দেশকে এক মধ্যযুগে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টার কথা শুরু থেকেই বলে এসেছে আরএসএস, তাদের বিভিন্ন শাখা সংগঠন। বিজ্ঞানের নামে, ইতিহাসের নামে মিথ্যের পর মিথ্যে, ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে বলেই চলেছেন। সেই অর্বাচীন মিথ্যে নিয়ে আমরা কতকাল হেসেছি, আমোদিত হয়েছে, শৈশবে সেইসব গল্প পড়ে আমরা পুলকিত হয়েছি, কিন্তু আজ সেইসব শিশুপাঠ্য রুপকথা, মিথগুলোকে আরএসএস-বিজেপি’র দৌলতে বিজ্ঞান করে তোলা হচ্ছে। বেশ মনে আছে, ঠাকুমার কোলে শুয়ে শুনতাম, হনুমান জন্ম নিয়েছে সবে, মা অঞ্জনি দেখছেন তাঁর ছেলেকে, আর ঠিক সেই সময়ে সূর্য উঠছে, ভোরের লাল টুকটুকে সূর্য, ব্যস, হনুমান লাফাল, আপেল ভেবে সূর্যকে জাপটে ধরে বগলের তলায় পুরলো, পৃথিবীতে অন্ধকার, সূর্যদেবেরও দমবন্ধ হয় হয় অবস্থা। তখন সবাই মিলে অনেক বাবা-বাছা করে হনুমানকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলার পরে হনুমান সূর্যদেবকে বগলের তলা থেকে বার করে আবার যে জায়গায় ছিল, সে জায়গায় রেখে দিয়ে বিছানায় ফিরে এল। এই গল্প শুনতে শুনতে গোল্লা করা ভাত-সবজি-মাছ মুখে চলে গিয়েছে। জিজ্ঞেস করেছি… তারপর। শেষ গোল্লাটা মুখে ঠেসে দিয়ে ঠাকুমা বলেছেন, পুরো খাবার খেয়ে নাও, তবে তো হনুমানের মতো শক্তি হবে। তারপর বয়স বেড়েছে, সূর্য, আহ্নিক গতি, উত্তরায়ণ, দক্ষিণায়ন, অ্যাপিথিলিয়ন, পেরিহিলিয়ন পড়েছি, হনুমানের গল্প যে এক বীরগাথা ছিল, তা বুঝেছি। কিন্তু বাঁকুড়ার সাংসদ, হাফ-মন্ত্রী সুভাষ সরকারের বয়স হয়নি, তিনি এখনও শিশুটিই রয়ে গিয়েছেন। তিনি গত শুক্রবার যা বলেছেন, খবরের কাগজে তা প্রকাশিত হয়েছে, তার পুরোটাই তুলে ধরছি, “এই সময় থেকে (মানে মকর সংক্রান্তি থেকে) সূর্য পৃথিবীর কাছে আসবে, তাই আরও সুন্দরভাবে সূর্যকে কাছে পাবো আমরা।“ একেই বলে আবালপনা, সূর্য কাছে আসলে, সূর্যকে আরও সুন্দরভাবে পাওয়া যায়, ভাবা যায়? একজন শিক্ষিত সাংসদ-মন্ত্রী এই কথা বলছেন। সাংবাদ মাধ্যম কোনও প্রশ্ন করছে না। তিনি সর্বসমক্ষে এই অবৈজ্ঞানিক, অসত্য, শিশুসুলভ কথাগুলি বললেন। তারও আগে চলুন দেখা যাক, কোন প্রসঙ্গে এই কথাগুলি বললেন। আমাদের দেশের ইউজিসি, মানে ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশনের সচিব রজনীশ সিং এবং অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল অফ টেকনিক্যাল এডুকেশনের অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর মনোজ সিং নির্দেশ দিয়েছেন দেশজুড়ে উচ্চশিক্ষার পড়ুয়াদের এবার থেকে মকর সংক্রান্তি পালন করতে হবে। কারণ পুরাণবিদ ও সংস্কৃত পণ্ডিতদের মতে, হিন্দু ধর্মশাস্ত্র ও স্মৃতিগ্রন্থ অনুযায়ী মকর সংক্রান্তির স্নানে নাকি মানুষের পুণ্য হয়। সূর্য সংক্রান্তিতে যখন মকর রাশিতে প্রবেশ করে তখন উত্তরায়ণ হয়, আর উত্তরায়ণের এই ছ’মাস সব দেবতারা জেগে ওঠেন। তাই উচ্চশিক্ষা পড়ুয়াদের মকর সংক্রান্তি পালন করতে হবে। হ্যাঁ, তাঁরা এই নির্দেশ দিয়েছেন, এরাজ্যেও তা এসে পৌঁছেছে, কিন্তু একটা শিক্ষা সংস্থা থেকে ছাত্রদের মকর সংক্রান্তি পালনের কোনও খবর পাওয়া যায়নি। এবার আসুন এই নির্দেশিকার বক্তব্য নিয়ে। উত্তরায়ণে, মানে মকর সংক্রান্তির দিন থেকে, এক্ষেত্রে ১৪ জানুয়ারি থেকে ৬ মাস দেবতারা জেগে থাকবেন, তারপর ঘুমিয়ে পড়বেন। কি গেরো বলুন তো? এতদিনে বোঝা গেল, বীরেন্দ্র কৃষ্ণভদ্র জাগো, জাগো, জাগো মা বলতে বলতে কাঁদতেন কেন? কারণ দেবী দুর্গা তো তখন শুয়ে, উঠছেন না। আচ্ছা তাই যদি হয়, তাহলে দেবতারা দুর্গার হাতে অস্ত্র দিলেন কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে? আর দেবী দুর্গা কী ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই অসুরের সঙ্গে লড়াই করলেন? দেবতারা যদি ছ’মাস ঘুমোন, আর ছ’মাস জেগে থাকেন, তাহলে কুম্ভকর্ণ কি দেবতা ছিলেন? দেবতারা যদি ছ’মাস ঘুমিয়েই থাকেন, তাহলে সেই সময়ে এতগুলি পুজো কেন? বিশ্বকর্মা থেকে দুর্গা থেকে কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী এই পুজোগুলি হয় কেন? এসব প্রশ্ন উঠবে না? না, প্রশ্ন করা যাবে না, ইউজিসি আর এআইসিটিই’র নির্দেশে উচ্চশিক্ষার ছাত্রদের মকর সংক্রান্তি পালন করতে হবে। কেমন ভাবে? শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বালতি বালতি জল ঢেলে বিভিন্ন কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পুণ্যস্নান করাবেন? নাকি অধ্যক্ষ আর অধ্যক্ষাদের ওপর সেই দায়িত্ব দেওয়া হবে? তাও জানানো হয়নি। একটা অসম্পূর্ণ নির্দেশিকা, এই অবৈজ্ঞানিক নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন সংস্থায়। আমাদের ট্যাক্সের পয়সায় এই ধ্যাস্টামো চলছে। সেই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যখন শিক্ষক, অধ্যাপকেরা এই নির্দেশিকার বিরোধিতা করছেন, ঠিক তখন আমাদের বাঁকুড়ার সাংসদ, হাফমন্ত্রী সুভাষ সরকারের এই আবালপনা আমরা শুনতে পেলাম। তো আসুন একটু ক্লাস নেওয়া যাক, আপনাদের নয়, চতুর্থ স্তম্ভের দর্শকেরা এসব জানেন, আমরা এই ক্লাস একান্তভাবেই আমাদের এক অশিক্ষিত সাংসদের জন্যই নেবো। কারণ উনি ক্লাস সিক্স, সেভেন, এইটের ক্লাস করলেও এগুলি জানতেন। তো আসুন স্যর হাফমন্ত্রী শুরু কর যাক। প্রথম কথা হল, সূর্য যত কাছে আসবে, ততই তা সুন্দর হবে তেমন নয়, কারণ সূর্যের বাইরের অংশের তাপমাত্রা ৫৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সুভাষবাবু, জল ফোটে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, আর মৃতদেহ পোড়ানো হয় যে চুল্লিতে, তার তাপমাত্রা ৫০০ থেকে ১২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কাজেই আপনার প্রথম পাঠ, সূর্য কাছে এলেই সুন্দর হবে তা নয়, বগলে সূর্য নিয়ে ঘোরার গল্পটা আপাতত ভুলে যান। এরপর চলুন দ্বিতীয় পাঠে। সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী সমেত গ্রহরা ঘোরে ঠিক গোল হয়ে নয়, উপবৃত্তাকারে, ছবিটা দেখুন বুঝতে পারবেন। এর ফলেই বার্ষিক গতি, ঋতু পরিবর্তন। পৃথিবী যত দূরে সরে যাবে, তত ঠান্ডা, কাছে আসলে গরম। কিন্তু এই কাছে আসার আর দূরে যাওয়ার এক সীমা রয়েছে, মকর সংক্রান্তি হল সেই দিনটা, যেদিন সূর্য, জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী যেদিন মকর রাশিতে প্রবেশ করে। এতে কী হয়? কিছুই হয় না। বা বলা ভাল কিছু হয় বলে জানা নেই। তবে এর সঙ্গে উত্তরায়ণের কোনও সম্পর্ক নেই। হ্যাঁ? ও সুভাষ বাবু মন দিয়ে শুনুন, এরপর আবার ভুলে মেরে দেবেন না, পারলে মোদিজিকেও এগুলি বোঝাবেন। যা বলছিলাম। উত্তরায়ণ বা দক্ষিণায়নের সঙ্গে এই মকর সংক্রান্তির কোনও সম্পর্ক নেই। অনেকগুলো ব্যাপার আছে, সূর্য মধ্যে, উপবৃত্তাকার পথে, এলিপটিক্যাল পথে গ্রহগুলো ঘুরছে। আচ্ছা সুভাষ বাবু, এটা জানেন তো যে সূর্য কিন্তু গ্রহ নয়, সূর্য হল নক্ষত্র, আর চাঁদ হল উপগ্রহ এবং রাহু-কেতু এসব হল ছায়া, কোনও অস্তিত্বই নেই এদের। কিন্তু আপনাদের ওই জ্যোতিষ ঢপবাজিতে সবটাই গ্রহ হয়ে গিয়েছে। আবার ফিরে আসুন, পৃথিবী যেমন সূর্যের চার ধারে ঘোরে, তেমনই আবার নিজেও পাক খেতে থাকে, সেটাও আবার একটু হেলে, সোজা হয়ে নয়। এই হেলে থাকার ফলে পৃথিবীর দু’টো মেরু বছরে একবার করে সূর্যের সবচেয়ে কাছে চলে যায়, গরমকালে ২০ বা ২১ জুন উত্তর গোলার্ধ সূর্যের সবচেয়ে কাছে, তাই দিনটা বিরাট, রাতটা ছোট, আর তারপর থেকেই দক্ষিণায়ণ শুরু হয়ে যাবে, দিন ছোট হতে থাকবে, রাত বড় হতে থাকবে, এইবার ২১ বা ২২ ডিসেম্বরে দিন সবথেকে ছোট আর রাত সবচেয়ে বড় হবে, এরপর থেকে আবার দিন বড় হবে, আর রাত ছোট হবে, যাকে উত্তরায়ণ বলে। না ক্রিসমাস বা বড় দিনের সঙ্গে, আর না মকর সংক্রান্তির সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক আছে। এবার আসুন বুঝিয়ে বলি, আপনার ওই সূর্য কাছে আসার ব্যাপারটা, ওই যে কাছে আসলে সুন্দর হয়, সেইটা। সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী ঘোরে কেমন ভাবে? উপবৃত্তাকার পথে, খানিকটা হাঁসের ডিমের মত চেহারা। কাজেই ঘুরতে ঘুরতে একটা সময় পৃথিবী সূর্যের সবচেয়ে কাছে আসে, তাকে বলে পেরিহেলিয়ন, কবে হয়? এবছরে সেটা হয়েছে ৪ জানুয়ারি, রাত ১১ টা ১৭-তে, তখন সূর্য ৯ কোটি ১৪ লক্ষ ৩ হাজার ৩৪ মাইল দূরে ছিল। আর সবচেয়ে দূরে যাবে যখন, সেটাকে বলে অ্যাপহিলিয়ন। এবছরে সেটা হবে, ৬ জুলাই, বিকেল ৪টে ৬ মিনিটে, তখন সূর্য পৃথিবীর চেয়ে ৯ কোটি ৪৫ লক্ষ ৬ হাজার ৩৩৪ মাইল দূরে থাকবে। তাহলে মজাটা দেখুন সুভাষ বাবু, সূর্যের কাছে থাকলেই গরম কাল আর দূরে থাকলেই শীতকাল তা কিন্তু নয়, সেটার রহস্য লুকিয়ে আছে পৃথিবীর ওই হেলে থাকার ওপর। যেদিকটা হেলে থাকে সেই দিকটা দূরে থাকলে শীত, কাছে থাকলে গ্রীষ্মকাল। বোঝা গিয়েছে? আফটার অল আপনি সাংসদ, হাফ হলেও মন্ত্রী, বাড়িতে ছোটরা আছে, এরকম লোক হাসানো কথাবার্তা বলবেন কেন? ভাবুন না, সূর্য যখন সবচেয়ে কাছে এল, তখন আপনার উত্তর গোলার্ধে শীত, চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়, এখন প্রবল গরম। এতখানি পড়াশুনো করে মাথা গরম হল? চান করে নিন, সংক্রান্তির চানটা আজকেই করুন, মাথা ঠান্ডা হবে।