বেশ কিছু ঘটনা বলে দিচ্ছে যে বাংলাদেশ আবার এক রাজনৈতিক সামাজিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। যে কোনও ভাঙাগড়ার ইতিহাসে এমনটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু যে কোনও বিপ্লবের জন্ম মানেই তো সঙ্গে সঙ্গে এক প্রতিবিপ্লবেরও জন্ম। যে কোনও অগ্রগতির ইতিহাসের সঙ্গেই জুড়ে থাকে তার বিচ্যুতি আর পতনের ইতিহাস। অগাস্টের অভ্যুত্থান কি আমরা কি খুব ভালো করে বুঝেছিলাম, উত্তর, না অন্তত আমাদের বুঝতে সময় লেগেছে কারণ বাংলাদেশের সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতার সবদিক পরিষ্কার জানা ছিল না। মনে হয়েছিল এক সেকুলার অথচ স্বৈরতান্ত্রিক, বিকাশ আর উন্নয়নে আগ্রহী কিন্তু আপাদমস্তক দুর্নীতির মধ্যে ডুবে থাকা শেখ হাসিনা বা আওয়ামি লিগের সঙ্গে এক মৌলবাদের চূড়ান্ত লড়াই বুঝি বা শুরু হল। পরে দেখেছি ছাত্রদের এই অভ্যুত্থানে এক নতুন গণতান্ত্রিক সাম্যের ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্র গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষাই ছিল এই অভ্যুত্থানের চালিকা শক্তি হিসেবে ছাত্রদের সংগঠনের মূল ভিত্তি। কিন্তু তা যে খুব সহজ পথে আসবে না তাও সেই দিন থেকেই বুঝতে পারছিলাম। এই উপমহাদেশে এক তথাকথিত বড় শক্তি ভারতের হস্তক্ষেপকে অগ্রাহ্য করে, দুনিয়ার আপাতত জ্যাঠামশাই আমেরিকার ট্রাম্পকে অগ্রাহ্য করে, চীনের আধিপত্যবাদী অর্থনৈতিক ধারাকে সামলিয়ে, দেশের ভেতরের চূড়ান্ত মৌলবাদী সংগঠন আর তার মাথাদের প্রতিহত করে, অভ্যুত্থানের জন্মমুহূর্ত থেকে এক প্রতিবিপ্লবের চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়ে নতুন সমাজ বা রাষ্ট্র বানানো সহজ কথা নয়। এতগুলো বিপরীত শক্তি আর ষড়যন্ত্রের মিলিত শক্তি তো কম নয়।
যেই মাত্র স্লোগান এল স্বৈরতন্ত্র বিরোধিতার, অমনি সেই মুজিবের বাকসাল থেকে আরও হাজার ঘটনা সামনে এল, এল বইকী জাতীয় পার্টির সেই স্বৈরাচারের কথা বা ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেওয়া এক দলের কথা, সব ইতিহাস সামনে। আর সব ইতিহাসের মধ্যেই আছে মানুষের রাগ, ক্ষোভ আর ঘৃণা। কাজেই সেদিনের সেসব দল আর তাদের সর্বোচ্চ নেতাদের সমালোচনা যে ঘৃণার জন্ম দিয়েছিল, যে ঘৃণা শতগুণ হয়েছিল হাসিনার কারণে, সেই ঘৃণার সঙ্গেই জুড়ে নেওয়া হল মুক্তিযুদ্ধকেও। একই নিশ্বাসে মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হত, আজ একই নিশ্বাসে দুটোকেই একই সঙ্গে মুছে ফেলার কথাও বলতে শুরু করল কেউ কেউ। কাজেই ছাত্র নেতাদের দায় জন্মাল, তাঁরা বার বার বিবৃতি দিয়ে আলাপ আলোচনায় বোঝাতে শুরু করলেন যে মুক্তিযুদ্ধ চেতনাকে ধরে রেখেই নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে, ৭১-এর পরের মুজিব আওয়ামি লিগ নিয়ে আলোচনা হোক, সমালোচনা হোক কিন্তু ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চেতনা আমাদের কাছে এক ধ্রুবতারা। ছাত্রদের এই আদর্শের বিপরীতে বহু কথা, বহু ষড়যন্ত্র, এবং সেটা ছিল একটা বড় দিক। ধর্মনিরপেক্ষতা, এ আর এক জটিল বিষয়, এক রাষ্ট্রীয় ধর্ম পালন করে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া বা সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের কথা বলা, প্রতি মুহূর্তে এক সাচ্চা মুসলমানও হওয়া আবার দেশের লক্ষ অমুসলমান জনমানসের কথাও মাথায় রাখা। সব মিলিয়ে কাজটা ছোটও নয়, কমও নয়। তো এরই মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি আত্মপ্রকাশ করেছে, এমন তো নয় যে এক বিরাট সময়ের আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এক রাজনৈতিক দল গড়ে উঠল, না, তা তো নয়। এক বিরাট সময়ের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলের এক সুবিধে আছে, তার নেতৃত্ব আর রাজনৈতিক বোধের এক সমানতা থাকে, ভারতের একটা উদাহরণ দিই, অসমে অহমিয়া জাতিসত্তার লড়াই শুরু করেছিল ছাত্ররা, এক বিরাট সময় ধরে সেই আন্দোলন চলেছে, জেল, লাঠি, গুলি, এবং তারপর সেই ছাত্রদের দল তৈরি হয়েছিল অগপ, দুনিয়াতে এমন প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলের সূত্রপাত অনেক অনেক। তাদের অনেকেই সফল, অনেকেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিন্তু মাত্র ৬ মাস আগে বিচ্ছিন্ন কিছু শক্তি, মূলত ছাত্রদের আন্দোলন এত তাড়াতাড়ি এক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়ে যাবে তা সত্যিই বিস্ময়কর এবং সেই কারণেই ভীষণ চ্যালেঞ্জিং।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | এদেশ আদানির, এদেশ আম্বানির, মোদিজি কেবল চৌকিদার
এক স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দুটো অংশের প্রথমটা হল গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা, এবার ভোট হবে, এবার আমাদের সরকার হবে, মানুষের কথা শোনার একটা জায়গা থাকবে ইত্যাদি। দু’ নম্বর অংশটা হল আগের সমস্ত অভাব অভিযোগকে উপড়ে ফেলে এক নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন, এক বিপ্লবের স্বপ্ন, এটা হল এই আন্দোলনের র্যাডিক্যাল পার্ট। দুইয়ে কি বিরোধ আছে? আছে বইকী। এক পাহাড়ের মতো চেপে থাকা ব্যবস্থাতে খানিক গণতান্ত্রিক প্রলেপ, নির্বাচন, হাতের সামনে জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা, কর্পোরেশন ইত্যাদির কাজকর্মে মানুষের খানিক সুরাহা। এটা বরং সহজ। সহজ কারণ ঝাঁকানি খেয়ে ব্যবস্থা নিজেকে বাঁচানোর জন্যই এই কাজগুলো করে, সে হঠাৎই গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে, সে মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। কিন্তু দ্বিতীয় পার্ট, খোলনলচে বদলে এক নতুন দেশ আর নতুন সমাজ? সে এক বিরাট ব্যাপার, বিরাট কাজ। সমস্যা হল বাংলাদেশের এই হঠাৎ অভ্যুত্থান কিন্তু এই দুটো চাহিদারই জন্ম দিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ এক নতুন বাংলাদেশকে দেখতে চায়, ভারত-পাক হেজিমনির বাইরে, সুখসমৃদ্ধ এক স্বাধীন বাংলাদেশ, তারা কেবল নির্বাচন চাইলে সমস্যা কম হত, তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র, কৃষি, শিল্প, চাকরি, নাগরিক পরিষেবার এক আকাশছোঁয়া স্বপ্নকে সামনে এনে হাজির করেছে, এতদিন হয়নি, এবারে চাই। এবং সমস্যাটা এখানেই। ভারতে জরুরি অবস্থার অবসানের পরে এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চেয়েছিল মানুষ, কোনও র্যাডিক্যাল এক্সপেক্টেশন ছিল না, বিপ্লবী চাহিদা ছিল না। আজও আমরা যখন সাম্প্রদায়িক আরএসএস-বিজেপির এই জমানার অবসান চাই, তার জন্য মানুষ রাস্তায় নামে, গলা ফাটায় তখন মানুষের চাহিদা বৈপ্লবিক কিছু নয়, ভাই আমাদের সংবিধানটাকে বিকৃত করিস না, আমাদের সাংবিধানিক কাঠামোগুলোকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দে, আমাদের দেশের মানুষ ইডি-সিবিআই, পুলিশ, এনআইএ আর বুলডোজারের ভয়ে যেন দিন না কাটায়, আমাদের প্রয়োজনে যেন আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারি, এই তো চাহিদা। যা খুব সামান্য এবং যা কেবল নির্বাচনে, গণ আন্দোলনে এই মোদি-শাহ সরকারকে অপসারণের মধ্যে দিয়েই সম্ভব।
কিন্তু বাংলাদেশে এটুকুই চাহিদা নয় আর সেখানেই বিরাট সমস্যা। রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে জাঁকিয়ে বসে আছে সাবেক রাজনৈতিক দলগুলো, বিএনপি এতদিন কুঁকড়ে পড়ে থাকা, যাকে বলে হাইবারনেশন, শীতঘুম কাটিয়ে উঠে বসেছে, এবং তাদের নেতৃত্বের ধারণা তাড়াতাড়ি নির্বাচন হলে তারাই আসবে ক্ষমতায়। তার কারণ তারা আছে দেশ জুড়ে আর তাদের দেশের কোনায় কোনায় কিছু না কিছু সংগঠন আছে, দল চালানোর মতো যথেষ্ট অর্থ আছে, যাবতীয় রীতিনীতি তাদের জানা। তারা দল হিসেবেই ভারত আর চীনের মধ্যে এক বার্গেইনিং ফোর্স হয়ে উঠতে চায়, প্রকাশ্যে তাদের প্রতিনিধিরা গেছেন চীনে, আর গোপনে তাঁদের সঙ্গে নিশ্চিত কথা হয়েছে ভারতের সঙ্গে। মজা হল আপনি যতই ক্যান্টনমেন্ট ইত্যাদির কথা বলুন, বিএনপির সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক জোড়া লাগার কোনও চিহ্ন আজও নেই। জাতীয় পার্টি, বা বাকি ছোট দলেরা একটা সম্মানজনক সংখ্যার জন্য লড়বে, জামাতের হাবভাব বিরাট কিন্তু না আছে সংগঠন না আছে তেমন কোনও র্যাডিকাল চিন্তাভাবনা যা আজকের তরুণদের আকৃষ্ট করে। রমজান মাসে সাচ্চা মুসলমান হওয়ার ইচ্ছে চাগিয়ে উঠলেও বাংলাদেশিরা তো সৌদি হয়ে যাবে না। এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল দেশজুড়ে এখনও আওয়ামি লিগের ভোট, তাদের ভোটও খুব কম নেই, তাঁরা নির্বাচনে দাঁড়ালে, তাঁদেরকে দাঁড়াতে দিলে নতুন আকাঙ্ক্ষার বিরোধী স্থিতাবস্থাপন্থী বাংলাদেশের সাবেক দলগুলোর মধ্যে ভোট ভাগ হয়ে যাবে, তাতে সুবিধে ছাত্রদের নতুন দলের। মানে দেশজুড়ে আওয়ামি লিগের এখনও পড়ে থাকা ২০ শতাংশ ভোট তারা পাবে, বিএনপি ৩০ শতাংশ ভোট পেলেও নতুন দল বেশ খানিক এগিয়েই থাকবে, কিন্তু যদি আওয়ামি লিগকে না লড়তে দেওয়া হয়, তাহলে তাদের ভোট তারা যদি এক বোঝাপড়ার মধ্যদিয়ে বিএনপির কাছে পাস অন করে, তাহলে বিএনপি বিপুল মেজরিটি নিয়েই ক্ষমতায় আসবে। এবং বাংলাদেশ তার যাবতীয় র্যাডিকাল আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে আবার ওই গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু পেয়েছি মনে করেই আবার সেই একই রাজনীতির মধ্য দিয়েই যাবে। এই নতুন দলের আপাতত সমস্যাটা কোথায়? প্রথম সমস্যা হল তারা ঢাকা-কেন্দ্রিক, বড়জোর বলা যায় নগরকেন্দ্রিক, সেটা তারা নিজেরাও জানে। জানে বলেই ওধারে সারজিস আলম উত্তরে আর দক্ষিণে হাসানাত আবদুল্লাহ নেমেছেন মাঠে। কিন্তু ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দিতে হবে, বা দেওয়া হবে, এই দাবি আর আশ্বাসের মধ্যে কতটুকু প্রস্তুতি গড়ে তুলতে পারবে এই নতুন দল? মিরাকল ছাড়া অন্য কোনওভাবেই এই বিরাট কাজ করা সম্ভব নয়। আবার এমনও নয় যে এবারে খুব সামান্যই কিছু আসন পেল নতুন দল কিন্তু আগামী দিনে তারা লড়ে যাবে? না সেখানেও সমস্যা আছে। তারা তাদের তাস ফেলে দিয়েছে সব্বার সামনে, তারা এক খোলনলচে পাল্টানো বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মানুষের কাছে। আর মানুষ, সেই প্রান্তিক মানুষ যারা সারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন ২৪ ঘণ্টা, যাঁদের ঘরে বেকার যুবক, যাঁদের কারখানার চাবি বন্ধ করে মালিক বেপাত্তা, তারা চিরটাকাল সেই অলীক স্বপ্ন নিয়ে বসে থাকবে না। আসলে সেই পুরনো কথা অভ্যুত্থান আর বিপ্লব হল এক বাঘের পিঠের সওয়ারি, পিঠে বসে থাকা খুউউব শক্ত, আর পড়ে গেলে বাঘেই খেয়ে ফেলে। তবুও আমাদের শুভেচ্ছা রইল নতুন দলের জন্য, যাঁরা এক সুখী সমৃদ্ধ পাক-ভারতের দাদাগিরির ঊর্ধ্বে এক স্বাধীন বাংলাদেশকে দেখতে চান। আমরা নজর রাখব সেই শক্তিগুলোর উপরেও যারা এই আকাঙ্ক্ষার বিরোধী, যাঁরা স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনতে চান।