দেড় বছর আগে শুরু হওয়া মণিপুরের জাতিদাঙ্গা থামে তো নিই, উল্টে তার জটিলতা আরও বেড়েছে। গত একমাসের খবর দেখুন, সাধারণ কুকি, মেইতেই মানুষজন মারা যাচ্ছেন, জ্যান্ত পোড়ানো হচ্ছে, ধর্ষণ হচ্ছে, সেনাবাহিনীর জিপ আক্রান্ত হচ্ছে, অস্ত্রশস্ত্র লুঠ হচ্ছে, মন্ত্রী বিধায়করাও আক্রান্ত হচ্ছেন। মণিপুরে আপাতত এক স্থায়ী সীমারেখা আমরা দেখতে পাচ্ছি, কুকিরা পাহাড়ি অঞ্চলে, মেইতেইরা তাদের সমতলে, দু’দলের হাতে প্রচুর অস্ত্র, আধুনিক যুদ্ধের অস্ত্র, দু’ দলের অস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সিবিআই যে ৮-১০টা জঘন্য হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির মামলার তদন্তে নেমেছিল তা এখনও ১০০ হাত জলে পড়ে রয়েছে। মন্ত্রিসভার বৈঠক হচ্ছে না, বিধানসভার অধিবেশন বসছে না, বিজেপি দল তাদের নিজেদের বিধায়কদের নিয়েই বৈঠকে বসতে পারছে না। আপাতত মণিপুরের ছবি এটাই। এদিকে সংসদে বসেই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছেন যে মণিপুরে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের প্রশ্নই ওঠে না কারণ রাজ্য সরকার আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে, তাদের চিফ সেক্রেটারি আমরা বদলে দিয়েছি, তাদের ডিজি আমরা ঠিক করে দিয়েছি, সেখানে নতুন করে কিছু এলাকাতে আফস্পা আবার জারি করা হয়েছে, সেখানেও তারা আপত্তি করেনি, তারা পূর্ণ সহযোগিতা করছে অতএব ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের মতো অবস্থা কিন্তু আমরা দেখতে পারছি না। মানে উনি এইসব কথা বলে যা বোঝাতে চাইলেন তা হচ্ছে মণিপুর আপাতত দিল্লির নির্দেশেই চলছে, দিল্লির দেখরেখেই চলছে।
তাহলে প্রশ্ন তো উঠবেই যে দাঙ্গা থামছে না কেন? কেন এখনও মানুষ খুন হচ্ছেন? কেন মানুষ এখনও ত্রাণ শিবিরে? কেন হাজার হাজার যুবক প্রকাশ্যেই অস্ত্র হাতে ঘুরছে? কাদের সহযোগিতায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবির চলছে? এমনকী বীরেন সিংও বুঝেই গেছেন যে তিনি আপাতত এক পুতুলের চেয়েও কম গুরুত্ব পাচ্ছেন এবং পাবেন। কিন্তু আপাতত এই সমস্যা কেবল মণিপুরের নয়। সমস্যা আরও জটিল হচ্ছে, এই বছরে তা আরও বড় আকার নিতেই পারে। কাচিন সেনারা মায়ানমার ঢুকছে, বাংলাদেশের কী হবে, ইত্যাদি বোলনেবালা আরএসএস বিজেপির মাথামোটাদের ভাবা উচিত যে তার প্রভাব আমাদের দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলেও পড়বে। মায়ানমারের জুন্টা সরকার, সামরিক সরকারের তবু একটা কাঠামো ছিল, তাদের সঙ্গে একটা যোগাযোগ অন্তত আছে, কিন্তু এই কাচিন বিপ্লবীদের বৃহত্তর ম্যাপে ভারতের এক বড় অংশ আছে। তারা আপাতত উল্টোমুখে যাচ্ছে বটে, কিন্তু পিছন ফিরলে কী হতে পারে ভেবে দেখেছেন, বিশেষ করে এই সময়ে? ওদিকে কাংলেইপাক কমিউনিস্ট পার্টি আবার তাদের কাজকর্ম বাড়িয়েছে মিজোরামে, নাগাল্যান্ডে লাগালিম-এর স্লোগান শোনা যাচ্ছে, নাগাদের বিশাল সাম্রাজ্য, তাদের নিজেদের ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ-এর দাবি, সব মিলিয়ে উত্তর পূর্বাঞ্চলে স্থানীয় রাজনীতির একটা নতুন চেহারা উঠে আসছে। এবং মাথায় রাখুন ঠিক এই সময়ে বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থান, বললেই শুনবে এমন সরকার কিন্তু বাংলাদেশে আর নেই, হু হু করে ইন্টলিজেন্স রিপোর্ট পাওয়া যাবে তার সুযোগও নেই। উল্টে এই সব বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতারা অনায়াসে সাহায্য পেতে পারে, তাদের ব্যবহার করা হতে পারে।
কাজেই এই মুহূর্তে গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যে উত্তেজনা আমরা দেখতে পাচ্ছি তা আগামী দিনের বিরাট কিছুর পূর্বাভাস নয় তো? উলফা গোষ্ঠী কি বাংলাদেশের অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে আবার নিজেদেরকে রিঅর্গানাইজ করছে? জানা নেই, কিন্তু চেষ্টা তো চালাবেই। ওদিকে অরুণাচলের উপরে চীনের সীমান্ত বরাবর বিশাল চীনা ফৌজ মোতায়েন, আমেরিকার এক সদ্য বের হওয়া রিপোর্ট বলছে ভারত সীমান্ত বরাবর চীনা ফৌজের সংখ্যা বেড়েছে, হাতিয়ার বেড়েছে, পরিকাঠামো বেড়েছে। ওদিকে চিকেন নেক নিয়ে কথা কিন্তু আর রগড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সব মিলিয়ে দাঁড়ালটা কী? দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ধারাবাহিকভাবেই পিছিয়ে পড়ছে, ক’টা গ্রামের লোকজনকে মেরে, ক’জন মাওবাদীকে আত্মসমর্পণ করিয়ে বাহবা নেওয়ার খেলায় মেতে ওঠা আমাদের ছোটা মোটা ভাই অমিত শাহের দফতর কিন্তু ধারাবাহিকভাবেই তাদের অপদার্থতার খবর দিয়ে চলেছে। আর দেবে নাই বা কেন? অমিত শাহ টোয়েন্টি ফোর ইন্টু সেভেন কাজ করেন, এটা সত্যি, তিনি রাহুল গান্ধীর মতো ইয়ার এন্ডিং কাটাতে দেশের বাইরে চলে যান না, ইন ফ্যাক্ট কবে উনি দেশের বাইরে গেছেন সেটাও খুঁজে বার করতে হবে। কিন্তু উনি কি সেই সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাজ দেখেন? ইন্টেলিজেন্সের রিপোর্ট দেখেন। দেখলে কি জানেন না যে মায়ানমার সীমান্ত বরাবর নতুন অস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গজিয়ে উঠছে। নতুন করে বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকাতে ঘাঁটি গড়তে ব্যস্ত উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীরা? দেখতে পাচ্ছেন না যে কম হলেও এখন জম্মু ঘাঁটিতে উগ্রপন্থীদের আক্রমণ আর আনাগোনা বাড়ছে?
আরও পড়ুন: ২০২৪ শেষ, ২০২৫-এ দেশ আর বাংলার রাজনীতিতে কী কী হতে পারে?
দেখবেনটা কখন? এই একটি মানুষ বিজেপি দলের ডি ফ্যাক্টো সভাপতি। ওই জগৎ প্রকাশ নাড্ডা তো দুধুভাতু বললেও বেশি বলা হয়। দেখেছি, অমিত উঠে দাঁড়ালে উনি শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ান, গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসেন, কারণ উনি জানেন অমিত শাহের অনুমতি ছাড়া উনি একটা কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রার্থী তালিকা ফাইনাল করতে পারবেন না। আর এই বিশাল দেশে এক নির্বাচন যাচ্ছে আর এক নির্বাচন আসছে। প্রতিটা নির্বাচন বিজেপির কাছে গুরুত্বপূর্ণ, যতক্ষণ না কংগ্রেসকে সংসদে ১০-১৫তে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ ওনারাও জানেন যে কংগ্রেস আবার বাউন্স ব্যাক করতে পারে। আবার উঠে দাঁড়াতে পারে। আর সেই দায়িত্ব অমিত শাহের কাঁধেই রয়েছে। প্রতিটা নির্বাচন, প্রতিটা রাজনৈতিক দল, প্রতি দলের বেশ কিছু নেতার সঙ্গে রোজকার আদান প্রদান, দেশের ভেতরের বিভিন্ন সংস্থার ইনপুট নিয়ে তিনি কাজ করেন। কত সুন্দরভাবেই চিহ্নিত করেছিলেন যে নির্বাচনের আগে নীতীশকে যে কোনও শর্তে ফেরাতে হবে, বুঝতে পেরেছিলেন যে যে কোনও মূল্যে শরদ পওয়ারের এনসিপি-কে ভাঙতে হবে, শুধু শিন্ডে সেনা দিয়ে কাজ হবে না। আর সেগুলো করেও ২৪০-এ আটকে গিয়েছিল বিজেপি, না করলে ২০০-তে থামত, তারপর যা হত তা মোদি-শাহ জানেন। একবার বিরোধীরা ক্ষমতায় এলে যে তা খুব সুখের হবে না তা ওনারা জানেন। কাজেই এবারে লক্ষ্য কংগ্রেসকে আবার ভাঙা, দক্ষিণ থেকে ভাঙা, চাইলে স্তালিনের সঙ্গে একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট-এ আসা, চন্দ্রবাবু নাইডু আর স্তালিনের ভালো সম্পর্ক কাজে লাগানোর চেষ্টা কি চলছে না?
কর্নাটকে কংগ্রেসের বিরোধ কিন্তু পাকছে আর বৃদ্ধ ইয়েদুরিয়াপ্পাকে সরিয়ে একজন বড় কংগ্রেস নেতাকে দায়িত্ব দেওয়াই যায়, তার চেষ্টা চলছে। কর্নাটক ভাঙতে পারলে তেলঙ্গানা তো হাতের খেলা, রেবন্ত রেড্ডি তো পুরনো বন্ধু। সব মিলিয়ে এগুলোই প্রায়োরিটি আমাদের অমিত শাহের কাছে। কাজেই আপাতত দেশের সুরক্ষা গিয়েছে গড়ের মাঠে চরতে। বারামুল্লাতে নির্বাচিত এমপি শেখ আবদুল রশিদের সঙ্গে নাকি কাশ্মীরি মিলিট্যান্টদের যোগাযোগ আছে, সেই অভিযোগে তিনি জেলে, পঞ্জাবে খাদুর সাহিব থেকে অমৃতপাল সিং সান্ধু, ফরিদকোট থেকে সরাবজিৎ সিং খালসা সংসদে গেছেন, দুজনেই ঘোষিত খলিস্তান পন্থী, কাশ্মীরে নতুন করে অশান্তি শুরু হচ্ছে, আফগানিস্তান থেকে ধাক্কা খেয়ে তার পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ডেরা করেছে, পঞ্জাবে নতুন করে খালিস্তানি স্লোগান উঠছে, এদিকে চীন, ওদিকে গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং এই সময়ের বাংলাদেশের পরিস্থিতি সব মিলিয়ে আমাদের একজন ফুলটাইম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দরকার ছিল, কিন্তু আপাতত সেই দায়িত্বে থাকা অমিত শাহ বিজেপি দল আর নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। মাঝেমধ্যে কাজ দেখানোর সহজ উপায় কিছু মাওবাদীদের আত্মসমর্পণ করানো আর এনকাউন্টারে মারা, যেখানে সমস্যা বিশাল আকার ধারণ করছে সেদিকে তাকানোর সময় তাঁর নেই। আর সেই জন্যই ২০২৫ কিন্তু এক আশঙ্কা এনে হাজির করেছে দেশের মানুষের কাছে, পররাষ্ট্র আর স্বরাষ্ট্র দফতরের ব্যর্থতায় আমরা পড়শিদের শত্রু করে তুলেছি, আর ভেতরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সুযোগ করে দিচ্ছি আরও বড় চক্রান্তে শামিল হওয়ার। এই মুহূর্তে দেশের মানুষের কাছে এই ছবি তুলে ধরা দরকার, এই সরকার দেশের মধ্যে আর দেশের সীমান্তে সুরক্ষা বজায় রাখতে ব্যর্থ, এই সরকারের নীতির কারণেই আবার দেশের বিভিন্ন অংশে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
The post Fourth Pillar | মণিপুর এখনও জ্বলছে, মোদিজি, অমিত শাহের মুখে তালা কেন? first appeared on KolkataTV.
The post Fourth Pillar | মণিপুর এখনও জ্বলছে, মোদিজি, অমিত শাহের মুখে তালা কেন? appeared first on KolkataTV.