আমরা ইতিমধ্যে সব্বাই জানি যে সেদিন আদতে ওই ছাত্রের গায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চলে যায়নি। জানি যে ওই গাড়ির সামনে পড়ে থাকা ছাত্রের ছবিটি নির্ভেজাল মিথ্যে, এটাও সেই আরজি করের দেড়শো গ্রাম বীর্যের মতোই এক সাজানো ছবি। কিন্তু তবুও আলোচনা তো থামছে না, আমরাও আসুন বোঝার চেষ্টা করি কেন এই ঘটনা ঘটল? কারা এই ঘটনার জন্য দায়ী এবং এই ঘটনার প্রভাব কতদূর পর্যন্ত পড়বে। আজ সেই নিয়েই আলোচনা করার আগেই যা বলব তা হল যাঁরা এই আলোচনাতে আগ্রহী, বিশেষ করে সরকারের সমর্থক, তৃণমূল দলের সমর্থক কর্মীরা, চোখ বুজে একবার ভাবুন যে আহত নয়, যেভাবে সেদিন গাড়ি বের হয়েছে, ড্রাইভার ভয় পেয়ে যাক, মন্ত্রীর শরীর খারাপ, প্রেসার নাকি ফল করছে, সেই তাড়া থাকুক, যে কোনও কারণে যে ভাবে গাড়ি বেরিয়েছে তাতে যদি একজন ছাত্র মারা যেতেন, কয়েকজন গুরুতর আহত হতেন তাহলে আজকের কলকাতা বা বাংলার রাজনৈতিক আবহ ঠিক কেমন হত। আরজি কর সামলে রাজনৈতিক অবস্থার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ২০২৬ টার্গেট করে মাঠে নামছেন, আরজি কর ইস্যুকে কোনওভাবেই না দাঁড় করাতে পেরে বাম নেতারা যখন হাত কামড়াচ্ছেন, হাতে আরও কিছু টাটকা ইস্যু চাই, এরকম ইচ্ছে নিয়ে ওঁত পেতে বসে আছে আছে বিজেপি, তখন এরকম কিছু ঘটলে তার প্রভাব নিয়ে কোনও গবেষণা করার দরকার হত না। আপনি বলতেই পারেন যে কিছু তো হয়নি, মাসির গোঁফ তো গজায়নি তাহলে মাসিকে মেসো বলব না পিসে তা নিয়ে আলোচনার কি কোনও দরকার আছে? আছে বইকী। এরকম পরিস্থিতিকে মোকাবিলা না করতে জানলে, এরকম অবিমৃষ্যকারী কাজের আলোচনার দরকার আছে বইকী।
আমরা তো দেখেছি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, একবার নয় বার বার তিনি ছাত্র বিক্ষোভে সোজা ছাত্রদের মঞ্চে চলে গেছেন, ক’দিন আগেই তিনি সটান হাজির হয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তারদের মঞ্চে, এর আগেও গেছেন। একাধিকবার ওই জয় শ্রীরাম বলে চেঁচামেচি শুনে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছেন, বিক্ষোভ থেমেছে। তার মানে আমি কি ব্রাত্য বসুর কাছে মমতা ব্যানার্জির সাহস দেখতে চাইব? না, ততটা উদ্ভট চিন্তা এখনও করি না কিন্তু খুব সাধারণ একটা বিবেচনাবোধ তো দেখতে চেয়েছিলাম, উনি গিয়েছিলেন তো ওয়েবকুপার সম্মেলনে, অতজন অধ্যাপক, তৃণমূলের কিছু ছাত্রও ছিলেন, সেখানে, বসে থাকতেন আরও পাঁচ ঘণ্টা, মিছিল করে হেঁটে বেরিয়ে এসে পুলিশি সাহায্যে গাড়িতে চড়তেই পারতেন, অ্যাম্বুলেন্স ডাকতেই পারতেন যদি তেমন শরীর খারাপ লাগে, কিন্তু ওইভাবে গাড়ি চালিয়ে চলে যাওয়া? ভুলে যান তিনি মন্ত্রী, ভুলে যান তিনি তৃণমূল, তিনি তো একজন অধ্যাপক, এ কাজ একেবারেই যথাযথ নয়, একাজ অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত, এ কাজ তাঁকে বাকি সারাটা জীবন তাড়া করে বেড়াবে, বলাই বাহুল্য। এবারে আসুন ঘটনার সূত্রপাতে। গত ২১ জুলাই ধর্মতলা মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন প্রায় এক যুগ বন্ধ থাকা ছাত্র সংসদের নির্বাচন চালু হবে, ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। আমরা শেষ হওয়ার কথা ভাবছিও না, শুরুই হল না কেন? কারণ অবশ্যই ওই আরজি কর আন্দোলন।
অগাস্ট থেকে শুরু হওয়া ওই আন্দোলন রাজ্যের আরও অনেক কিছুর মতোই এই ছাত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, রাজ্যজুড়ে এক তুলকালাম অবস্থাকে আরও চাগিয়ে দিতে কোন সরকার এরকম আহাম্মকের মত সিদ্ধান্ত নেবে? এই সরকারও নেয়নি। কিন্তু ইস্যু তো থেকে গেছে। এবং এটা কেবল এক বছরের নয়, প্রায় এক যুগ ধরে কলেজে কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়নি। ছাত্রদের মধ্যে তার চাহিদা আছে বইকী। আর যাদবপুর হল সেই প্রতিষ্ঠান যেখানে সম্ভবত বাম, আরও বাম এবং অতি বাম চিন্তা ছাড়া অন্য যে কোনও মতামতকে পত্রপাঠ নাকচ করার এক ইতিহাস আজ নয় সেই কোন যুগ ধরেই চলে আসছে। এক অতি খাজা ছবি বুদ্ধ ইন আ ট্রাফিক জ্যাম, আম আদমির কথা ছেড়েই দিন অতি সিনেমাপ্রেমীদেরও কেউ পাঁচ সাত মিনিটের বেশি দেখত না, এই যাদবপুরে সেই ছবিকে যে বিরাট প্রচার দেওয়া হয়েছে তা সত্যিই দেখার মতো। কলকাতা সেদিন প্রথম ওই বিবেক অগ্নিহোত্রীর নাম শুনল, এর আগে কলকাতা অগ্নিহোত্রী বলতে অনিতা অগ্নিহোত্রীর নামই জানত। যাদবপুরের এই বহির্বিশ্বের থেকে বিচ্ছিন্ন এক প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ভয়ঙ্কর স্ববিরোধিতা আমরা দেখেছি, দেখেছি বলেই আমাদের ভয় হয়, শহরের মাঝখানে দ্বীপের মতো এক ফ্রাঙ্কেস্টাইনের উপস্থিতি কবে যে কী করে বসে। সে তার আওতার মধ্যে সিসিটিভি লাগাতে দেবে না, কিন্তু সে আরজি করে সিসিটিভি লাগানোর কথা বলেই যাবে, সে এক উচ্চকণ্ঠে গণতন্ত্রের কথা বলে যাবে, অথচ এক বিরোধী মতের সিনেমার প্রদর্শনীকে বানচাল করবে ভিড় দিয়ে। ভিড়তন্ত্র যাদবপুরের হাতিয়ার বারবার। অসম্ভব অগণতান্ত্রিক এক আচরণ বারবার দেখেছি, তার সবথেকে বড় প্রমাণ এক প্রকৃত গান্ধীবাদী মানুষ উপাচার্য গোপাল সেনের হত্যা।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | তৃতীয় বিশ্বের অভিশাপ এই ডোনাল্ড ট্রাম্প
২০ নভেম্বর ১৯৭০। বেলেঘাটা সিআইটি আবাসন থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র অশোক বসু সহ চার জনকে পুলিশ রাতে তুলে নিয়ে আবাসনের দেওয়ালে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পর দিন এলাকার বাসিন্দারা প্রতিবাদ মিছিল করেন, সেই সঙ্গে গোপালচন্দ্র সেনই পশ্চিমবঙ্গে প্রথম উপাচার্য যিনি ধিক্কার-বিবৃতি দেন, কোনও অছিলাতেই ছাত্র-যুবকদের পুলিশি হত্যা সমর্থনীয় নয়, বরং শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তিনি বলেছিলেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব স্বাধীনতা বজায় রাখার বিষয়ে তিনি বরাবরই আপসহীন ছিলেন। ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭০, তাঁর কাজের মেয়াদের শেষ দিন। অফিসের শেষ ফাইলে সই করে সন্ধে সাড়ে ছ’টায় উপাচার্য বাড়ি ফিরছেন। এ দিনও হেঁটেই ফিরছেন, একটু আগে রেজিস্ট্রার এসে তাঁকে গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। উপাচার্য সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন সেই প্রস্তাব। লাইব্রেরির পাশে, পুকুরপাড় দিয়ে রোজকার মতো হেঁটে এ দিনও তিনি বাড়ি ফিরতে চান। সেই ফেরা আর হয়নি। আততায়ীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে, পুকুরপাড়েই তাঁকে হত্যা করল। এটাও সেই যাদবপুর উপাখ্যান। সেই যাদবপুরে এবারের ঘটনার ইস্যু তো ছিল ছাত্র সংসদের নির্বাচন, কিন্তু ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে? ওয়েবকুপার সম্মেলন, তৃণমূলপন্থী অধ্যাপকদের সংগঠন, ওই যাদবপুর ক্যাম্পাসের ভিতরে এবং তার আগে আলোচনা সভাও আছে, বিষয় শিক্ষার গৈরিকীকরণ, গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা, সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল বা অধ্যাপক শিবাজি প্রতিম বসুও আছেন। প্রথম অর্ধে এসব হয়ে যাওয়ার পরে সেকেন্ড হাফে ব্রাত্য বসু এলেন, না সামনের দরজা দিয়ে নয়, তিন নম্বর গেট দিয়ে, তার মানে এরকম হাঙ্গামার প্রস্তুতি আছে তার খবর তাঁর কাছে সম্ভবত ছিল, আমাদের কাছে খবর আছে অন্তত দিন দুই আগে থেকেই ছাত্রদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এই প্রতিবাদ হবে, তার প্রস্তুতিও ছিল।
শহরের কেন্দ্রে বসে কথায় কথায় মানবাধিকার, ছাত্র অধিকার, বাজারি চ্যানেলের ঢালকে সামনে রেখে যে উৎকট বিপ্লবীপনা দেখানো হয় সেটা এক জঘন্য হিপোক্রেসি, কাছ থেকে দেখলে বোঝাই যাবে যে এনারা আসলে সেই ভুল বা ঠিক যাই হোক না কেন অত্যন্ত সৎ মানুষগুলোর আত্মত্যাগের মিথকে সামনে রেখে এক আবেগকে কাজে লাগিয়ে আসলে এক ফেরেব্বাজিতে মেতেছেন। কোন সাধারণ চিন্তাভাবনায় এক সংগঠনের সম্মেলনে ঢুকে পড়ে স্লোগান শাউটিং করা, গ্লাস ছোড়া, ব্যানার ছেঁড়া চলতে পারে? কোন সংগঠন সেটা অ্যালাও করবে? কেন করবে? ডানকুনিতে সিপিএমের সম্মেলন হচ্ছে আমি কমরেড সেলিমের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দিতে সম্মেলন কক্ষে ঢুকে যাব? কোন সংগঠন যাবে? এই যাদবপুরের ছেলেমেয়েদের এক অংশ এক সংগঠনের সম্মেলন কক্ষে ঢুকে পড়লেন, কেন? তাহলে নির্বাচন ইস্যু নয়? সন্ধের প্রাইম টাইমে নিউজ হয়ে ওঠাটাই ইস্যু? এবং সেখানেও অবাক করে দিয়েই ব্রাত্য বসু তাঁদের এক অংশকে ডাকলেন, তাঁরা তাঁদের লিখিত ডেপুটেশন দিলেন, ছবি তোলালেন, খানিক সেই জেএনইউর ছাত্রদের, সীতারাম ইয়েচুরি ইত্যাদিদের সামনে ইন্দিরা গান্ধীর ছবিটার কথা মনে পড়বে। বেশ করলেন, এক ধরনের উদারতা, যা এক অধ্যাপক, এক অভিভাবক সুলভ ব্যাপার। কিন্তু এরপরেও বাইরের ঝামেলা কমছে না। অতঃকিম? এইখানেই সিদ্ধান্তহীনতা, অন্তত আমার বিচারে। উনি গাড়িতে উঠে বললেন চলো।
এরপরের ছবি আমরা সবাই ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছি। অবশ্যই গাড়ির তলায় চাপা পড়া ছেলের ছবি ফেক, এটা সম্ভবত এখন বিরোধী রাজনীতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিজেপি শিখিয়েছিল, বামেরা তা রপ্ত করেছে। গাড়ির বনেটে ছাত্ররা চড়েছিল? হ্যাঁ। সামনে জুতো রাখা হয়েছিল, হ্যাঁ। গাড়ির সামনের জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল? হ্যাঁ। গাড়ির কাচে ঢাকা দেওয়া হয়েছিল? হ্যাঁ। গাড়ির কাচ ভাঙা হয়েছিল? হ্যাঁ। গাড়ি ব্রেক কষতেই ওই ছেলেটি পাশে ছিটকে পড়ে, সেখানে রাখা স্কুটিতে সে আহত হয়, এটাও সত্যি। সে আক্ষরিক অর্থে গাড়ি চাপা পড়েনি আর সেটা বোঝার জন্য ফ্রেম টু ফ্রেম ছবি দেখার বদলে তার ইনজুরি, তার দেহের আঘাতগুলোর আকার প্রকার দেখলেই হবে, আমাদের পরিচিত এক ডাক্তার বললেন গাড়ির চাকার চাপে নাক, মুখের হাড় না ভেঙে, ভুরুর ওপরে এক ক্ষত হওয়াটা অসম্ভব। কিন্তু দুজন আহত। একজনের চোখের উপরে লেগেছে, একজনের পা ভেঙেছে। একজন এসএফআই করেন, একজন আরএসএফ করেন। প্রশ্ন হল যিনি এসএফআই করেন, তিনি কি জানতেন যে তাঁর নেতারা ডেপুটেশন দিয়েছেন এবং মন্ত্রী সেই ডেপুটেশন নিয়েছেন। দ্বিতীয়জন ভারত রাষ্ট্রের ধ্বংস চান, চাইতেই পারেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় আছে, মতবাদ প্রচার করাটা অন্যায় নয়, তবে এই মতবাদ আপাতত দেশের বিজেপি শাসিত রাজ্যে প্রচার করতে গেলে বাড়ির সামনে বুলডোজার থাকবেই। এখানে মামলা হয়েছে, শোনা যাচ্ছে সেসব মামলা নিয়ে খুব বেশি এগোনোর কথা ভাবাও হচ্ছে না, মামলাগুলোও আজব, সোনার হার ছিনতাই ইত্যাদি, এখনও পুলিশ সেই কোন মান্ধাতার জমানাতে আটকে আছে। কিন্তু এত কথা বলার পরেও বলব, এই ছাত্র যৌবন এক অদ্ভুত সময় ভুল করার সময়, ভুল করে শেখার সময়, এদের অনেকেই ২০ বছর পরে হয়ে উঠবেন এক রেসপন্সিবল সিটিজেন, কেউ বা এক উদার গণতন্ত্রের প্রচারক, কেউ বা সমাজসেবী, কেউ বা কিছুই নয়, কেউ বা আমেরিকাতে সেটল করে ফেসবুকে টাঙিয়ে রাখবেন হোক কলরব। কিন্তু শেষ কথা হল মন্ত্রীমশাই ভুল করেছেন, ভয়ে, চাপে, বিবেচনা বোধের বাইরে কাজ করেছেন, যার এক সাঙ্ঘাতিক পরিণাম হতেই পারত। এক সিনিয়ার তৃণমূল নেতা বললেন, মুখেও আনবেন না, ভাবতেও পারছি না কী হতে পারত। হ্যাঁ, এক নেত্রীকে দেখেই অনেকে তৃণমূলে গেছেন বটে, কিন্তু ষোলো আনা বাদই দিলাম, দু’ চার আনাও যদি রপ্ত করতে পারতেন, তাহলে এই ঘটনাগুলো ঘটত না। আসলে মমতার দল করা খুবই সহজ, রাস্তায় নেমে স্লোগান দিলেই হল, মমতা হয়ে ওঠা সহজ নয়, অনায়াসে এড়িয়ে যাওয়া যেত এমন এক বিক্ষোভ হুজ্জুতিকে অপ্রয়োজনীয় ফুটেজ দিলেন মন্ত্রীমশাই। আর তারচেয়েও বড় কথা হল, যে দাবি উঠেছে তা নিয়ে এখনই সিরিয়াসলি ভাবা উচিত, ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচন হওয়াটা খুউউব জরুরি, না হলে আগামী দিনে আরও জটিলতা বাড়বে তা বলাই বাহুল্য।