মোবাইলে ছবি উঠছে। কেউ একজন রেকর্ড করছেন সব। কেউ একজন বলছেন, ‘এই রক্তটাও তুলবি’। মেঝেতে চাটাই পাতা। তার উপর শুয়ে আছেন এক যুবক। আনিস খাঁন (এই বানানই লিখতেন আনিস)। শরীরে প্রাণ নেই। অভিযোগ দুষ্কৃতীরা তাঁর উপর শারীরিক অত্যাচার চালানোর পর, তিন তলার ছাদ থেকে নীচে ছুড়ে ফেলে দেয়। বাড়ির লোকেরা আহত, রক্তাক্ত আনিসকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু আনিসকে বাঁচানো যায়নি।
আনিস খাঁন। একজন প্রতিবাদী চরিত্র। শিক্ষিত, পড়াশোনা করা যুবক। নামেই বোঝা যাচ্ছে তিনি একজন সংখ্যালঘু। কিন্তু বিষয়টা তাঁর ধর্ম পরিচয় নিয়ে নয়। তাঁকে যেভাবে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে তা নাড়িয়ে দিয়েছে সমাজকে। প্রশ্ন উঠছে, আনিসের মত প্রতিবাদী চরিত্রকে সরিয়ে দিতে হল কেন? কার বা কাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আনিস খাঁন? আনিসের বাবার দাবি, শুক্রবার বেশি রাতের দিকে পুলিসের পরিচয় দিয়ে বেশ কয়েকজন তাঁদের বাড়িতে ঢোকেন। তাঁদের মধ্যে একজন পুলিসের পোশাক পরে ছিলেন। আনিসকে তাঁরা ছাদে নিয়ে যায়। শারীরিক অত্যাচারের পর তিন তলা থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়।
ঘরের মেঝেতে চাটাইয়ের উপর শুয়ে আছেন মৃত আনিস। কেউ মোবাইলে ভিডিয়ো রেকর্ড করছেন। কেউ একজন চাটাই তুলে দেখাচ্ছেন, ‘বলছেন, এই দেখো কত রক্ত। সত্যিই একের পর এক জায়গায় আঠাল, জমে যাওয়া কালচে রক্তের দাগ। যে দৃশ্য অত্যন্ত মরবিড। আরও মরবিড হয়ে যাচ্ছে যখন দেখা যাচ্ছে আনিসকে ঘিরে বসে রয়েছে অনেকগুলো অসহায়, অনিশ্চিত, বেদনামাখা মুখ। আর নেপথ্যে ভেসে আসছে বুক খালি করা কোনও এক মহিলা কন্ঠের কান্নামাখা আর্তনাদ। চাদরে ঢাকা আনিস শুয়ে আছেন।
মৃত আনিস খাঁনের মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে মৃত্যুর আগে তিনি বড় যন্ত্রণা পেয়েছেন। ভুরুর নীচে জমাট বাঁধা রক্ত। চোখের তলায় হনুর যে হাড়, সেখানে আঘাতের চিহ্ন। ডান দিকের নাকে তুলো গুঁজে রাখা। বাঁ-দিকের গাল দিয়ে রক্তের ধারা গলা বেয়ে কাঁধের দিকে গড়িয়ে গিয়েছে। সেই ধারা শুকিয়ে গিয়েছে। আনিসের গায়ে নীল রঙের একটা হাফ হাতা টি-শার্ট। রক্তে একেবারে ভেজা। বুকের কাছে গুটিয়ে রাখা সেই টি-শার্ট। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে তুলো। মেঝেতে চাটাইয়ের উপর শুয়ে আনিস খাঁন। প্রাণহীন।
২০২১ সালের মে মাস। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটের ফলাফল বেরিয়ে গিয়েছে। মে মাসের উনত্রিশ তারিখ হাওড়া উলুবেড়িয়ার এসডিপিও-এর কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন আমতা থানার অন্তর্গত সারদা দক্ষিণ খাঁন পাড়ার বাসিন্দা আনিস খাঁন। পুলিসের কাছে লিখিত অভিযোগ পত্রে কী লিখেছিলেন আনিস?
নিজের এলাকায় একটি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেন আনিস। অভিযোগ যা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে কেউ কেউ আনিসকে হুমকি দেন। আনিসকে বলা হয়, ‘রক্তদান শিবিরটি করা যাবে না, আর করলে ফল ভীষণ খারাপ হবে’। আনিসের অভিযোগের আঙুলটি ছিল সারদা দক্ষিণ খাঁন পাড়ার স্থানীয় শাসকদলের কয়েকজন সদস্যের দিকে। পরে পরিস্থিতি এতটাই ঘোরালো হয় যে পুলিসকে চিঠি লিখতে বাধ্য হন আনিস। লেখেন, ‘এমতাবস্থায় আমি ও আমার সমগ্র পরিবার ভীষণ নিরাপত্তাহীনতায় মধ্যে আছি এবং আশঙ্কা প্রকাশ করছি যে, যেকোনো দিন এরা আমাকে ও পরিবারকে প্রাণে মেরে ফেলতে পারে।’
মৃত আনিস খাঁনের পরিবার৷ শনিবার৷ নিজস্ব চিত্র৷
এই অভিযোগের ভিত্তিতে কোনও ব্যবস্থা হয়েছিল কিনা, সেটা একমাত্র পুলিসই বলতে পারবে। আর পুরনো সেই হুমকির সঙ্গে শুক্রবারের ঘটনার আদৌ কোনও যোগসূত্র আছে কিনা, সেটাও তদন্ত সাপেক্ষ। কিন্তু এটা স্পষ্ট আনিস খাঁন খুনের পিছনে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা আছে। ষড়যন্ত্র আছে। খুন, তথ্যপ্রমাণ লোপাট, ষড়যন্ত্র, একাধিক ধারায় তদন্ত শুরু করেছে আমতা থানার পুলিস। একজন দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে আমাদের একটাই দাবি, আনিসের হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি। ব্যস এ’টুকুই।