর বিধায়ক তথা মন্ত্রীদের নিজেদের তাঁবে রাখা। দ্বিতীয়ত, অন্তর্বর্তী সময়ের মধ্যে নির্দল বিধায়কদের ভাঙিয়ে আনা। কেননা, বিধানসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়েও তারা এখনও ম্যাজিক ফিগারে যেতে পারেনি। শুধু তাই নয়, সরকারের মধু খেয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়া কংগ্রেস এবং পাওয়ারের দল ভাঙানো। এমনকী উদ্ধবের ঘরে যে কয়েকজন বিধায়ক পড়ে রয়েছেন, দুর্নীতির তদন্তের ভয় দেখিয়ে তাঁদেরও পকেটে পোরা।
তৃতীয়ত, সরকারের বিরুদ্ধে অভাব-অভিযোগই হোক, কিংবা দুর্নীতির অভিযোগ সবই যাবে শিণ্ডের ঘাড়ে। তাদের কোনও দায় থাকবে না।
চতুর্থত, উদ্ধবের শিবসেনার নিচুস্তরে দল ভাঙিয়ে শিণ্ডে গোষ্ঠীকেই বালাসাহেবপন্থী শিবসেনায় পরিণত করা। সেটা করতে বিজেপি সমর্থ হলে বালাসাহেবের ব্ল্যাক মেইল করা রাজনীতির শেষমেশ প্রতিশোধ তুলতে পারবে এতদিনে। একইসঙ্গে উদ্ধবের অ্যাকাউন্টে বালাসাহেবের পুত্র ছাড়া আর কোনও রাজনৈতিক ব্যালেন্স পড়ে থাকবে না। ঠিক যেমনটি হয়েছিল কংগ্রেসের ক্ষেত্রে। একসময় ইন্দিরা গান্ধী যখন দল ভেঙেছিলেন, তখন তাঁর দলকে বলা হতো ইন্দিরা কংগ্রেস বা কংগ্রেস (আই) আর জাতীয় কংগ্রেসকে বলা হতো সিন্ডিকেট। শেষে ইন্দিরার ভোটে জেতার পর মূল কংগ্রেসের অবলুপ্তি ঘটে এবং সবটাই ইন্দিরার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। তেমনটাই উদ্ধবের ভবিষ্যৎ করে ছাড়তে চলেছে সঙ্ঘ। কেননা, শিবসেনার উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলেই, তাদের মারাঠা-বিজয় সার্থক হবে।
আরও পড়ুন: Maharashtra Crisis: মহারাষ্ট্রের নতুন মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন একনাথ শিণ্ডে, ঘোষণা ফড়নবীশের
সুতরাং, যাঁরা মনে করছেন ক্ষমতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে বিজেপি বিরাট ঔদার্য দেখিয়েছে, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। শিণ্ডে হলেন বিজেপি বা সঙ্ঘের কাছে অশ্বত্থামা। যাঁকে রণে হত বলতে পারলেই দ্রোণাচার্য ওরফে উদ্ধব ঠাকরে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করবেন। আপ্তবাক্য তো আছেই সত্য, ন্যায়নীতি— রণনীতি ওরফে রাজনীতির বিষয় নয়। তা না হলে, রাম বালিকে হত্যা করেছিলেন কোন নীতিতে, কিংবা নিরস্ত্র কর্ণকে মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন কৃষ্ণ, কোন ক্ষত্রিয় নীতিতে! আসলে সঙ্ঘের হিন্দুত্ব নীতিও যে চলে এঁদেরই আদর্শে।