লখনউ: নারী দি-বস। শক্তি, সামর্থ্য, সাহস যার আছে, সক্ষম সে সব কাজে। কাজ সে অফিসের হোক, কি সংসারের। অর্ধেক আকাশ আজ সাবলম্বী হতে চায়। কিন্তু সবক্ষেত্রে পারছে কি? ভারতবর্ষের অন্য কোনও স্থানের কথায় যাচ্ছি না। ভোট সৌজন্যে উত্তরপ্রদেশ যখন নিজের ঠিকানা, সাময়িক নজরে কাউবেল্টই হোক উদাহরণ। ‘গো হামারি মাতা হ্যায়’ নগরীতে মাতা বা মায়ের পরিস্থিতি কী? মন্দিরে মন্দিরে পুণ্যার্থীদের মনোরঞ্জনে পূজিতা তো হচ্ছেন কিন্তু বাস্তবের মাটিতে সম্মান পাচ্ছেন কি? ভাই হামারে উত্তরপ্রদেশ মে তো মহিলায়ে সুরক্ষিত হ্যায়। বলছেন কারা? মনুবাদে বিশ্বাসী কিছু ধর্ম অন্ধ মানুষ। জন্মিয়ে স্বাধীনতা দেখেছিল যে শিশুকন্যা, আজ সে ৭৫ বছরের বুড়ি। সম্মান তো ছেড়েই দিন, প্রাতঃকাজ সারতে আজও তাকে বসতে হয় ক্ষেতে গিয়ে। সত্যি এটাই, আজাদি কা ৭৫ওয়া মহোৎসব উদযাপনের সবচেয়ে বড় কারণ হওয়া উচিত।
উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলের অজগরা বিধানসভায় একাধিক গ্রামে আজও শৌচালয়ের অভাব। গ্রামের পুরুষ সমাজের থেকে কোনও কম পরিশ্রম করেন না তাঁরা। সমান অধিকারের নামে বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও শুধুই মুখের কথা। সমান জীবনশৈলীর অধিকার মনে হয় যেন চাইতেই শেখেনি এই নারীরা। তবে অধিকারের প্রশ্নে যখন পেটে টান পড়ে তখন বুকও ফাটে, আর মুখও ফোটে। অন্যায় অবিচারের প্রশ্নে কেন উত্তর দিতে পারেন না উত্তরপ্রদেশের মহিলারা? সফর শুরুর দিন থেকেই এই প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। কী আটকায় তাদের? কেন এই জীবনযাপনকে মেনে নিয়েছেন তাঁরা? ভয় না ভক্তিতে? পেটের ভুখও কি তাদের অত্যাচারের দুঃখ মেটাতে শেখায় না? আজাদি কি শুধুই তাদের কাছে একটা শব্দ? কি হিন্দু, কি মুসলিম, প্রদেশের মহিলারা কোন বিষয়ে জাগ্রুক? নারী সমাজ শিক্ষায়, স্বাস্থ্য, শ্রমের অধিকারে আজও দ্বিতীয় নম্বরে কেন এখানে? খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি এই সব উত্তর। পেয়েছি কিছু। বুঝেছি কিছু। বাকিটা লিখছি তাই। কারণ অধিকারের লড়াইয়ে, আজাদির লড়াইয়ে সফল তাঁরা সেদিনই হবেন, যেদিন নিজেদের সবার আগে সেই সাফল্যের যোগ্য বলে মনে করবেন। কাউকে বলে দিতে হবে না তাঁদের সম্ভ্রমের কথা। সম্মানের কথা। নারী নিজেই সেদিন সম্পূর্ণা হতে পারবেন, যেদিন নিজেকে সে সবার প্রথম একজন রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে আগে দেখবেন। সম্ভ্রম সম্মানের জন্য যদি শাড়ির ঘোমটা বা বোরখা হিজাবকেই আসল মেনে থাকেন তাঁরা, তাহলে সুস্বাস্থ্যের জন্য শৌচালয়ের দাবি জানাতে হবে তাঁদেরই।
ভুখমারি সে আজাদির জন্য যদি মূল্যবৃদ্ধিকে দমাতে হয়, তাহলে পেট চালানোর তাগিদে শিক্ষার কলমকেও ধরতে হবে তাঁদেরই। চুলহা, চৌকি, বাচ্চা সমহালনা শুধু নয়, আত্মবিশ্বাসী হতে গেলে শিক্ষার আলোয় ঢুকতে হবে। শহর পারলে গ্রাম কেন নয়? বলতেই পারেন সুযোগসুবিধার কথা। মানছি, শহরে সুবিধা বেশি। তবে গ্রামের সরলতাও আছে। কিন্তু এই ফারাক তৈরি করল কারা? বিকাশ কেন জাত দেখে বা নারী-পুরুষ দেখে হবে? এক আকাশ যখন সবার উপরে তাহলে দুই পৃথিবী কেন? বিকাশের নামে এক দ্বেষ চালাচ্ছেন যাঁরা, উন্নয়নের জুমলাতে সেই দ্বেষকে জাগিয়ে তুলছেন তাঁরাই। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, সুরক্ষাহীনতা এক করেছে তাঁদের। ভাবুন তো, এই সাহস-শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী ভোটবাক্সে মতদান যদি দিয়ে থাকেন এই নারীরা, সমাজ বদলাতে তাঁদের কে আটকায়! তারা কী ভুলে গেছেন, নোটবন্দীর পর তাঁদের অসহায়তা? করোনাকালে সেই দুঃসহ পরিস্থিতিতে সংসার চালানোর অবস্থা? তাঁরা কি দেখেননি, হাথরস, উন্নাওয়ের সীতাদের চোখের জল? শিক্ষার আলো পেয়ে আত্মবিশ্বাসী হচ্ছেন যাঁরা, গ্রামের প্রমিলাদের কাছে তাঁদের প্রিভিলেজড কেন বলব? আজাদি তো অ্যাকাউন্টে ৫০০ টাকা দিয়ে বিক্রি হয়ে যায় না। ভোট কেনার জন্য নেতাদের কঙ্কালসার প্রচারে সাড়া দিলে হয় না। প্রচারে নাড়া উঠছে, লড়কি হু, লড় সকতি হু। কিন্তু, লড়াই কার? কাদের বিরুদ্ধে? সেটা কি কেউ শেখাচ্ছে? বা শেখাবে? অপেক্ষায় বসে থাকলে শুধু সময়ই যায়। তাই সময়ের আগে নিজের মূল্যকে বুঝুক নারী। কুপ্রথা, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়ুক নারী। গঙ্গানগরীতে শুধুই গোমাতা বা মা গঙ্গা পূজিতা হলে হবে না, জাতি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের অধিকারী হোক উত্তরপ্রদেশের নারীরা। তাদের সেই উজ্জ্বল দিনের আশায় থাকলাম আমরাও।