কল্যাণ সিং মারা গেলেন, লক্ষ্ণৌতে তাঁর মরদেহের ওপর জাতীয় পতাকা রাখা হল, স্বাভাবিক, কারণ তিনি দু দুবার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, সাংসদ ছিলেন, রাজস্থানের রাজ্যপাল ছিলেন। কিন্তু সেই জাতীয় পতাকার ওপর আবার বিজেপির পতাকা রাখা হল, মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ যোগী এলেন, সেই জাতীয় পতাকার ওপরে রাখা বিজেপির কমল ছাপ পতাকায় ঢাকা কল্যাণ সিং এর শবদেহের ওপরে মালা রাখলেন, প্রণাম করলেন। একটু পরে সে পতাকা সরিয়ে নেওয়া হল, এবার রঙ্গমঞ্চে দেশের প্রধানমন্ত্রী, শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনিও চলে গেলেন। রাজনৈতিক মহল, সংবাদ মাধ্যমে বিতর্ক তৈরি হল, কেন জাতীয় পতাকার ওপর দলের পতাকা রাখা হল? আসলে আরএসএস বিজেপি জাতীয় পতাকা, সংবিধান, দেশের বিচার ব্যবস্থা, সংসদীয় গণতন্ত্র কোনওটাতেই এতটুকু বিশ্বাসও করে না, তারা এই ব্যবস্থাকে ব্যবহার করছে মাত্র, তাদের লক্ষ হিন্দু রাষ্ট্র, তাদের লক্ষ মনুস্মৃতির আইন ব্যবস্থা, তাদের লক্ষ ভাগওয়া ঝান্ডা, আরেকবার সেই বিষয়টাই সামনে এল মাত্র, যে জাতীয় পতাকা দিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘাম মোছেন, যে সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আরএসএস বিজেপি দেশ চালানোর চেষ্টা করে, তাদের কাছ থেকে এটাই আশা করা যায়। তাঁরা সেটাই আন্তরিকভাবেই করে চলেছেন, যাঁরা মনে করছেন, হঠাৎ একটা ভুল হয়ে গেছে, কেউ একজন উৎসাহী এই কাজ করেছেন, তাঁরা ভুল ভাবছেন। আর কল্যাণ সিংয়ের গোটা জীবন, তাঁর কর্মপদ্ধতি, তাঁর মুখ্যমন্ত্রীত্বের সময়কালের ওপর একটু নজর রাখলে বোঝাই যাবে যে তিনিও সেই পথেরই পথিক ছিলেন, কোনও দিন দেশ, জাতীয় পতাকা, সংবিধান, দেশের বিচার ব্যবস্থা তাঁর কাছে প্রাধান্য পায়নি। প্রাধান্য পেয়েছে দল, দলের মতাদর্শ।
আজকে বিজেপির যে রমরমা, আজ যে শক্তি নিয়ে তারা সারা ভারতে রাজত্ব করছে, তার সিংহভাগ প্রাপ্য এই কল্যাণ সিংয়ের। লোধ সম্প্রদায়ের এই কল্যাণ সিং যখন ১৫ বছরের, তখন দেশ স্বাধীন হয়। তিনি তখন আরএসএসের স্বয়ংসেবক, তার ক’দিন পরেই হিন্দু মহাসভার সক্রিয় সদস্য নাথুরাম গডসে খুন করছে, জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে। সেই তখন থেকেই বিজেপি বুঝেছিল, হিন্দু মানে কেবল উচ্চবর্ণকেই নিয়ে চললে, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা যাবে না। তারা অনুসূচিত জাতি আর উপজাতিদের মধ্যে তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছিল। কল্যাণ সিং লোধ সম্প্রদায়ের নেতা হয়ে উঠলেন, বিকেলে শাখা আর সকালে জনসংঘ। তাঁর জন্মভূমি, আলিগড় জেলার আত্রাউলি থেকে ১৯৬৭ তে জনসংঘের প্রার্থী হলেন, জিতলেন। কেবল সেবারেই নয়, ১৯৬৭ থেকে ২০০২ এর মধ্যে ১০ বার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন এই আত্রাউলি থেকে, ৯ বার জিতেছেন, একবার ১৯৮০ তে হেরে গিয়েছিলেন, উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির রাশ থাকত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাতে, ব্রাহ্মণরা সংখ্যায় কম হলেও, তাঁরাই ছিলেন নেতা, কংগ্রেসের নেতা, সমর্থন ছিল মুসলমান আর নিম্নবর্ণের মানুষদের। এই রাজনীতি ভি পি সিংয়ের সময়ে বদলে গেলো, মণ্ডল কমিশন এনে তিনি উত্তর ভারতের, গোবলয়ের রাজনীতির সমীকরণ বদলে দিলেন, সেই সমীকরণ আটকাতে বিজেপি কমন্ডুলের রাজনীতি নিয়ে মাঠে নামলো, সঙ্গে হাতিয়ার লোধ সম্প্রদায়ের নেতা কল্যাণ সিং। তিনি তখন হিন্দু জাগরণের কথা বলছেন।
১৯৯০ রামরথ যাত্রা, রথে চড়লেন আদবানি, পাশে আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যেখান দিয়ে রথ চলল, সেখানেই হিংসা ছড়িয়ে পড়ল। আলিগড়ে ধারাবাহিক হিংসার ঘটনা ঘটল। উত্তরপ্রদেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, এবারেও সামনের সারিতে কল্যাণ সিং, কেবল উচ্চবর্ণের নয়, নিম্নবর্ণের মানুষকেও হিংসাতে সামিল করা হল, ফল হাতে নাতে। জুন ১৯৯১ এ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হলেন কল্যাণ সিং, শ্লোগান উঠল, মন্দির ওঁহি বনায়েঙ্গে, বলা হল বচ্চা বচ্চা রাম কা, জনমভূমিকে কাম কা, হাতে তরোয়াল, মাথায় গেরুয়া ফেট্টি গেরুয়া ফৌজ তৈরি হল। না একটা জাতিগত হিংসার বিচার হল না, যারা হিংসা ছড়াল তাদের একজনকেও ধরা তো হলই না, তারা তখন মিছিল করছে, অভি ন জিসকা খুন না খৌলা, খুন নঁহি ও পানি হ্যায়। আর প্রতিটা সভায় মুখ্যমন্ত্রী নিজে হাজির, গোটা গোবলয়ের রাজনীতি বদলাতে থাকল দ্রুত, সমর্থন বাড়তে থাকল বিজেপির। বাবরি মসজিদ ভাঙার যাবতীয় পরিকল্পনা তৈরি হতে থাকল, হ্যাঁ মুখ্যমন্ত্রীর আবাসে বসেই সেই নীল নকশা তৈরি হল, এবং দেশের সামনে একের পর এক বিবৃতি দিয়ে স্বয়ং কল্যাণ সিং জানালেন, শান্তিপূর্ণভাবে করসেবা চলবে, তাঁর সরকার সুরক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছে। এরই মধ্যে, বিতর্কিত বাবরি মসজিদের চারপাশের বিরাট জমি অধিগ্রহণ করল কল্যাণ সিং সরকার। ২.২৭ একর জমি, বলা হল তীর্থ যাত্রীদের সুবিধের জন্য করা হচ্ছে, যদিও আসলে তা রামলালার পরিক্রমা হিসেবে ব্যবহার করা হতে লাগল। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ওই জমি ব্যবহার শুরু হল। ওইখানে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী, গেলেন মুরলি মনোহর যোশি, বললেন রামমন্দির ওখানেই হবে। একমাত্র বাধা আসছিল বাবা লাল দাসের কাছ থেকে, তিনি রামলালা বিগ্রহের মুখ্য পুরোহিত। তিনি চাইছিলেন না এই ইস্যু নিয়ে বিবাদ হোক, চাইছিলেন না হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতি ক্ষুণ্ণ হোক, বরং সাংবাদিকদের ডেকে বলছিলেন কিভাবে চক্রান্ত চালানো হচ্ছে। ইউ টিউবে তাঁর সেই সাক্ষাৎকার আজও আছে। মার্চ ১৯৯২, তাঁকে তাঁর পদ থেকে সরালেন কল্যাণ সিং, তারপর ডিসেম্বর ১৯৯২। সারা দেশ শুনছে, বাবরি মসজিদ ভাঙা হবে, মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, তিনি বলছেন গুজবে কান দেবেন না, শেষমেষ তিনি আদালতে এফিডেভিট করে জানালেন যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হবে না। তাঁর সরকার সব বন্দোবস্ত করবে।
এদিকে বিজেপি নেতারা বলতে থাকলেন, মুসলমানদের মক্কা থাকতে পারে, খ্রিস্টানদের ভ্যাটিকান থাকতে পারে, আর হিন্দুদের অযোধ্যা থাকতে পারে না? সুপ্রিম কোর্টের কাছে কল্যাণ সিং সরকার এফিডেভিট করে জানালেন, বাবরি মসজিদের কোনরকম ক্ষতি হবে না, রাজ্য সরকার সেই দায়িত্ব নিচ্ছে। ৬ ডিসেম্বর রাজ্য পুলিশ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখল, করসেবকরা ঘন্টা ৬/৭ এর মধ্যে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে জমি সমান করে দিল। না একটা টিয়ার গ্যাস চলেনি, গুলি চলার প্রশ্ন নেই, উদ্বেল আদবানি, উমা ভারতী, মুরলি মনোহর যোশী, চোখে আনন্দাশ্রু, শ্লোগান উঠছে, ইয়ে তো পহেলি ঝাঁকি হ্যায়, কাশী মথুরা বাকি হ্যায়। সংবিধানের শপথ গেল গড়ের মাঠে ঘাস কাটতে। রাজ্য সরকারের দেওয়া আদালতের এফিডেভিট পড়ে রইল। বাবরি মসজিদ ভাঙা হল, কল্যাণ সিং পদত্যাগ করলেন। সরকার যায় যাক, আরএসএসের স্বয়ংসেবকের কাছে আদর্শ অনেক বড়। কারণ এই ঘটনা ভারতের রাজনীতিকে আরেক নতুন মোড়ে এনে দাঁড় করালো। রাইজ অফ হিটলার দেখুন, ইতিহাস পড়ুন, মিল পাবেন। বিরোধীরা স্তম্ভিত, ছত্রভঙ্গ, বিজেপি উল্লাসে ফেটে পড়ছে। দেশ জুড়ে হিংসা, সেই হিংসার প্রতিক্রিয়ায় আবার হিংসা। সেই হিংসা সারা উত্তরভারত জুড়ে, যেখানে বিজেপির সমর্থন বেড়ে দ্বিগুণ, লাশের রাজনীতি। ২৩ ডিসেম্বর ১৯৯৩, মানে একবছর পর বাবা লাল দাসকে গুলি করে খুন করা হল, বহু পরে জানা গেলো, পুরনো এক জমি সংক্রান্ত বিবাদের ফলেই নাকি বাবা লাল দাসকে খুন করা হয়েছিল, দুজনকে ধরাও হয়, তাদের জেলও হয়। আসল খুনিরা আজও অধরা, আসল কারণ সবার জানা। এবং শেষমেষ, ৫ অগস্ট নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে রামজন্মভূমির ভূমিপুজোও হয়ে গেলো, উপস্থিত থাকলেন উমা ভারতি, আদিত্যনাথ যোগী, আরএসএস চিফ মোহন ভাগবত, বাবা রামদেব। মোদিজি বললেন, এ ছিল ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ, যে যুদ্ধের পয়লা নম্বর সেনানী ছিলেন কল্যাণ সিং। যিনি সংবিধানের নামে শপথ নিয়ে, সবার সামনে সেই শপথ ভেঙে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, দেশ নয়, সংবিধান নয়, তাঁর কাছে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু রাষ্ট্রের আদর্শ। সেদিন কল্যাণ সিং যেভাবে সংবিধানের সঙ্গে, বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, তা ছিল আরএসএস হিন্দু মহাসভার ব্রিটিশ ভারতবর্ষে, বিশ্বাসঘাতকতার ধারাবাহিকতা মাত্র, আসলে এই সংগঠন কোনও দিন, দেশের সংবিধান, জাতীয় পতাকা, বিচার ব্যবস্থাকে মেনে নেয়নি, আজও না। সেই দলের উত্থানের এই কারিগরের শবদেহের ওপর জাতীয় পতাকা বেমানান, বেমানান বলেই তার ওপরে রাখা হল বিজেপির পতাকা, সামনে দাঁড়ালেন তাঁরই উত্তরসূরি আরেকজন হিন্দুরাষ্ট্রের উদগাতা, আদিত্যনাথ যোগী।