নন্দীগ্রাম মামলা শুনবেন না বিচারপতি কৌশিক চন্দ। মামলা থেকে সরে দাঁড়ালেন তিনি। অন্যদিকে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে ।
২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে ভোট গণনায় কারচুপির অভিযোগ তুলে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত ১৮ জুন বিচারক কৌশিক চন্দের বেঞ্চে ওঠে ওই মামলা।
এই মামলার রায় বুধবার সকাল এগারোটায় দেওয়ার কথা ছিল। তবে, আইনি লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত জয়ী হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ মুখ্যমন্ত্রীর আর্জি এবং আইনি যুক্তিকে মান্যতা দিয়ে নন্দীগ্রাম-মামলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি কৌশিক চন্দ৷
আরও পড়ুন: বাজেট পেশ করবেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়
একইসঙ্গে বিচারপতি চন্দ বুধবার রায় ঘোষণা করে জানিয়েছেন, “আদালতের ভিতরে এবং বাইরে প্রকাশ্যে যেভাবে আমার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে, তা সঠিক নয়। মামলাকারীর এই ব্যবহারের জন্যই আদালত তাঁকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করছে৷ এই টাকা জমা করতে হবে পশ্চিমবঙ্গ বার কাউন্সিলের তহবিলে। দুঃস্থ আইনজীবীদের পরিবারকে সাহায্য করা হবে ওই টাকায়৷” নন্দীগ্রাম- মামলা থেকে বিচারপতি কৌশিক চন্দ সরে যাওয়ায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এ বার নতুন কোনও এজলাসে এই মামলাটি পাঠাবেন এবং সেখানেই মুখ্যমন্ত্রীর করা মামলার বিচার প্রক্রিয়া চলবে৷
কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি কৌশিক চন্দের এজলাসে গত ২৪ জুন নন্দীগ্রাম বিধানসভার ফল সংক্রান্ত মূল ‘Election- Petition’ বা মামলাটি অন্য এজলাসে স্থানান্তরের আবেদনের শুনানি শেষ হলেও রায়দান স্থগিত রাখা হয়৷
আরও পড়ুন: দিল্লিতে খুন প্রাক্তন মন্ত্রীর স্ত্রী
বুধবার হাইকোর্টে বিচারপতি চন্দ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এজলাস-বদলের আবেদনের রায় ঘোষণা করে জানালেন, তিনি নন্দীগ্রাম- মামলা থেকে সরে যাচ্ছেন৷ তাঁর এজলাসে এই মামলার শুনানি হবে না৷ ওই মামলা ফেরত পাঠানো হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির কাছে৷
রায় ঘোষণার আগে পর্যবেক্ষণে এ দিন বিচারপতি জানান, “সংশ্লিষ্ট মামলায় আমি দু’তরফের কাউকেই ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তা সত্ত্বেও আদালতের ভিতরে এবং বাইরে আমার বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে প্রতিবাদ সংগঠিত করা হয়েছে৷ এই ধরনের কাজ সঠিক নয়।আইনজীবী হিসাবে যে কোনও আইনজীবী যে কোনও মামলায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। সেটা তাঁর পেশাগত বিষয়৷”
পাশাপাশি বিচারপতি বলেছেন, “আমার বিচারপতি পদ স্থায়ীকরণের বিষয়টি প্রকাশ্যে এনে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর শপথগ্রহণের শর্ত ভঙ্গ করেছেন৷”
গত ২৪ জুন হাইকোর্টে বিচারপতি চন্দ’র বেঞ্চে নন্দীগ্রাম- মামলা অন্য এজলাসে স্থানান্তর করার আবেদন নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে ভার্চুয়ালি সওয়াল করেন বিশিষ্ট আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভি৷ ওইদিনের শুনানিপর্বে এজলাসে ভার্চুয়ালি হাজির ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও৷
হাইকোর্টে সেদিনের সওয়ালে মুখ্যমন্ত্রীর কৌঁসুলি সিংভি নন্দীগ্রাম- মামলার নিরপেক্ষ বিচার নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন৷ বিচারপতি কৌশিক চন্দের বেঞ্চে নন্দীগ্রাম মামলার বিচার পর্ব চললে, তা কতখানি নিরপেক্ষ হবে তা নিয়েও প্রশ্নও তোলেন সিংভি৷ সিংভি বলেন, “আমরা জানতাম মামলাটি বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্যের বেঞ্চে যাবে। হঠাৎ ১৬ জুন জানতে পারি আপনার বেঞ্চে এসেছে মামলাটি।’’একইসঙ্গে বিচারপতি চন্দের বিজেপি-যোগ নিয়েও অভিযোগ তোলেন সিংভি৷ প্রসঙ্গত তৃণমূলের তরফেও বিচারপতি কৌশিক চন্দের বিরুদ্ধে আগেই এই একই অভিযোগ করা হয়েছিল।
ওইদিন বিচারপতি চন্দকে সরাসরি সিংভি বলেন, “বিচারপতির ভূমিকা পবিত্র। আপনাকে অনুরোধ করব মামলা থেকে সরে যান৷” সিংভি সওয়ালে বলেন,‘‘এই মামলা নিয়ে পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগ করা যেতেই পারে। আপনার সঙ্গে বিজেপি-র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আপনি বিজেপি-র লিগ্যাল সেলের কর্তা ছিলেন। বিজেপি-র হয়ে বিভিন্ন মামলায় আপনাকে উপস্থিত থাকতেও দেখা গিয়েছে। তাই আপনার উচিত হবে এই মামলা থেকে সরে যাওয়া৷’’ সিংভি ছাড়াও এই মামলায় মুখ্যমন্ত্রীর আইনজীবী হিসাবে রয়েছেন এস এন মুখোপাধ্যায় এবং সঞ্জয় বসু৷
এই সওয়ালের পর সেদিনই বিচারপতি কৌশিক চন্দ বলেন, “আমি এক সময়ে বিজেপি-র লিগাল সেলের প্রধান ছিলাম বলেই আপনাদের অসুবিধা?” তিনি বলেন, “বিভিন্ন আইনজীবীর সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যোগাযোগের থাকতেই পারে৷ মিঃ সিংভি, আপনি কংগ্রেসের। মামলাকারীর অপর আইনজীবী মিঃ মুখোপাধ্যায় বিজেপি-র। তারপরও আপনারা অন্য দলের মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে মামলা লড়ছেন। আর আদালতে দাঁড়িয়ে বিচারপতির পূর্ব-জীবন নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছেন”৷
সিংভি’র কাছে বিচারপতি জানতে চান, “আমার সম্পর্কে আপনাদের দু’টি অভিযোগ, প্রথমটি বিচারপতি হবার আগে বিজেপি করতাম এবং দ্বিতীয়টি, আমার বিচারপতির পদ স্থায়ীকরণে মুখ্যমন্ত্রী সুপারিশ করেননি, আপত্তি জানিয়েছেন৷”
বিচারপতি সেদিন স্বীকার করেন অমিত শাহের সঙ্গে তাঁর ছবি আছে৷ তিনি বলেন, “বিজেপির হয়ে যে কেউই মামলা করতে পারে। এটা যে কোনও আইনজীবীর পেশাগত স্বাধীনতা৷ বিজেপি’র তরফে আমাকে মামলা দেওয়া হয়েছিল, আমি করেছি৷ আমি যে সময় বিজেপির মামলা করেছি, সেই সময় বিজেপির কোনও প্রভাবই ছিল না।”
পাশাপাশি বিচারপতি চন্দ বলেছিলেন, “আবেদনকারীর পূর্ণ অধিকার রয়েছে পুনর্বিবেচনার আর্জি জানানোর। পুনর্বিবেচনার আর্জি আইনিভাবেই দেখা হবে৷ আপাতত রায়দান মুলতুবি রইল৷”
বুধবার হাইকোর্টে সেই রায়-ই ঘোষণা করেন বিচারপতি চন্দ৷ রায়ে মামলাকারী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করে নন্দীগ্রাম-মামলা থেকে সরে দাঁড়ালেন বিচারপতি কৌশিক চন্দ৷