বেঙ্গালুরু: মুখে ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (PM Modi)। তিনিই বিজেপির (BJP) মুখ। তাঁর কেতাদুরস্ত উপস্থিতির আপাদমস্তক সেই স্বচ্ছতারই যেন প্রতিফলন। অথচ, ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন দেখানো সেই বিজেপির শাসনে কর্নাটকে যে ভাবে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে, তা-ও আবার সরকারের নানাস্তরে, তাতে হতাশ রাজ্যের এক শ্রেণির মানুষ। আরও স্পষ্ট করে বললে, কর্নাটকের কন্ট্রাক্টররা। উৎকোচ ছাড়া কাজ হয় না। ঘুষ আগেও দিতে হত, এখনও দিতে হয়। কিন্তু, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে এই উৎকোচ দেওয়ার মধ্যে যে বদল ঘটে গিয়েছে, তাতেই বিচলিত কন্ট্রাক্টরা।
কোনও সরকারি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দের ৪০ শতাংশই যদি ‘কাটমানি’ বাবদ ফিরিয়ে দিতে হয়, তা হলে বিচলিত না-হওয়াটাই অস্বাভাবিক। এই মাগ্গিগণ্ডার বাজারে বাকি অর্থে সেই প্রজেক্ট দাঁড় করাতে হিমশিম খেতে হয় কন্ট্রাক্টরদের। অভিযোগ যাঁরা করছেন, তাঁরা সকলেই সরকারি প্রকল্পের কন্ট্রাক্টর। নিজেদের একটি সংগঠনও রয়েছে। কর্নাটক স্টেট কন্ট্রাক্টর অ্যাসোসিয়েশন। রাজনৈতিক পরিচয়ও রয়েছে কারও কারও। অভিযোগকারীদের একটা বড় অংশই নিজেদের বিজেপি-র সমর্থক বলে পরিচয় দেন। তার পরেও বিজেপি-শাসন তাঁদের হতাশই করেছে।
কর্নাটক রাজ্য কন্ট্রাক্টর অ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগ, মন্ত্রীরা টাকা নিচ্ছেন। বিধায়কদের টাকা দিতে হচ্ছে। টাকা নিচ্ছেন সরকারি আধিকারিকরাও। অভিযোগ, ২০১৯ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ঘুষ দিতে বড় অঙ্কের টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনের অভিযোগ অনুযায়ী, প্রকল্প খরচের ৪০ শতাংশ টাকা ঘুষ হিসেবে দাবি করা হচ্ছে। গোটা কর্নাটকে এই সংগঠনের আওতায় ১ লক্ষের উপর কন্ট্রাক্টর রয়েছেন। অসন্তোষ থেকে তাঁরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাইকে একাধিক বার চিঠি দিয়েছেন। সর্বশেষ চিঠিটি দিয়েছেন চলতি বছরের ২২ মার্চ। তাতে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: উন্নয়নের ছবি ‘চুরি’, উত্তরপ্রদেশের উন্নয়ন প্রচারে বাংলার ‘মা’-মমতাই ভরসা যোগীর
কন্ট্রাক্টর সংগঠনের নেতারা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করে কাজ হচ্ছে না দেখে, তাঁরা রাজ্যপাল থাওর চাঁদ গহলোতকেও জানিয়েছিলেন। এমনকী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও চিঠি লিখেছেন। কিন্তু, এই দুর্নীতি বন্ধ করতে কেউ-ই সদিচ্ছাটুকু দেখাননি। এই অসন্তোষের মধ্যেই বর্ষীয়ান মন্ত্রী ঈশ্বরপ্পার বিরুদ্ধে বোমা ফাটিয়ে দলকে অস্বস্তিতে ফেলেছেন বিজেপির সদস্য সন্তোষ পাতিল। তাঁর অভিযোগ, রাস্তা করার ছাড়পত্র দিচ্ছেন না ঈশ্বরপ্পা। রাস্তার নির্মাণ খরচের ৪০ শতাংশ টাকা তাঁকে না দিলে, তিনি ক্লিয়ারেন্স দেবেন না। এ ভাবে মন্ত্রীর নাম করে দলের তরফে অভিযোগ ওঠায় বিড়ম্বনা বেড়েছে বোম্মইয়ের।
কন্ট্রাক্টর সংগঠনের বক্তব্য, গ্রামীণ বিকাশ ও পঞ্চায়েত-রাজ মন্ত্রী ঈশ্বরপ্পার বিরুদ্ধে ওঠা ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কর্নাটক সরকারের যে কোনও দফতরের কাজ আদায় করতে এখন ৪০ শতাংশ ঘুষ দিতে হচ্ছে। এটাই দস্তুর। সংগঠনের সভাপতি কেমপান্না দু-দশকেরও বেসি সময় ধরে সরকারি কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছেন। জানালেন, একটা সময় সরকারি প্রকল্পের কাজ করতে স্থানীয় কন্ট্রাক্টরকে ২ শতাংশ কমিশন দিতে হত। কংগ্রেসের শাসনে ২০১৮-১৯ সালে তাঁদের প্রকল্প খরচের ১০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট দফতরে ঘুষ বা কমিশন দিতে হয়েছে। এখন দিতে হচ্ছে ৪০ শতাংশ। এই ৪০ শতাংশের মধ্যে ৫ শতাংশ যায় স্থানীয় বিধায়কের পকেটে। আরও ৫ থেকে ৭ শতাংশ যায় লোকাল স্তরে। সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার কমিশন নেন ১০ শতাংশ। প্রজক্টের কাগজ প্রসেস করতে আরও ৫ শতাংশ। এ ভাবেই বিভিন্ন স্তরে কমিশনের টাকা তাঁদের দিতে হয়।
কেমপান্নার কথায়, ‘কংগ্রেসের আমলে ১০ শতাংশ ঘুষ দিতে হত বলে আমরা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। মোদিজি কর্নাটকে নির্বাচনী প্রচারে এসে স্বচ্ছ ভারতের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। ভাল কিছুর আশায়, আমরা বিশ্বাস করে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলাম। অচ্ছে দিন তো দূর অস্ত, বিজেপি শাসনে কর্নাটকের পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে উঠেছে।’ ২০২১ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ঘুষকাণ্ড নিয়ে চিঠি লিখেও কোনও সদুত্তর পাননি। ঘুষ বা কমিশন নেওয়া চলছে।
আরও পড়ুন: Ghaziabad: জাতীয় সড়কে গাড়ি থামিয়ে মত্ত যুবকদের নাচানাচি, অভিযোগ পেয়েই কড়া পদক্ষেপ পুলিসের
দুর্ভোগের শেষ এখানেই নয়। সবমিলিয়ে কর্নাটক সরকারের বিভিন্ন দফতর থেকে তাঁদের বকেয়া পাওনার পরিমাণ ২২ হাজার কোটি টাকা। সরকারি প্রকল্পের কাজ শেষ করেও বকেয়া হাতে পাননি। একাধিকবার দরবারেও কাজ হয়নি। ফলে, ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর ‘অচ্ছে দিন’ তাঁরা হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছেন।