সে তখন ছিল প্রতিবাদের সিজন, সিজন অফ প্রোটেস্ট, বাতাসে হিম হিম শীতের ছোঁয়া, পাতা খসছে, বর্ষা শেষের মুখে, কাজের মুডই নেই। কিংবা তখন হাতে কাজ ছিল না, মাঝেমধ্যেই এমন হয়। বছরে সাকুল্যে ৩-৪ খানা সিনেমা পয়সা ফেরত পায়, বাকিরা সিনেমাতে পয়সা ঢালেন আমোদ প্রমোদ দুষ্টুমি ফুর্তির টোটাল প্যাকেজের জন্য, সিনেমা লেগে গেলে আবার একটা। কাজেই সেই ইন্ডাস্ট্রির লোকজনদের মাঝেমধ্যেই কাজ থাকবে না এ তো সব্বাই জানে। তাহলে? এক অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সির মাথা বলেছিলেন, লিন পিরিয়ডেই ব্র্যান্ড বিল্ডিং করতে হয়। মানে শীতকালে বোঝান আপনার এসি কত্ত ভালো, তারপর গরম পড়লেই কেবল মনে করিয়ে দিন, এটাই নাকি ব্র্যান্ড বিল্ডিংয়ের রহস্য। তো সেই তেনারা সম্ভবত ওই লিন পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, পরিচালকের শুটিং শেষ, পোস্ট প্রডাকশনও শেষ, নায়কের শুটিং শেষ, নায়িকারও। কাজেই এই সময়ে তাঁরা ব্র্যান্ড বিল্ডিংয়ের কাজে হাত দিলেন, ওদিকে কিছু আবার প্রগতিশীল নারী আছেন, যাঁদের এটাই কেরিয়ার, আন্দোলন, ইভেন্ট আয়োজন, ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁরা সেরা বাঙালি হয়ে ওঠেন। তাঁরা গুগল করে পেয়ে গেলেন সঠিক ইভেন্ট-এর নাম, রিক্লেইম দ্য নাইট, রাত দখল করো, তাকে একটু বামপন্থী করার জন্য জুড়ে দেওয়া হল, দিন বদলের জন্য রাত দখল করো। ব্যস, জমে গিয়েছিল খেলা। তারপর সেরা বাঙালি হয়ে গেছেন, নায়ক, নায়িকা, পরিচালকদের কাজ এসে গেছে, অতএব মাদারি কা খেল বন্ধ। ফুটপাথে ওনাদের সোঁদর ভাই ভিক্টো সারারাত ধরে সামান্য একটু ফুর্তির পরে মাত্র জনা দশেককে আহত করেছেন, একজন মারাই গেছেন। সেই রাত-ফুর্তির বাকি কুশীলবেরা সব দায় ঝেড়ে আমি? কই? কোথায়? দেবশিশু হয়ে গেছেন, কিচ্ছুটি জানেন না। ওনারাও জানেন না, ইন্ডাস্ট্রির সেই প্রতিবাদীরাও জানেন না, দু’ একজন সামাল দিতে ফেসবুকে দু চার কথা লিখে দায় সেরেছেন, বাকিরা সেগুলোরও ধার ধারেননি। তখন মুখ্যমন্ত্রীর কান ধরে ওঠবোস করানোর নিদান দিয়েছিলেন, এখন তীব্র নিন্দার বাইরে বের হলেন না।
কারণ মারা গেছেন কোনও মেধাবী ডাক্তার নয়, চাপা পড়েছেন কোনও শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার নয়, এমনকী বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, চক্রবর্তীও নন, মারা গেছেন এক সংখ্যালঘু মানুষ, যাঁদের এই পোড়ার দেশে মারা যাওয়া ছাড়া আর কিছু তো বরাতে আছে বলেই মনে হচ্ছে না, এখন নাকি তাঁদের কবর আর উপাসনাস্থল নিয়েও টানাটানি চলছে। তো`এখন সেই উই ওয়ান্ট জাস্টিস শোনা যাচ্ছে না। কেন? তার একমাত্র কারণ হল এই ঘটনাতে মমতা অ্যাঙ্গেলটা নেই, মানে মমতা ব্যানার্জির পদত্যাগ চাই, এইটা বলার সুযোগ থাকলে তবে তো আন্দোলন? সেই সুযোগটা এখানে নেই। কয়েক বছর আগে অভিনেতা বিক্রম এবং সোনিকা তীব্র গতিতে যাওয়ার সময়ে দুর্ঘটনা ঘটলে সোনিকার মৃত্যু হয়। এরপরেও এই প্রবণতা কমেনি। বরং ড্রিঙ্ক অ্যান্ড ড্রাইভের কেস বাড়ছে। অনেকেই ভুলে গেছেন, স্মৃতির গোড়ায় ধুনো জ্বেলে বিষয়টা আবার মনে করিয়ে দিই, এখন যে সাংবাদিক মাঝেমধ্যেই চোখে চোখ রেখে উই ওয়ান্ট জাস্টিস চান, কথায় কথায় মমতা ব্যানার্জির পদত্যাগ চান, সেই রিপাবলিক সাংবাদিকও উদোম ফুর্তির পরেই বন্ধুকে নিয়ে বাইক চালিয়ে দুর্ঘটনাটা ঘটিয়েছিলেন। তখন সদ্য ওনার বাম থেকে রাম হওয়ার মানে ব্যাপটাইজড হওয়ার আনন্দেই নাকি রাতভর ফুর্তি ডট কম-এর আয়োজন হয়েছিল, সেখান থেকেই নাকি বন্ধুকে পেছনে বসিয়ে উদ্দাম গতিতে বাইক চালিয়ে ফেরার পথেই দুর্ঘটনা হয়, সেই ছেলেটি মারাও যায়, ইনি বেঁচে আছেন। কিন্তু এই ঠাকুরপুকুর কাণ্ডের পরে মমতার পদত্যাগ চাই বলে আগুন জ্বালানোর কোনও চেষ্টা চালিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। সেদিন আরজি কর দুর্ঘটনার পরে যে ভাঁড় নাট্যকার নাটক লিখে ফেলেছিলেন, তিনিও চুপ, বাকিদের চোখেমুখে এক হীরণ্ময় নীরবতা। কেবল একটাই কারণে, এই ঘটনাতে মমতা অ্যাঙ্গেলটা জুড়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তারপর ধরুন সেই ইউটিউবার, যিনি আর জেলে না যাওয়ার শর্তে হাজার শারীরিক মানসিক অসুবিধে সত্ত্বেও নিয়ম করে সন্ধ্যা আরতির মতো মমতা বিরোধিতা করে চলেছেন, তিনিও নাকি জনান্তিকে এখনও নিজেকে সাংবাদিকই বলেন, তো তিনিও এই খবর নিয়ে কথা বলাটা বাতুলতা বলেই মনে করেছেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ভূতের ভবিষ্যৎ আছে, কংগ্রেসের আছে কী?
কিংবা সেই ওএমআর বিশেষজ্ঞ ইউটিউবার মাইতি, মমতাকে আক্রমণ করে নিজের ডাল ভাত জোগান, তিনিও এই নিয়ে একটা কথাও বলেননি। না আগুন পাখি মীনাক্ষী যাননি, বাপের টাকায় কেনা ১৮ লক্ষের গাড়ি চড়া এক এখনও ছাত্রনেতা ছাড়া কেউ যাননি ওই মানুষটার ঘরে, যিনি আপাতত কবরে। কেউ যাননি আদালতে চটি ছুড়ে মারতে, খুনি খুনি বলে চিৎকার করতে কারণ জনগণের আবেগ তো জাগানো হয়, জাগান এইসব আন্দোলনজীবীরা, তাঁরা চুপ করে ব্যাপারটাকে এমনভাবে এড়িয়ে যেতে চাইছেন যেন এক নিকম্মার ঢেঁকি নেহাতই ভাগ্যের দোষে মারা গেছেন। এক অভিনেত্রী যিনি ওই উল্লাস রাতে ছিলেন সঙ্গে, ছিলেন সেই গাড়িতে, তিনি জানিয়েছেন তিনি এক ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, কাজেই এখন কথা বলা যাবে না। ট্রমা কথাটার উচ্চারণেই বোঝা যায় যে এনাদের ট্রমা আসলে নির্ভেজাল ড্রামা। এনাদের সিরিয়াল, মানে ওই মেগা সিরিয়ালের নাম কী? যা খুশি হতে পারে, সেই সিরিয়ালের নাকি টিআরপি বাড়ছিল, বাড়লে কী হবে? চলো মদ খাই-এর আয়োজন হবে এবং সেখানে হাজির ছিলেন যতজন, হলফ করে বলছি তাঁদের প্রত্যেকে, হ্যাঁ প্রত্যেকে জানতেন এই ডিরেক্টরের অতীত, মদ-গাঁজার বর্তমান, সেই মত্ত অবস্থায় কোথায় কবে কী কী করেছেন সব জানে টালিগঞ্জপাড়া, তারপরেও উঠতি অভিনেতা যখন তাঁকে স্টিয়ারিংয়ে বসতে দেখছেন, মানা করেননি, মানা করেননি ওই অভিনেত্রী কিংবা সঙ্গে থাকা এক ভাঁড়, ছিলেন ইপি নামক এক জন্তু, যাঁদের কাজ হল উপরে ও নীচের যাবতীয় হিসেব সুরক্ষিত রেখে গাঁয়ে না মানে আপনি মোড়ল সেজে জীবন কাটানো, তিনি বারণ করবেন কি, উঠতেই পারছেন না। এই ইপিরা বা তাঁর উপরে চ্যানেলের মাথারা মাইনে পান, আর কমিশন পান, এই চ্যানেল তাড়ালে ওই চ্যানেলে জায়গা করে নেন।
এনারা পিপের মতো মদ খেতে পারেন, এনাদের একজন বাইপাসে পর পর তিনটে গাড়িকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে লুকিয়ে ছিলেন মুম্বাইতে, ওনার শুভানুধ্যায়ীরা সবটা সামলে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়ার পরেই তিনি ফিরেছিলেন, পুলিশ কেসও হয়নি। তো সেদিনের ফুর্তির কথা আসা যাক, সেদিন কেবল ওখানেই কি শেষ হয়েছিল সেই ফুর্তি ডট কম? না পরিকল্পনা আরও ছিল, গাড়ি থেকে সিজ হয়েছে ৪টে মদের বোতল, গাঁজার কলকে। তাঁরা প্রথমে রিসর্টে ফুর্তি করলেন, তারপর বের হলেন সকালে, একটা স্কুটিকে ধাক্কা মারলেন, সেই স্কুটির মালিক সামনে এসে রাস্তা আটকাতে গেলেন, অমনি সেই ডিরেক্টর, স্টিয়ারিংয়ে বসা ডিরেক্টর ফুল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে দিলেন, এখন তাঁদের উকিল বলছে ওটা নাকি ব্রেক ফেল ছিল। এই সবক’টা, সেদিন ফুর্তিতে মেতে ওঠা সবকটাই সমান দোষী, আইনের টেকনিকালিটি জানি না, কিন্তু সেদিন এঁদের মধ্যে কারও এতটুকু বোধবুদ্ধি কি ছিল না যা সম্বল করে বলা যায় এই অবস্থায় তুমি স্টিয়ারিংয়ে বসতে পারো না? এঁরা কোন শিক্ষায় শিক্ষিত? এঁরা নাকি বুদ্ধিবৃত্তি করে খান? রবি ঠাকুরের সামান্য ক্ষতির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, রাজার কাছে এসেছেন গ্রামের লোকজন, রানি আর তাঁর সহচরীরা আগুন লাগিয়েছে তাদের কুটিরে, তাঁরা সেই নালিশ নিয়ে হজির হয়েছেন। তারপর
“সভাসন ছাড়ি উঠি গেল রাজা
রক্তিমমুখ শরমে।
অকালে পশিলা রানীর আগার,
কহিলা মহিষি, একী ব্যবহার।
গৃহ জ্বালাইলে অভাগা প্রজার
বলো কোন রাজধরমে।
রুষিয়া কহিলা রাজার মহিলা
“গৃহ কহ তারে কী বোধে।
গেছে গুটিকত জীর্ণ কুটীর
কতটুকু ক্ষতি হয়েছে প্রাণীর?
কত ধন যায় রাজমহিষীর
এক প্রহরের প্রমোদে।
একেবারে সেই একই আবহ সর্বত্র, সলমন খান থেকে বিক্রম থেকে ভিক্টো, একই ঘটনা। আর শাস্তিই নেই, নেই বলেই আবার ঘটছে, ঘটনা ঘটেই চলেছে। সলমন খান সেই ঘটনা ঘটার পরে নয় নয় করেও ৩০টা সিনেমা করে ফেলেছেন, টলিপাড়ার বিক্রম সেই ঘটনার পরে এখন আরও বড় স্টার, সব্বাই ভুলেই গেছে। ইনি ভিক্টো, ইনিও একদিন জামিন পাবেন, ইনিও আবার ফিরে আসবেন, এখনই বেশ কিছু টলিপাড়ার মানুষের গলায় আহা রে ভিক্টো শোনা যাচ্ছে, তিনিও আবার কাজ শুরু করবেন, আবার নতুন কেউ সাকসেস পার্টি সেরে আমাকে বা আপনাকে বা আপনাকে বা আপনার পরিচিত আত্মীয়স্বজনকে পিষে মারবে, এ খেলা চলবে নিরন্তর? এবং আপনি কিন্তু এখনও সেই আইসবার্গের টিপটুকুও দেখে উঠতে পারেননি, সে কি বীভৎস উল্লাস, মদের ফোয়ারা আর ফুর্তির বাহার তার এক শতাংশও উঠে আসেনি এই ঘটনার অনুষঙ্গে। আমরা যারা খানিক জানি, অনুমান করতে পারি তারা অবাক হই, প্রতিদিন কেন মানুষ চাপা পড়ে না? প্রতিদিন কেন এই ঘটনা ঘটে না? একটু গিয়ে দাঁড়ান পাঁচতারা হোটেলের সামনে, তিনটে, চারটে, পাঁচটার সময়ে টালমাটাল পায়ে যারা বের হয়, তারা প্রত্যেকে এক একজন পোটেনশিয়াল মার্ডারার। খুন করছেনও, কিন্তু শহরজুড়ে প্রতিবাদ হচ্ছে না, কারণ সেসব খুনের প্রতিবাদে মমতা ব্যানার্জির প্রতিবাদের অ্যাঙ্গেলটা সেরকমভাবে জুড়ে নেই।