চতুর্থ স্তম্ভ বহু মানুষ দেখেন, প্রশংসা করেন, ফোন করেন, সঙ্গে আছেন বলে জানান, কিছু মানুষ ট্রোল করেন। দু-তিন টাকা ট্রোল পিছু পান, টাকাটা রোজগার করলে বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে, করুন। কিছু লোক আছেন যাঁরা ট্রোল করেও খুশি হন না, তাঁরা অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ করেন। মায়া হয়, ভয় লাগে সেই সব মানুষের ঘরে জন্ম নেওয়া শৈশবের জন্য। কিছু সিরিয়াস মানুষ-জন আছেন, যাঁরা প্রশ্নও করেন, উপদেশও দেন, বিষয় বলে দেন, যা নিয়ে আগামী চতুর্থ স্তম্ভ হতে পারে। এরকমই একজন গতকাল এক দীর্ঘ ফোনালাপে বললেন, আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি মিথ্যেবাদী বলছেন, এটা কি উচিত? আফটার অল তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী। বহুক্ষণ আমাদের কথা হল, শেষমেষ লেট আস এগ্রি টু দিস বলে আলোচনা শেষ করতে হল। কিন্তু আমার মনে হল এ প্রশ্ন তো স্বাভাবিক, ভারতবর্ষের মত এক বিশাল দেশ, এক ঐতিহ্যশালী দেশ, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রীকে মিথ্যেবাদী বলা, প্রাইম টাইমের জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে বারবার মিথ্যেবাদী বলার একটা ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত। আসুন এই আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক। কানা কে কানা বলিও না, খোঁড়া কে খোঁড়া বলিও না, আমরা শিখেছি। কেন? কারণ যে খোঁড়া, যে কানা, যে মোটা, যে কালো, তার সেটা শারীরিক বৈশিষ্ট্য, জন্ম থেকেই বা জন্মের পরে যাই হোক না কেন। এগুলো হওয়ার মধ্যে কোনও অন্যায়ও নেই। কিন্তু মিথ্যেবাদীকে মিথ্যেবাদী বলব না কেন? মিথ্যেবাদিতা কোনও গুন নয়, মিথ্যে বলিও না, এটাই তো বাবা-মা, শিক্ষকরা শিখিয়েছেন। তারপরেও মানুষ মিথ্যে বলে, প্রয়োজনে বলে, পেটের জন্য বলে, অপ্রয়োজনেও বলে। রাজনেতারাও ব্যতিক্রম নন, তাঁরাও আকছার বলেন। এই বাংলায় এক কংগ্রেসী নেতা কাউকে হাওড়া স্টেশনে দেখা করতে বললে, সেই মানুষটি এয়ারপোর্টে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, সবাই ওনার মিথ্যের বহরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারতেন না। সারা দেশের নানান রং, নানান মত, নানান দলের রাজনেতাদের মিথ্যের লিস্ট তৈরি করলে মহাভারত এর একটা অধ্যায় হয়ে যাবে, এবং সেটা সবাই জানেন। কিন্তু নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি এই সব্বার থেকে আলাদা, এক্কেবারে আলাদা। ওনার মিথ্যে প্রতিপদে। মিথ্যে প্রতিটা কথায়। জন্ম তারিখ, পড়াশুনো, ছেলেবেলা, পেশা, রাজনৈতিক আন্দোলন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতি, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে মিথ্যে, বিশুদ্ধ মিথ্যে বলেই চলেছেন, নন স্টপ লাইং যাকে বলে। মজার কথা হল যে আমি একলা নই, বহু মানুষ এই ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যের কথা মানুষকে বলেছেন, বলছেন। অনেকেই সাফ বলছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী মিথ্যেবাদী। প্রধানমন্ত্রী দপ্তর থেকে সেসব কথার নিয়মমাফিক প্রতিবাদও নেই, তার বদলে নতুন মিথ্যে সামনে চলে আসছে। এমনটা এর আগে দেশের মানুষ দেখেননি। নেহেরু তাঁর শেষের দিকে মেজাজ হারাতেন, তাঁর কিছু বিলাসব্যসন ছিল, রুপোর চামচ মুখে জন্ম নেওয়া নেহেরুর সেই বিলাসব্যসনে অভ্যস্ত হওয়ার সুযোগও ছিল। তিনি উদার গণতান্ত্রিক ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী, ফিরোজ গান্ধীর বিয়ের সময় ছাড়া সর্বসমক্ষে হিন্দুধর্মের রীতিপালন করতে তাঁকে দেখা যায়নি। খুব কম সময়ের জন্য লালবাহাদুর শাস্ত্রীজি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সল্পবাক, ঋজু ব্যক্তিত্বের এই মানুষটি সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। এরপর ইন্দিরা গান্ধী, গুংগি গুড়িয়া থেকে এক হার্ডকোর পলিটিসিয়ান, একজন দক্ষ প্রশাসক হয়ে ওঠার মধ্যেই কখন তাঁর মধ্যে জন্ম নিয়েছিল স্বৈরতন্ত্র। কিন্তু অনায়াসে সত্যি বলতেন, যা সত্যি বলে মনে করতেন তা লুকানোর কোনও চেষ্টা তাঁর ছিল না। এরপর এক ফ্যামিলিম্যানের কাঁধে প্রধানমন্ত্রীত্ব হঠাৎই চেপে বসল। রাজীব গান্ধীই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি ছুটি নিয়ে পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে গিয়েছিলেন আন্দামানে। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠছিলেন এক সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নেতা। কিন্তু তার আগেই তাঁকে হত্যা করা হল। নরসীমা রাও ছিলেন ঝানু রাজনীতিবিদ, দেশের প্রথম চাণক্য, অনায়াসে সংখ্যালঘু মন্ত্রিসভা নিয়ে চালিয়ে গিয়েছেন, পণ্ডিত মানুষ ছিলেন, জীবন যাপনও ছিল খুব সাধারণ। অটলবিহারী বাজপেয়ী বিজেপির হলে কী হবে, শুধু আমিষ খেতেই নয়, সপ্ত-ব্যঞ্জন পানীয় সমেত আহার করতে ভালোবাসতেন, সিনেমা দেখতে ভালোবাসতেন, কবি ছিলেন, কবি সম্মেলনে কবিতা শোনাতেন এবং সেসব সত্যিই কবিতা ছিল। জীবন-যাপনে এমন কোনও আহামরি বারফট্টাই ছিল না। পোশাকও ছিল খুব সাধারণ। না, মিথ্যে বলতেন না, প্রশ্নের মুখে ৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়ে তিনি ব্রিটিশ পুলিশকে মুচলেকা দিয়েছিলেন, সেটা নিজেই জানিয়ে ছিলেন, বলেওছিলেন, ভয় পেয়েছিলাম, প্রাণের ভয়, পরিবারের ওপর অত্যাচারের ভয়। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতেন, বহু সমালোচক সাংবাদিকদের ডেকে খাওয়াতেন, এই গুন অবশ্য নেহেরুরও ছিল, রাজীব গান্ধীর সঙ্গেও সাংবাদিকদের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। মনমোহন সিং, অনেকেই বলেন তিনি রিমোট কন্ট্রোলে চলতেন, কিন্তু তাঁর সময়ে আর্থিক নীতির যে পরিবর্তন হয়েছিল, তা ছিল একান্তভাবেই ওনার। খুবই সাধাসিধে জীবন-যাপন ছিল, কথা কম বলতেন, মিথ্যে বলতেন না। এইবারে মঞ্চে নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি। চূড়ান্ত অসংলগ্ন কথাবার্তা, মিথ্যে কথা বলা, দিনে চারবার, পাঁচবার জামাকাপড় পাল্টানোর অভ্যেস, বিদেশি ব্র্যান্ডেড গগলস, ঘড়ি, পেন নিয়ে এক ফ্ল্যামবয়ান্ট প্রধানমন্ত্রী সমানে মেক ইন ইন্ডিয়া, মেড ইন ইন্ডিয়া নিয়ে ভাষণ দিয়েই যাচ্ছেন। লোকসভা এবং গুজরাত বিধানসভার ওয়েবসাইটে তাঁর জন্মদিন ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫০, আর উত্তর গুজরাটের ভিস্নগড় এমএন কলেজ অফ সায়েন্সে প্রি সায়েন্স, এখনকার ক্লাস টুয়েলভের ছাত্র নরেন্দ্রকুমার দামোদরদাস মোদির জন্ম তারিখ ২৯ অগাস্ট ১৯৪৯। মোদিজির দাদা জানিয়েছেন হরোস্কোপে মোদিজির জন্মদিন ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫০, তাহলে স্কুলে অমনটা হল কী করে? এদিকে বহু পরে পাওয়া তথ্যে জানা গিয়েছে মোদিজি এন্টায়ার পলিটিক্যাল সাইন্সে এম এ পাস করেছেন গুজরাত ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৮৩-তে, সেই সার্টিফিকেটে মোদিজির কোনও জন্ম তারিখ নেই, ওদিকে ওইএন্টায়ার পলিটিক্যাল সায়েন্সও বেজায় গড়বড়ে, তেমন কোনও সাবজেক্ট গুজরাত বিশ্ববিদ্যলয়ে কোনওদিনও পড়ানো হয়নি। আবার মোদিজিকে এইসব পড়িয়েছেন তেমন কোনও অধ্যাপককেও পাওয়া যায়নি, অধ্যাপক তো দুরস্থান, সেই সময়ের কোনও সহপাঠীও পাওয়া যায়নি, যিনি ওই এন্টায়ার পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়েছেন। এসব গোলযোগের কোনও ব্যাখ্যা মোদিজি কি দিয়েছেন? না দেননি। এখন বলতেই পারেন, প্রধানমন্ত্রী হতে গেলে কি এম পাস করা জরুরি? ক্লাস এইট পাস করাও কি জরুরি? বলতেই পারেন, সেই সময়ে বাবা-মার অনীহার কারণেই ডেট অফ বার্থে গোলযোগ থাকতো, সত্যি, ১০০% সত্যি। কিন্তু তাহলে তো সেটা বলে দিলেই ল্যাটা চুকে যায়। সেসব না বলে, সেই সময়কার সার্টিফিকেট বলে যা সামনে না হল, তাতে আরও কেলো, সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটে কম্পিউটারে নাম লেখার কথাই নয়, তখন হাতেই লেখা হত, কিন্তু মোদিজির সেই ১৯৮৩ সালের সার্টিফিকেট কম্পিউটারে ছাপা। যা বোঝার বুঝুন, মিথ্যেবাদী বলবেন না? লায়ার বলুন। তারপর এল তাঁর ছোটবেলার সাহসিকতার গল্প, গুজরাতের অখ্যাত গ্রামের পুকুর থেকে আস্ত মগরমচ্ছ, কুমির ধরে ঘরে ফিরলেন ডমরুনারায়ন নয়, নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি, তাঁর সচিত্র জীবনী ‘বাল নরেন্দ্র’-তে এর বর্ণনা এবং ওই খুঙ্খার কুমিরের ছবিও আছে। অবশ্য সে কুমিরের শেষ গতি কী হয়েছিল, তা তিনি বলেননি, ওই বাল নরেন্দ্রতেও নেই। এরপর জীবন সংগ্রাম, চায়ওলা মোদিজি, বচপন বিতা চায় বেচকর, ম্যায় এক চায়ওলা থা, বোঝা গেল, কিন্তু চা বিক্রি করতেন কোথায়? স্তালিন জুতো সেলাই করতেন, জায়গাটা এখনও আছে, তিনি তাঁর পেশাতে মাহির হয়ে উঠেছিলেন, তার প্রমাণ আছে, একজোড়া বুটে বছরের পর বছর কাটিয়েছেন, স্তালিনের জুতো খারাপ হয় না, উনি নিজেই তার মেরামত করে নেন, সোভিয়েত আমলারা জানতেন। কিন্তু এই নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি চা বিক্রি কোথায় করতেন? প্রশ্ন উঠতেই এক স্টেশনের নাম বলা হল, হৈচৈ, পাওয়া গিয়েছে, পাওয়া গিয়েছে সেই পূণ্যস্থল, যেখানে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী কেটলি হাতে চা বিক্রি করতেন। রেল দপ্তর যখন সেই রেল স্টেশন নিয়ে ধামাকা করার কথা ভাবছেন, সেই সময়ে তথ্য এল সামনে, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সেই সময়ে ওই স্টেশন তৈরিই হয়নি, তাহলে? ধরে নিলাম সেই কল্পিত স্টেশনে, কল্পনার কেটলিতে চা বিক্রি করতেন উনি, কিনতো কারা? খেতো কারা? মাঝমাঠে রোজ ট্রেন দাঁড় করানো হতো? হুড়মুড় করে কল্পনার ট্রেন থেকে কল্পনার যাত্রীরা নেমে এসে গরম চা খেতেন? ডাহা মিথ্যে, উনি মিথ্যেবাদী, আপনি মিথ্যেবাদী বলবেন না? ঝুটা কঁহিকা বলুন।
এরপর জরুরি অবস্থা, সত্যিই তো সেদিন এমার্জেন্সির বিরুদ্ধে জনসঙ্ঘের নেতারাও রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, আদবানি, অটলবিহারী তো বটেই, তাঁদের তো জেলে পোরা হয়েছিল, গ্রেফতারি এড়িয়ে সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলিরা সারা দেশজুড়ে কাজ করেছেন, সুব্রহ্মণিয়ম স্বামী তো মিথ হয়ে রয়ে গিয়েছেন, ছদ্মবেশ তাঁর হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া এবং পুলিশের চোখ এড়িয়ে সংসদভবনে ঢুকে পড়ার কাহিনি নিয়ে। সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে জয়প্রকাশ নারায়ণ সমেত অনেকে জেলে ছিলেন শুরু থেকেই, কিন্তু জর্জ ফার্নান্ডেজ মূলত এক সর্দারজি সেজে সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। মোদিজি কোথায়? কোনও তথ্য নেই, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে জানা গেল তিনিও নাকি পালিয়ে বেড়িয়েছেন, আবার সেটাও নাকি সর্দারজি সেজে, একটা ছবিও পাওয়া গেল, পোজ দেওয়া ছবি। মানে পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে ছবিও তুলেছেন। জর্জ ফার্নান্ডেজের অমন ছবি কিন্তু নেই। জরুরি অবস্থায় তাঁর বিশাল লড়াই এর কথা কোনও পত্র পত্রিকায় না পাওয়া গেলে কী হবে, ১৯৭৮-এ উনি নিজেই গুজরাতি ভাষায় একটা বই লিখে ফেললেন, যেখানে তিনি কিরকম লড়াই করেছিলেন, তা জানা গেল। অবশ্য এর আগে ১৯৭১-এর প্রসঙ্গতে আসা যাক, তিনি বাংলদেশ সফরে গিয়ে জানলেন যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনিও অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাই নাকি? খিল্লি শুরু হতে জানা গেল, আসলে তিনি দিল্লিতে এক ধর্ণাতে হিসসা নিয়েছিলেন। তারপর জানা গেল অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে সেই ধর্ণা ছিল আসলে বাংলদেশ যুদ্ধের আগে ভারত–সোভিয়েত রাশিয়া চুক্তির বিরুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ার সাহায্য নিয়েই আমেরিকার হুমকি অগ্রাহ্য করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী এবং শেষমেষ এক আরটিআই-এর জবাবে জানা গেল এমনকি সেই ধর্ণাতেও গ্রেফতারির তালিকায় নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদির নাম নেই। কী বলবেন? মিথ্যেবাদী বলবেন না? ঝুঠুঁ বলুন, গুজরাতি ভাষায় মিথ্যেবাদীকে ঝুঠুঁই বলে। এই পর্বের শেষটা কাল, আজ এই পর্যন্তই।