রাষ্ট্র আমায় ভাত দেবে না, ভাতের লড়াই হবে৷ রাষ্ট্র আমায় ঘর দেবে না, মাথার ওপরের ছাদের লড়াই হবে৷ বেকারের চাকরি দেবে না, মজুরি দেবে না, লড়াই হবে, দাম বাড়বে, লড়াই হবে। কতদিন? যতদিন রাষ্ট্র থাকবে ততদিন, শ্রেণি থাকবে, শ্রেণি শোষণ থাকবে, লড়াইও থাকবে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় কমিউনিস্ট পার্টি, জনতা দল না কংগ্রেস পার্টি থাকবে, সেটা বিবেচ্য নয়, লড়াই থাকবে। এটা ছিল সাধারণ লড়াইয়ের ফরমুলা, এটা আমরা জানতাম, জানি। যে দল ক্ষমতায় থাকবে, সেই ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে হবে, তার বিরুদ্ধে লড়াই থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু আজ আমরা এক নতুন সমস্যার মুখোমুখি, এ সমস্যা নতুন, এ সমস্যা এর আগে আমরা দেখিনি, এ সমস্যা ভয়ঙ্কর। বেশ কিছু বছর ধরে দেখছি আমাদের মূল সমস্যাগুলোর থেকে, আমাদেরকে, দেশের মানুষকে অন্যদিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা চলছে, এবং কিছু ক্ষেত্রে তো সেই প্রচেষ্টা সফলও বটে। কীভাবে? আসুন তা নিয়েই কিছু আলোচনা করা যাক, বোঝার চেষ্টা করা যাক কি ভয়ঙ্কর মগজ ধোলাই যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে, কি বিশাল তার ব্যাপ্তি, কি অসম্ভব ক্ষমতা সেই যন্ত্রের।
বছর ২০ ধরে হঠাৎই শোনা যাচ্ছে হিন্দু খতরে মে হ্যায়, হিন্দু মানে কারা? আমরা যারা জন্মসূত্রে হিন্দু, যারা এই দেশের কমবেশি ৭৮/৭৯% মানুষ, তারা নাকি ভয়ঙ্কর বিপদে, আমার ৭৩ বছর বয়সী মেসোমশাই, ৫৮ বছর বয়সী পিসেমশাই, ৪৩ বছরের দিদি কিম্বা ২৩ বছরের ভাগ্নে, হোয়্যাটস অ্যাপ মেসেজ পাঠাচ্ছে, হিন্দু খতরে মে হ্যায়। এবার সত্যিই যদি দেশের ৭৮/৭৯% মানুষ শতাংশ মানুষ বিপদে থাকেন, এমন বিপদ যা নাকি তাদের বেঁচেই থাকতে দেবে না, তাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করবে, তাহলে তেমন বিপদের সময় সত্যিই তো, আমরা কি নিছক পেটের ভাত, মাথার ওপরে ছাদ, চাকরি বা মুল্যবৃদ্ধি নিয়ে ভাবব? ভাবার কথা নয়, আফটার অল একজিসটেন্স থাকলে তবে তো পেটের ভাত, চাকরি বা মাথার ওপরে ছাদের প্রশ্ন থাকবে, খবর ছড়াচ্ছে হিন্দু খতরে মে হ্যায়। আপনি নাস্তিক হন বা আস্তিক, আপনি শৈব হন বা বৈষ্ণব, আপনি কালী পুজো করেন না নারায়ণ, সেটা তো প্রশ্ন নয়, আপনার টাইটেল ঘোষ, বোস, মুখার্জী, চ্যাটার্জী বা আরও সহজে বলা যাক আপনার নামের আগে মহম্মদ নেই, আপনার নামের শেষে খান নেই, আপনি বিপদে আছেন, আপনার অস্তিত্বই নাকি বিপন্ন।
কে বলছে? হোয়্যাটস অ্যাপ বলছে, দিলু ঘোষ বলছে, হিন্দু ধর্মসভা থেকে বলা হচ্ছে, আপনার মাসি পিসি, আপনার জামাইবাবু ভাগ্নে বলছে , এই যে দেখুন হিন্দু খতরে মে হ্যায়৷ এখন সময় নয় অন্য কিছু ভাবার৷ এখন সময় নয় রোটি কপড়া মকানের লড়াই লড়ার৷ এখন সময় হিন্দুত্বকে বাঁচানোর৷ হিন্দুদের বাঁচানোর, কারণ হিন্দু খতরে মে হ্যায়। কিভাবে খতরে মে হ্যায়? আরে বাবা বলছি না খতরে মে হ্যায়, ভীষণ খতরে মে হ্যায়। আপনি চেপে ধরলেন, গোল গোল কথা বলা বন্ধ করুন, বোঝান, কিভাবে হিন্দু খতরে মে হ্যায়? এসে গেল রাশি রাশি হোয়্যাটস অ্যাপ তথ্য৷ মুসলমানরা এমনভাবে জনসংখ্যায় বাড়ছে যে আর কদিনের মধ্যেই তারা হিন্দুদের ছাপিয়ে যাবে, চারিদিকে কেবল মুসলমান দেখবেন, প্রত্যেকে গরু খায়, প্রত্যেকের ৯/১০/১১/১২ টা করে বাচ্চা কাচ্চা৷ তারা ধরে ধরে হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করছে? তাদের মুসলমান করে দিচ্ছে৷ এই যে দেখুন এইখানে লিখেছে৷ ওই মহারাজ বলেছে, এমন কি এসব কথা কবেই বল্লভভাই প্যাটেল বলে গেছেন, এই জন্যই তো নেতাজি রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে ভারতবর্ষে এসে হিন্দু বাহিনী তৈরি করার কথা বলেছেন৷ এই যে দেখুন এত্ত মোটা বই, ইংরেজি বই৷ অনুজ ধর আর চন্দ্রচূড় লিখেছে, ৬০০ পাতার ইংরেজি বই, পড়ে নিন।
আপনার চারধারে বৃষ্টির মত তথ্য নামছে, আপনাকে বোঝানো হচ্ছে হিন্দু খতরে মে হ্যায়। আর কী? আপনাকে বোঝানো হচ্ছে, বলা হচ্ছে কংগ্রেস দেশদ্রোহী, জহরলাল নেহেরু আসলে মুসলমান, তার বাবার সৎপুত্র হচ্ছে জিন্না, যে নাকি দেশ ভাগ করেছিল, বলা হচ্ছে তার ছেলে রাজীব মুসলমান, তার বৌ সোনিয়া খ্রিস্টান, এই সংখ্যালঘুরা, এই মুসলমান খ্রিস্টানরা দেশের ক্ষমতা হাতে নিতে চায়, হিন্দু খতরে মে হ্যায়। দেশের এই অবস্থার জন্য দায়ী জওহরলাল, ইন্দিরা, কংগ্রেস। হোয়্যাটস অ্যাপ মেসেজ আসছে গান্ধী হত্যাকারী গডসে আসলে দেশপ্রেমী জাতির পিতার হত্যাকারী দেশপ্রেমী, আপনার পড়শি, আপনার আত্মীয় স্বজন আপনাকে মেসেজ করছে, হাজার একটা ফেসবুক পেজ এ এই কথা লেখা হচ্ছে, তাতে বিভিন্ন পন্ডিতের নাম দেওয়া হচ্ছে, যারা নাকি গবেষক, ঐতিহাসিক, তাঁরা নাকি বলছেন।
হোয়্যাটস অ্যাপ মেসেজ আসছে দেশ খতরে মে হ্যায়৷ পাকিস্তান সবচেয়ে বড় শত্রু৷ তাদের বিরুদ্ধে এর আগে দেশের কোনও নেতা, কোনও দল নাকি কোনও লড়াই করেনি৷ করেনি বলেই তারা চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়েই যাচ্ছে৷ এইবার, এতদিনে এক দেশনায়ক এসেছে, যিনি নাকি ঘর মে ঘুসকর মারার কথা বলছেন৷ সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের কথা বলছেন৷ পাকিস্তানকে একঘরে করে দিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি৷ জঙ্গি জাতীয়তাবাদ, সমরবাদের কথা চলছে, কথায় কথায় সার্জিক্যাল স্ট্রাইক আর ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গে, কেন? কেন না দেশ খতরে মে হ্যায়।
তাহলে দাঁড়াল কি? মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, অর্থনীতির চুড়ান্ত অধঃপতন, রোটি, কপড়া, মকান কোনও সমস্যাই নয়৷ সমস্যা হল হিন্দু খতরে মে হ্যায়৷ সমস্যা হল দেশ খতরে মে হ্যায়। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে, আরব থেকে এসে মহম্মদ বিন কাসেম ভারতবর্ষের কিছু জায়গা দখল করেন, এরপর গজনী, ঘোরি, আইবক, খিলজি, তুঘলক, লোধি এবং মুঘলরা ভারতবর্ষের বেশ কিছু অংশ, অনেকটা দখল করেন, শাসন করেন, ইসলামিক শাসন চলে ১১০০ বছরের কিছু বেশি সময় ধরে, ১৮৫৭ পর্যন্ত। তারপর ১৮৫৭ থেকে ১৯৪৭, ৯০ বছর ধরে ইংরেজরা ভারতবর্ষ শাসন করেন৷ বহু বিদ্রোহ হয়েছে, বহু লড়াই, একবারও শোনা যায়নি হিন্দু খতরে মে হ্যায়৷ ২০০০ সালের কাছাকাছি এসে আমরা হঠাৎই শুনছি হিন্দু খতরে মে হ্যায়৷ এই ১২০০ বছর ধরে পুজো হয়েছে, মন্ত্রপাঠ হয়েছে, রামচরিতমানস লেখা হয়েছে, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ তাঁদের কথা বলেছেন, চৈতন্য, কবির, নানক তাদের কথা বলেছেন, আজ যখন এক হিন্দু রাষ্ট্রবাদী দল ক্ষমতায় এসেছে, তখন নাকি হিন্দু খতরে মে হ্যায়।
স্বাধীন ভারতবর্ষে, কাশ্মীরের দখল নিয়ে তিন তিন বার, ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১ পাক ভারত লড়াই হয়েছে৷ পাকিস্তান হেরেছে, আজ শোনা যাচ্ছে দেশের রাষ্ট্রনায়করা কাপুরুষ ছিলেন৷ এই প্রথম নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি, এক যুগপুরুষ জন্ম নিয়েছেন, যিনি এই প্রথম ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গের মত কথা বলেছেন৷ অসীম বীরত্বের কহানী। এবং এরকম নয় যে কয়েকজন আরএসএস- বিজেপির নেতা এসব বলছেন৷ কারণ তাহলে তারা প্রশ্নের মুখে পড়ত, তাদের প্রশ্ন করা হত, সত্যিটা বেরিয়ে আসত। এইসব অবান্তর আজগুবি, চুড়ান্ত মিথ্যে ছড়ানো হচ্ছে, তার পিছনে বিরাট পরিকল্পনা আছে, বিশাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার আছে, বিশাল পয়সার জোর আছে।
যে পরিকল্পনার কথা বলছিলাম, সেই পরিকল্পনার কিছুটা ফাঁস হয়ে গিয়েছে, এই যে রোজ ফেসবুক, হোয়্যাটস অ্যাপে লক্ষ লক্ষ পোস্ট, ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কেমন করে আসে, তার কিছুটা জানা গিয়েছে। জানা গিয়েছে এই আরএসএস – বিজেপির মাথায় বসে থাকা কিছু মানুষ, এক সফটওয়ার তৈরি করেছেন, টেক ফ্রগ, এর সাহায্যে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে এক লহমায় আপনার সামনে এসে হাজির হচ্ছে, এক লহমায় অজস্র মিথ্যে ইনফরমেশন, লক্ষ লক্ষ মিথ্যে তথ্য হাজির হচ্ছে, ঘোর বর্ষার বৃষ্টির মত ঝরে পড়ছে সেই ইনফরমেশন, সেই মিথ্যে, আপনি ভিজতে বাধ্য, আপনার মনে হতে বাধ্য যে এতজন যে কথা বলছে, তার কিছুটা সত্য বটেই, আপনার মনে হতে বাধ্য যে এক বিরাট পন্ডিত ঐতিহাসিকের নামে যে তথ্য আপনার সামনে এসে হাজির, সেই তথ্য ভুল হতে পারে না, তাহলে নেহেরু নিশ্চই মুসলমানই ছিলেন, তাহলে নেহরু নিশ্চই আই এন এর সম্পদ চুরি করেছেন, তাহলে নিশ্চই মুসলমানদের জনসংখ্যার হার এমন প্রবল গতিতে বাড়ছে যে, আর ক’দিন পরেই তারা ভারতবর্ষে সংখ্যাগুরু হয়ে পড়বে, অতএব হিন্দু খতরে মে হ্যায়, দেশ খতরে মে হ্যায়।
টেক ফ্রগ তৈরি করছে লক্ষ লক্ষ নকল, ভুয়ো আইডেনটিটি, ভুয়ো অস্তিত্বের সেসব ভূতের দল লক্ষ কোটি মিথ্যে বলছে, বলেই চলেছে। পিছিয়ে পড়ছে মানুষের রোটি কপড়া মকানের লড়াই, পিছিয়ে পড়ছে বেকারত্বের প্রশ্ন, পিছিয়ে পড়ছে মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্ন, আপনি বিভ্রান্ত হচ্ছেন, আপনাকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে, তার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এই কায়দা নতুন নয়, বহু আগে হিটলারের মন্ত্রশিষ্য গোয়েবলস এই কথাই বলেছিলেন, একটা চরম মিথ্যে বলতে হবে, ছোট্ট নয়, বিগ লাই, তারপর তা অনবরত বলে যেতে হবে, যতক্ষণ না সাধারণ মানুষ সে কথা বিশ্বাস করছে, সেই হিটলার গোয়েবলসের ফলোয়ার আর এস এস – বিজেপি সেই কাজটাই করছে আরও নিপুণভাবে, আরও পরিকল্পনা করে, লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে, আধুনিক টেকনোলজিকে কাজে লাগিয়ে। এই মুহূর্তে আপনার কাজ হল সেই মিথ্যের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা, মানুষকে সেই মিথ্যের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করা, লড়াইটাকে রোটি কপড়া মকানে লড়াইতে নিয়ে যাওয়া, লড়াইটাকে মুল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো।