অ্যামাজনে ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে ভারতের সংবিধান বই আকারে পাওয়া যায়৷ ইংরেজিতে অসুবিধে হলে বাংলাতেও পাওয়া যায়। দেশ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে হলে এই বইটা পড়তেই হবে, কিনে নিতে হবে, হাতের কাছে রাখতে হবে৷ না হলে হাস্যকর আবোল তাবোল অশিক্ষিত কথাবার্তা বলে যেতেই হবে, সব্বাইকে, সব্বাইকে। বিরোধী, শাসক দলের প্রত্যেক নেতাকে, প্রত্যেক রাজনৈতিক কর্মীকে, প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষকে। আমি তো বলব সরকারের উচিত, প্রতিটা পাড়ায়, এলাকায় একজন শিক্ষককে রাখা, যিনি স্থানীয় ক্লাবে মানুষজনকে জড়ো করে, সংবিধানের মূল বিষয়গুলো বোঝাবেন, পড়াবেন, শেখাবেন। এতে অনেক সমস্যা দূর হবে৷ সাত সকালে হঠাৎ করে কোনও ছোটা মোটা ভাই যদি আপনার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন করে, নাগরিকত্বের প্রমাণ দেখতে চায়, তাহলে সংবিধান খুলেই দেখিয়ে দেওয়া যাবে যে সগুষ্টি সেই মোটাভাই, ছোটা মোটা ভাই থেকে নির্মলা সীতারমন নাগরিকদের ভোটেই নির্বাচিত, এবং যিনি ভোট দিয়ে নেতা মন্ত্রীদের নির্বাচন করেছেন, তাঁর কাছ থেকে নাগরিকত্বের প্রমাণ চাইলে, তাঁরও অধিকার আছে, তিনি সপাটেই বলতে পারেন হাম কাগজ নহিঁ দিখায়েঙ্গে, আমি কোনও কাগজ দেখাবো না। ওই সংবিধানটাই যদি পড়া থাকে, তাহলে জানা যাবে যে, না স্যর হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রভাষা নয়৷ আমাদের একটা রাষ্ট্রভাষা বলে কিছু নেই৷ রাষ্ট্র অনেকগুলো ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, হিন্দি তার মধ্যে একটি মাত্র৷ কাজেই মোটাভাই বা অজয় দেবগণ যে যাই বলুক না কেন, আমাদের মাতৃভাষার বদলে আরেকটা কোনও ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার কোনও অধিকার কারও নেই, রাষ্ট্রপতিরও নেই।
এই সংবিধানটা পড়া থাকলে মানুষ জানতে পারবে, দেশের নাগরিক হিসেবে আমার নিজের ইচ্ছে মতো খাবার খাওয়া, পোশাক পরা, সভা সমাবেশ বা মিটিং বক্তব্য রাখার অধিকার আছে। আম জনতার সংবিধান পড়া উচিত, রাষ্ট্রের উচিত দেশের প্রত্যেক নাগরিককে একটা লিখিত সংবিধান দেওয়া, সংবিধান বোঝানো। এইসব বলার সঙ্গে সঙ্গেই খেয়াল রাখুন দেশের ৩০/৩২% মানুষ এখনও নিরক্ষর, ২০/২৫% এমন মানুষও আছেন, যাঁরা নিজের নাম সই করতে পারেন বলে স্বাক্ষরের দলে নাম লেখানো আছে৷ কিন্তু তাঁরাও সংবিধান পড়ে উঠতে পারবে না, পড়তে পারলে বুঝে ওঠা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কী মজার ব্যাপার তাই না, যে সংবিধানে আমার অধিকারের কথা লেখা আছে, যে সংবিধানে ভারতবর্ষ এক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলে লেখা আছে, সেই সংবিধান দেশের কম বেশি ৫০% মানুষ পড়ে উঠতে পারবেন না, বোঝা বা বোঝানো বহু পরের ব্যাপার। আম আদমির কথা বাদ দিয়ে, তথাকথিত শিক্ষিত মানুষজনের কথায় আসা যাক, সেখানেও সংবিধান নিয়ে বিরাট অনীহা৷ যে বই আমার দেশ, আমার রাষ্ট্র, আমার অধিকার, রাষ্ট্রের গঠন, নির্বাচন, আইন নিয়ে শেষ কথা বলে, সেই বই হওয়া উচিত অবশ্যপাঠ্য, গীতা, বাইবেল, কোরান, ত্রিপিটক, জেন্দাবেস্তার আগে প্রত্যেক নাগরিকের দেশের সংবিধান পড়া উচিত, কিন্তু পড়েন না। এবং সাধারণভাবে অশিক্ষা, বিশেষভাবে সংবিধান স্বীকৃত অধিকার জানা না থাকার ১০০% সুযোগ নেন দেশের রাজনৈতিক নেতা, পুলিস, প্রশাসন। ধরুন পুলিসের হাতে ডান্ডা থাকে বটে, কিন্তু আপনি কোনও অপরাধ করেছেন বলেই তিনি ডান্ডা চালাতে পারেন না, গুলি চালাতে পারেন না, সংবিধান পুলিসকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায় দিয়েছে, কেউ আইন ভাঙছে মনে করলে, বুঝতে পারলে তাকে গ্রেফতার করার অধিকার দিয়েছে, লাঠিচালানো বা গুলি চালানোর অধিকার দেয়নি। পুলিস গ্রেফতার করবে, অপরাধের বিবরণ আর প্রমাণ দিয়ে তাঁকে বিচারের জন্য হাজির করবে, একটা থাপ্পড়ও পুলিস মারতে পারে না, সংবিধান তাকে সে অধিকার দেয়নি৷ মানুষ সেই কথা জানেন না৷ সিনেমার পুলিস বেধড়ক মারে, ব্যস, বাস্তবের পুলিসও মারার অধিকার পায়৷ পুলিস মারতে মারতে ভিলেনকে এক কিলোমিটার নিয়ে যায়, ৫ মিনিট ধরে হাততালি পড়ে, মি বাজিরাও সিংহম। এবং সেই না জানাটা আম জনতার খানিক দোষ হলেও, সিংহভাগ দোষ আমাদের সরকারের, যারা বহু বিষয়ে উদ্যোগ নেয়, মন্দির ওঁহি বনায়েঙ্গে, বলে চেল্লায়। মানুষ কী খাবে, কী পরবে নিয়ে ফতোয়া দেয়, সেই রাজনৈতিক দলের নেতারা, ক্ষমতায় বসে থাকা সরকারি দল, স্বাধীনতার পর থেকে একবারও ভাবেনি মানুষকে দেশের সংবিধানটা পড়াতেই হবে? অন্তত তার মূল বিষয়টা প্রত্যেক নাগরিকের জানা দরকার৷ ভাবেনি মানে এমনটাও নয় যে ভুলে গেছে বা ব্যর্থতা, পারেনি। না এমন নয়, খুব পরিকল্পনা করেই মানুষকে দেশের সংবিধান শিক্ষা দেওয়া হয়নি৷ যার ফলে খুব সহজেই হিন্দু মুসলমান লড়িয়ে দেওয়া গিয়েছে৷ খুব সহজেই মানুষের বেসিক রাইটস, সাধারণ অধিকার কেড়ে নেওয়া গিয়েছে৷
কতখানি? একটা উদাহরণ দিই, সেই ১৯৫০ সাল থেকেই আমাদের সংবিধানে ডাইরেক্টিভ প্রিন্সিপাল চ্যাপটারে কিছু কথা লেখা আছে, যা পড়লে বোঝা যাবে কেন সংবিধানকে মানুষের কাছ থেকে আড়াল করে, তার বদলে গীতা, কোরান, বাইবেল পড়ানো হচ্ছে। ওই ডাইরেক্টিভ প্রিন্সিপালে লেখা আছে, প্রত্যেক শিশুকে বিনামূল্যে পড়াশুনো করার ব্যবস্থা করতে হবে৷ মানুষে মানুষে আয়ের বৈষম্যকে কমিয়ে আনতে হবে, প্রত্যেকে যাতে খাবার পায়, স্বাস্থের সুবিধে পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে, সমান কাজের জন্য সমান বেতন দিতে হবে, সম্পদের বণ্টন হতে হবে, তা যেন মুষ্টিমেয় মানুষের কাছেই থেকে না যায়, কাজ পাওয়া মানে চাকরি পাওয়াটাকে, মৌলিক অধিকারের মধ্যে আনতে হবে। হ্যাঁ, এসব লেখা আছে আমাদের সংবিধানে৷ সেই ৫০ সাল থেকেই, ঠিক উল্টোটা হয়েই চলেছে, কেন? কারণ সংবিধানকে সামনে রেখে দেশ চলছে না, সংবিধানকে শালগ্রাম শিলার মত সামনে রাখা হয়েছে মাত্র, তার গুরুত্বকে ধর্তব্যের মধ্যেও আনা হয়নি। সেই আবহে, আমাদের কাঁথির খোকাবাবুর মন্তব্য নিয়েও আলোচনা করা যায়। তিনি যে খুব সংবিধান বিশেষজ্ঞ তা তো কেউ বলে না, কিন্তু বেশ কিছু বছর সাংসদ, মন্ত্রী, বিধায়ক থেকেছেন, আশা করাই যায় সংবিধানে সামান্য কিছু জ্ঞান তো থাকবে৷ মানে এ বি সি ডি অফ কনস্টিটিউশন, তো দেখা গেল সে গুড়েও বালি৷ তিনি সেদিন বললেন, প্রকাশ্যেই বললেন, ২০২৪ এই লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন হবে, একসঙ্গে হবে। এখন উদ্বায়ী দ্রব্যগুণের ফলে মানুষে কত কী বলে, নিজেকে বাদশা আকবর মনে করে, অন্তত পক্ষে চেঙ্গিজ খাঁ এর নাতি, এখন সেই দ্রব্যগুণের প্রভাবে যদি তিনি তাড়াতাড়ি বিধানসভায় জিতে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার খোয়াব দেখেন, দেখতেই পারেন, দ্রব্যগুণের প্রভাব কাটলে আবার জমিন দেখতে পাবেন৷ ২০২৪-এ ১ জন সাংসদকেও জিতিয়ে আনা সম্ভব কি না তাই নিয়ে আঁক কষবেন, সে কথা বাদই দিলাম।
আমরা বরং দেখি সংবিধান কী বলছে? সংবিধান বলছে রাজ্য বিধানসভা ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হবে, নির্বাচিত বিধায়কদের গরিষ্ঠ অংশ সরকার তৈরি করবেন, তারা ৫ বছরের জন্য সরকার চালাবেন, আর সংখ্যালঘু দলের বিধায়করা ৫ বছরের জন্য বিরোধী আসনে বসবেন, তো নির্বাচন কবে হল? ২০২১ এ, কতদিন সরকার থাকবে? ২০২৬ পর্যন্ত, কাঁথির খোকাবাবুর খুব তাড়াহুড়ো থাকলেও, ওই ৫ বছর তো অপেক্ষা করতেই হবে, অন্য উপায়? মানে ৫ বছরের আগে নির্বাচন? সম্ভব, সংবিধান বলছে সম্ভব, উপায়? যদি বিধানসভায় সরকার পক্ষের দল তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়, তো খোকাবাবু কি মনে করছেন, তৃণমূলের বিধায়করা বিজেপি জয়েন করবেন? আরও একটা উপায় আছে, রাষ্ট্রপতির কাছে রাজ্যপাল সুপারিশ করলো, আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, রাজ্য বিধানসভা ভেঙে দিন, বিধানসভা রাষ্ট্রপতি ভেঙে দিতেই পারেন, সেক্ষেত্রেও আবার নির্বাচন হবে। এখানে সমস্যা হল, মোদি সরকারের যাবতীয় হিসেব নিকেশ বলছে, রাজ্যের আইন শৃঙ্খলার দিক থেকে, মহিলাদের ওপর অত্যাচারের দিক থেকে, পণ না দেবার জন্য হত্যা বা অনার কিলিং এর দিক থেকে সারা ভারতে অনেক তলায় রয়েছে ইউ পি, এম পি, বিহার ইত্যাদি বিজেপি শাসিত রাজ্য, তাহলে? কিভাবে ভাঙবেন? কিছুদিন আগেই অমিত শাহ এসেছিলেন বঙ্গে, ছোটা মোটা ভাই সাফ বলে গেছেন ওসব ৩৫৬ ইত্যাদির কথা ভুলে যান, রাস্তায় নেমে রাজনীতি করুন, আন্দোলন করুন, মমতাকে দেখে আন্দোলন কিভাবে করতে হয় সেটা শিখুন। কিন্তু খোকাবাবু না পড়েছেন সংবিধান, না করেছেন রাজনীতি, যেটা করেছিলেন সেটা ছিল ল্যাম্প পোস্ট এর রাজনীতি, মাথায় ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ছত্রছায়ায় বসে রাজনীতি করেছেন, সাংসদ হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন, কিন্তু হঠাৎ ক্যালকুলেশনের ভুলে দল ছেড়ে মুখ্যমন্ত্রী হবার খোয়াব দেখে দল বদলে এখন বিপাকে, মুখ্যমন্ত্রীত্ব দূরস্থান, যে ভাবে দল ভাঙছে, বিরোধী দলনেতাও কতদিন থাকতে পারবেন কে জানে, তাই এখনই নির্বাচন করানোর কথা বলছেন, যেন এখনই নির্বাচন হলেই উনি জিতে আসবেন। সমস্যাটা আগেই বলেছি, সংবিধানটা পড়া নেই, পড়ার ধৈর্যও নেই তাই বিধানসভা ভেঙে নির্বাচন করানোর কথা বলছেন, কিন্তু এই কথা বলার পেছনে যদি সত্যি কোনও ষড়যন্ত্র থাকে, তা হবে এক অসাংবিধানিক কাজ, সেটা করা তো ছেড়েই দিলাম, করার চেষ্টা হলে কাঁথির শান্তিকুঞ্জে একদিনের জন্যও শান্তির ঘুম চলে যাবে, তা আমি হলফ করে বলতে পারি।