পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন হয়ে গেল৷ বামেদের নিয়ে একটা কথাও বলা হয়নি৷ বলার মত অবকাশও ছিল না৷ পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে যেখানে যত আসনে বামেদের প্রার্থী ছিল, সবকটায় তাদের জমানত জব্দ হয়েছে৷ নোটাতেও তার চেয়ে কিছু ভোট পড়েছে৷ এটাই বাস্তব ছবি। যে উত্তরপ্রদেশের কানপুর থেকে কমিউনিস্ট পার্টির যাত্রা শুরু, যে রাজ্যে একেক সময় তাদের নামকরা নেতারা ছিলেন, যাঁদের স্ট্যাচু আজও রয়েছে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন শহরে৷ যে সব নেতারা এককালে কমিউনিস্ট পার্টিতে ছিলেন, তাঁরা সব মরে গিয়েছেন এমনও নয়৷ কিন্তু তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টি করেন না, বেশিরভাগই সমাজবাদী দল করেন, জিতেছেনও।
উত্তরাখন্ডে বামেরা কোথাও নেই৷ মণিপুরে সিপিআই ছিল৷ এখন ভ্যানিস। পঞ্জাবে একসময় বামেরা দারুণ শক্তিশালী ছিল৷ হরকিষণ সিং সুরজিৎ দলের সাধারণ সম্পাদকও হয়েছিলেন৷ সেই পঞ্জাবে বামেরা নোটার চেয়েও কম ভোট পেয়েছে৷ ক’দিন আগে তৈরি হওয়া দল, ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে৷ গোয়া সংযুক্তি আন্দোলন বা গোয়া মুক্তি আন্দোলনে বামেদের বিরাট ভূমিকা ছিল, বিশেষ করে আর এস পির ভূমিকা তো বিরাট৷ কিন্ত সেখানেও বামেদের অবস্থা করুণ৷ কাজেই দেশের পাঁচ পাঁচটা রাজ্যের নির্বাচন হয়ে গেল, বামেদের কোনও প্রাসঙ্গিকতা এই নির্বাচনে ছিল না৷ স্বাভাবিকভাবেই তাদের নিয়ে এই সময়ে কোনো আলোচনাও হয়নি।
এর মধ্যে বাংলায়, বামেরা বা বলা ভালো সিপিএম কিছু খবরের শিরোনামে এসেছে৷ প্রথম হল তাঁদের দলীয় সম্মেলন, জেলা এবং রাজ্য সম্মেলন, দ্বিতীয় হল আনিস হত্যাকাণ্ড৷ তৃতীয় রামপুরহাট, বগটুই গ্রামের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। জেলা আর রাজ্য সম্মেলনের দিকে নজর দেওয়া যাক৷ জেলা নির্বাচনে পশ্চিম মেদিনীপুরের দিকে নজর ছিল সবার, রাজ্য সম্পাদক যুব নেতা, প্রাক্তন ডি ওয়াই এফ আই সাধারণ সম্পাদক, তাপস সিনহাকে ডাকলেন, তাঁকে জেলার দায়িত্ব নিতে হবে এমন কথাও জানালেন, আর কী কী করিতে হইবে, তা নিয়েও আলোচনা সারার পরে সম্মেলনে তাপস বাবুর নাম সরকারি প্যানেলে রাখা হল, যদিও তা সরকারি কি না, তা জানানো হল না, পালটা প্যানেল জমা পড়ল, বুদ্ধ বাবুর ভারি অপছন্দের সুশান্ত ঘোষ সম্পাদক হলেন, যিনি এককালে সক্কালে উঠে, তাঁর বাড়ির কমন রেলিং ঘেঁসা উদ্দানের হরিণকে ঘাস আর ছোলা খাওয়াতেন, সেই জঙ্গী নেতা আপাতত পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক, আদালতে আদেশে বহুদিন জেলার বাইরে থাকতে বাধ্য কমরেড সুশান্ত ঘোষ, সম্পাদক হবার পর বড় ইভেন্ট ২ দিনের শিল্প ধর্মঘট, তাঁকে রাস্তায় অন্তত দেখা যায়নি।
রাজ্য সম্মেলনে রাজ্যের দায়িত্বে এবার কমরেড সেলিম, তাঁর আব্বাস অপারেশনের বিপুল ব্যর্থতার পরেও তিনিই সম্পাদক, সম্ভবত মুসলিম ভোট যদি কিছুটা ফিরিয়ে আনা যায় সে দিকে লক্ষ্য, কিন্তু আব্বাস এপিসোডই বলে দেয়, সে গুড়ে বালি৷ বামেরা বা সিপিএম বিজেপিকে হারাতে পারবে, এমন পরিস্থিতি তৈরি না হলে মুসলিম ভোট তৃণমূলের খাতায় যাবে, এটা বুঝতে তেমন পরিশ্রম করতে হবে না। আনিস হত্যাকাণ্ডে কিছুটা এগিয়ে বামেরা বা বলা ভালো, বাম ছাত্র সংগঠন, সিভিল সোসাইটির কিছু মানুষজন, আনিস না হয়ে কোনও গোপাল বা রাখোহরি হলে বিজেপি মাঠে নামত৷ ছেলেটির নাম আনিস, তারা সেভাবে মাঠে নামেনি।
রামপুরহাট, বগটুই এর ঘটনার প্রতিবাদের যাবতীয় আলো বিজেপির মুখে, অন্ততঃ বিধানসভায় তারা তা প্রমাণ করেছেন, তার সঙ্গে সিবিআই তদন্ত, বিজেপির সংসদীয় টিম, উচ্চস্তরীয় জাঁচ কমিটি ইত্যাদি নিয়ে এই ইস্যুতে বিজেপিই আপাতত এগিয়ে। বিপ্লবী কায়দায়, সেলিম সাহেব বাইকে চড়ে বাগটুই পৌঁছলেন বটে, কিন্তু প্রায় একই সময়ে গাড়িতে চেপেই বিমান বসু, মনোজ ভট্টাচার্যও সেখানে হাজির হলেন, সেলিম বাধা পাননি৷ কাজেই বাইকে চড়ার ছবি তেমন প্রচার পায়নি৷ উলটে সেলিম সম্পাদক হওয়া ইস্তক, সুজনবাবুকে একটু ম্রিয়মান দেখাচ্ছে। রাজ্যে একটা পুরসভা হাতে রাখতে পেরেছেন বামেরা, তাঁদের ভোট একটু হলেও বেড়েছে, অন্তত বিজেপির চেয়ে সামান্য হলেও বেশি, এখবর তাঁদের কাছে যতটা না সুখকর, তারচেয়েও স্বস্তিদায়ক মমতা বন্দ্যোপাধায়ের কাছে, কেন? একটু পরেই বলছি।
তার আগে আসুন বাংলার বিজেপির দিকে একটু নজর দেওয়া যাক, বাংলার বিজেপি মানে হল, আপাতত রাজ্য সভাপতি সুকান্ত শিবির, প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ শিবির, বেশ কিছু বিদ্রোহী বিজেপি নেতা এবং রাজ্যের রাজ্যপাল ধনখড় সাহেব। অবশ্যই চোখ বুঁজে বলা যায়, এই চার অংশের মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় হল রাজ্যের পাগলা জগাই, ধনখড় সাহেব, জলসাঘরের জমিদার মত রোজ হাঁক পাড়ছেন৷ উসকো বুলাও, ইসকো বুলাও। বুলাও তো বটে, কে বুলাবে? তিনি টুইট করেই যতটা ব্যতিব্যস্ত করা যায় এই রাজ্য সরকারকে, সেটাই করছেন৷ বিজেপির অন্তত দুই গোষ্ঠী তাঁর এই কাজে উৎসাহ পাচ্ছে৷ কাঁথির খোকাবাবু ৩৫৬ চাইছেন, অবশ্য ৩৫৬ তো অধীর চৌধুরিও চাইছেন৷ কিন্তু ওই চাওয়াই সার৷ ৩৫৬ জারি হলে যে অবস্থা হবে, তা মোদি – শাহ জানেন, ওঁরা অত বোকা নন। বিদ্রোহীরা কোন দিকে যায়, দু’গোষ্ঠী কিভাবে একসঙ্গে কাজ করবেন, দিল্লিতে দলের মাথারা কোন দিক নির্দেশ করবেন, কেউ জানে না। মতুয়া নেতারা বসেছিলেন মোদিজীর ভাষণের জন্য, হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিনে মোদিজী ভার্চুয়াল জ্ঞানদানের আগাম ঘোষণা করেছিলেন, তিনি অবশ্য ধনখড় সাহেবের মত হরিচন্দ্র বলেন নি, হরিচাঁদই বলেছেন, কিন্তু ঐ সি এ এ? না একটা কথাও বলেন নি, সি এ এ লাগু করলে দেশ জুড়ে আবার যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে, তা সামলানো যাবে না৷ ওদিকে মতুয়াদের সামনে সিএএ-র গাজর ঝোলানো আছে৷ সে যাই হোক৷ মোদিজী তাই নিয়ে একটা কথাও বলেননি৷ শান্তনু ঠাকুর অ্যান্ড কোম্পানি পরিষ্কার বুঝতে পারছেন যে হরিনাম খাবলা খাবলা বটে, সিএএ খাবলা খাবলা নয়৷ এখন নয়, কোনও দিনও নয়।
ওদিকে বিজেপির বিরাট প্রচার বেলুন ফুটো হয়ে যাবার পরে, রাজ্য জুড়ে বিজেপি কর্মীদের ভাটা, এবারে দেখিয়ে দেবো বলে যাঁরা মাঠে নেমেছিলেন, তাঁরা আব্বুলিশ বলে ঘরে ঢূকে গেছেন, কারণ এ রাজ্যে বিজেপির সেই আদর্শগত ভিত্তি কোনওদিনও ছিল না, থাকবেও না। এখানে ৩৩% মুসলমান ভোট, বিরাট অসাম্প্রদায়িক হিন্দু ভোট তাদের নির্বাচনের দুধে চোনা ফেলে দেবেই, তাকিয়ে দেখুন না টালিগঞ্জের দিকে, যে কুচুবুলুরা মাঠে নেমেছিলেন, তাঁরা মন দিয়ে সিনেমা আর সিরিয়াল করছেন, রাজনীতি? না ভাই, আমি রাজনীতিতে নেই, রাজনীতি আমার প্রথম পছন্দ নয়, অভিনয় আমার প্রথম প্রেম, প্রথম কদম ফুল।
ওদিকে বিজেপির সাংসদরা দিল্লিতে, মোদিজীর সঙ্গে সকালে ধোকলা খাবেন, মোদিজী পথনির্দেশ দেবেন, খবর তো এরকমই ছিল, কিন্তু মোদিজীর প্রায়োরিটি লিস্টে বংগাল অনেক পরে, তাই এখনও ব্রেকফাস্টে ডাক পড়েনি৷ দেখা যাক কবে ডাকেন মোদিজী, কী বলেন মোদিজী। তবে হাজার পথনির্দেশের পরেও, ২০২১ এ বিজেপির পাওয়া প্রায় ৩৮% ভোট কমে অদুর ভবিষ্যতেই আবার ১৭/১৮/১৯ % এ দাঁড়াবে, একথা হলপ করে বলা যায়, ২০২৪ এ একটার বেশি দুটো আসন পেতে বিজেপিকে অনেক ঘাম ঝরাতে হবে, এবং এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তৃণমূলের লড়াই অনেক কম, কারণ? আগেই বলেছিলাম, সিপিএমের ভোট বাড়ছে, বামেদের ভোট বাড়ছে, এটা বামেদের কাছে যতটা না স্বস্তিদায়ক, তারচেয়েও বেশি সুখের খবর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে, কারণ, দুটো দলের মুখোমুখি লড়াইয়ে একটা দলকে অন্তত ৪৪/৪৬% ভোট পেতেই হয়, কিন্তু ইনডেক্স অফ অপোজিশন ইউনিটি, বিরোধীদের ভোট যদি ভাগ হয়, বিজেপি কমে ১৮/২০% ভোট, সিপিএম বেড়ে ২৪% ভোট পেলে, মমতাকে পেতে হবে বড়জোর ৩৬/৩৭% ভোট, এবং তাহলেই তিনি ওই ২১১/২১৫ আসন ধরে রাখতে পারবেন৷ সংসদীয় ম্যাজিক, যে ম্যাজিকে ৩৭.৩৬ % ভোট পেয়ে বিজেপি ৩০৩, বসেছে ক্ষমতায়। এ রাজ্যে, বামেদের ভোট চলে গিয়েছিল বিজেপির কাছে, বামেদের আস্কারাও ছিল, এবারে রাম, ২১ এ বাম ছিল ২০১৯ এ স্লোগান, মনে নেই? সে সব ভোট এর সবটা ফিরে আসবে? অসম্ভব।