দেখো আলোয় আলো আকাশ, দেখো আকাশ তারায় ভরা, দেখো যাওয়ার পথের পাশে ছোটে হাওয়া পাগলপারা, এত আনন্দ আয়োজন সবই বৃথা আমায় ছাড়া…কেউ হাউ হাউ করে কেঁদেছেন, কেউ চুপচাপ, তাঁর আরও কষ্ট। কষ্ট তো সেদিনই শুরু যেদিন জেনেছি ওই সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটা এক মারণরোগে আক্রান্ত, জেনেছি যে কোনওদিন সেই রোগ আবার দরজায় কড়া নাড়বে, জানতাম অসময়েই নাড়বে। তবু চলে যাবার সময়ে সেই জমে থাকা কান্না ঝরে পড়বে বৈকি। তার কারণ কি মেয়েটা ফুটফুটে সুন্দর ছিল বলে? তার বয়স মাত্র ২৪ বলে? সে ভালো অভিনেত্রী ছিল বলে? এসবের চেয়েও আমাদের মনে আর মাথায় ছিল এক প্রেমের গল্প, এক ভালোবাসার উপাখ্যান, জন্ম হয়েছিল এক রূপকথার, আমাদের সেই ভালবাসাই কাঁদিয়েছে। বাঁচতে চাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা আর তার জন্য লড়াই আমাদের কাঁদিয়েছে। সেই অর্থে কতবড়ই বা অভিনেত্রী ছিল সে? তার কতটুকুই বা আমরা দেখেছি? সুন্দরী তো ছিলই, কিন্তু কেবল সৌন্দর্য দিয়েই এমন বাংলা জোড়া আবেগ তৈরি করা যায় না। এই আবেগ বলে দেয় বেশিরভাগ মানুষ এখনও ভালবাসতে জানে, মনের গোপন কুঠুরিতে থাকে লায়লা মজনু, রাধা কৃষ্ণ, সেই কুঠুরিতেই আরও দু’জনের জায়গা হল। শোকের উদযাপন তো একদিন শেষ হবে, হবেই, তারও বহু পরে এই নাম দু’টো থাকবে, সময়ে অসময়ে, অবরে সবরে হুট করে বেরিয়ে আসবে, দেখে নেবেন, মিলিয়ে নেবেন। আজ কি তাহলে চতুর্থ স্তম্ভ এক প্রেমের অন্তর্তদন্ত? না, তাঁরা যেমন আছে থাক, তাঁদের ভালবাসা নীল দিগন্তে সুরের আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ুক, কোলাহল থেমেছে, তাঁরা কথা বলুক কানে কানে। আমরা বরং প্রেম থেকে অপ্রেমে যাই, এক প্রেমিকের উপাখ্যানের বদলে আজকের বিষয় এক খুনির। সেই খুনি কেবল এক নারীকেই খুন করেছে এমন নয়, সে খুন করেছে ভালোবাসাকে, সে খুন করেছে বিশ্বাসকে, সে খুন করেছে এক স্বপ্নকে, নির্মমভাবে। আজ সেই কথা এবং তার সঙ্গেই আরও কিছু জরুরি কথা। এতদিনে সবাই জেনে গিয়েছেন, ছেলেটির নাম আফতাব আমিন পুনাওয়ালা, মেয়েটির নাম শ্রদ্ধা ওয়াকার। তারা লিভ ইন রিলেশনে ছিল, একসঙ্গে থাকত। তারা সবেমাত্র দিল্লির এক ফ্ল্যাটে এসে উঠেছিল। অভিযোগ আফতাব শ্রদ্ধাকে খুন করে, তারপর তাকে ৩৫/৪০/৫০ টুকরো করে, তারপর ফেলে আসে দিল্লির সীমান্তে এক জঙ্গলে। জানা গিয়েছে খুন হয়েছিল ১৮ মে, আমরা জানলাম দিন পাঁচ আগে, মানে ৬ মাস ধরে এই ঘটনা চাপা ছিল, কেউ জানতো না। শ্রদ্ধা অনাথ ছিল? না, তার বাবা-মা আছেন। শ্রদ্ধা কথা বলতে পারতো না? না, বলতো, অনর্গল কথা বলতো, তার বন্ধুরা জানাচ্ছে, এক অফিসে কাজও করতো। অবাক কাণ্ড, পৃথিবীটা ছোট হতে হতে ড্রয়িং রুমের বোকাবাক্স হয়ে গেছে, আমাদের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, খবর দেয় ওই বোকা বাক্সই। এক বাবা ওই বোকাবাক্স থেকেই জানতে পারেন, তাঁর সন্তান টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে জঙ্গলে, এক মা জানতে পারেন তাঁর আত্মজা খুন হয়েছে, এক বন্ধু ওই বোকা বাক্স থেকেই হঠাৎ জানে তার বান্ধবীকে খুন করেছে তাঁদেরই এক বন্ধু। একে অন্যের থেকে কত আলোকবর্ষ দূরে সরে গিয়েছি আমরা? থাক এ কথা, আরেকদিন আলোচনা করা যাবে। আসুন খুনের কথায়, আচ্ছা এই খুন কীভাবে হয়েছে, কী দিয়ে হয়েছে, কত টুকরো করা হয়েছে? এসব জানলাম কী করে? আফতাব আমিন পুনাওয়ালা এই বয়ান দিয়েছে পুলিশের কাছে। ভাবছেন, তাহলে তো ফুরিয়ে গেল, লোকটাকে ধরে ফাঁসিতে লটকে দিলেই হয়। কিন্তু বিষয়টা অত সহজ নয়। এই আফতাব আমিন পুনাওয়ালা আদালতে হাজির হয়ে যদি বলে, ধর্মাবতার, আমাকে এসব জোর করে বলানো হয়েছিল। ব্যস, ওই বক্তব্য আদালত খারিজ করে দেবে। তাই সভ্যদেশের পুলিশ এই বয়ান গোপন রাখে, বয়ানের ভিত্তিতে প্রমাণ যোগাড় করতে থাকে, প্রমাণ যোগাড়ের পরে তাকে আদালতে তুলে শাস্তির আবেদন করে। আমাদের এখানে পুলিশ প্রথম দিন থেকেই এই সব তথ্য সাংবাদিকদের জানিয়ে দেয়, তারপরেও সাংবাদিকদের মনোহর কঁহানিয়া তৈরি করতে হয়, এক্সক্লুসিভ স্টোরির চাহিদা মেটাতে হয়। আর অভিযুক্তের উকিল সব তথ্য পেয়ে তাঁর মক্কেলকে ছাড়ানোর ঘুঁটি সাজাতে থাকেন, অ্যাডভান্টেজ খুনির, ধর্ষকের। কারণ আদালত কারওর বয়ানের ওপরে নয়, প্রমাণের ভিত্তিতেই সাজা দিতে পারে। ঠিক এখনও পর্যন্ত এই আফতাবের খুনের খবরটা জানা ছাড়া দিল্লি পুলিশ এক পাও এগোতে পারেনি। যে বাড়িতে শ্রদ্ধা ওয়াকার খুন হয়েছে, সেখানে সে থাকতো, কাজেই ফ্রিজ বা টয়লেট বা বিছানায় তার ডিএনএ কিছুই প্রমাণ করবে না, ৬ মাস ধরে ফ্রিজ পরিস্কার করা হয়েছে, টয়লেট পরিস্কার হয়েছে, হত্যার জন্য ব্যবহার করা অস্ত্র, দেহ টুকরো টুকরো করার অস্ত্র, কিছুই পাওয়া যায়নি, জঙ্গল থেকে কিছু হাড় পাওয়া গেছে, তা শ্রদ্ধার, তা এখনও জানা যায়নি, জানা গেলেও তাকে আফতাব খুন করেছে, তা প্রমাণ করার মতো কোনও তথ্যই এখনও হাতে আসেনি। মানে খুব সোজা, দৃশ্যম ছবি, খুন করেছে কে সবাই জানে, কিন্তু খুনের প্রমাণ কই? সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা পুলিশের, রোজ রোজ নয়া নয়া গল্প সাংবাদিকদের হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া তারা এখনও পর্যন্ত কিছুই করে উঠতে পারেনি। তাহলে প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যাবে? হ্যাঁ সেরকমটা হতেই পারে। আমাদের কাছে সাম্প্রতিক উদাহরণ আছে। ২০১২, ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯ বছরের কিরণ নেগি দিল্লির দ্বারকা এলাকার কুতুব বিহার, তাঁর ফ্ল্যাটে ফিরছিল, রাস্তায় তিনজন তাঁকে লাল রঙয়ের টাটা ইন্ডিকাতে তুলে নেয়, একজন বাধা দিতে গিয়েছিল, বিকাশ রাওত, তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে গাড়ি চলে যায়। তিন দিন পরে দিল্লি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে রেওয়াড়ির রোধাই গ্রামে কিরণের মৃতদেহ পাওয়া যায়, গণধর্ষণের পরে তাকে খুন করা হয়েছে। রাহুল ২৬, রবি আর বিনোদ ২২ বছরের, এই তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, তিনজনের বয়ানেই জানা যায়, তারা ধর্ষণ করে কিরণকে ওখানেই খুন করে চলে আসে। তাদের গাড়িতে পড়ে থাকা বীর্য, চুল ইত্যাদির ডিএনএ টেস্ট করা হয়, মাঠে পড়ে থাকা লাশের গায়ে চুলের ডিএনএ টেস্ট হয়, সেখানে ওই গাড়ির একটা ভাঙা বাম্পারের টুকরো, মানিব্যাগ ইত্যাদি পাওয়া যায়, অভিযুক্তদের দেখানো জায়গা থেকে মেয়েটির মোবাইল, তাঁর জামা কাপড়ের টুকরো পাওয়া যায়। কাগজে এসব ফলাও করে ছাপা হয়। ৪০ পাতার চার্জশিট তৈরি হয়। নিম্ন আদালত তাদের ফাঁসির আদেশ দেয়। অভিযুক্তরা হাইকোর্টে যায়। একই আদেশ দেওয়া হয়। অভিযুক্তরা সুপ্রিম কোর্টে যায়, সুপ্রিম কোর্টের গত ৭ নভেম্বরের রায়ে বলা হয়েছে, প্রমাণের অভাবে তিনজন অপরাধীকেই অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হল। অভিযুক্তরা ঘরে ফিয়েছে। নো ওয়ান রেপড, নো ওয়ান কিলড কিরণ নেগি। কতটা অবিবেচক এই পুলিশ, কতটা অপদার্থ তারা, তা এই রায় থেকে জানা যাচ্ছে। কী জানাচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট? ১) অপরাধীদের সনাক্তকরণ হয়নি, একজন সাক্ষীও অপরাধীদের সনাক্ত করেনি। সনাক্তকরণের আগেই অপরাধীদের ছবি ছাপা হয়েছে বিভিন্ন খবরের কাগজে, সংবাদ মাধ্যমে তাদেরকে অপরাধী হিসেবেই দেখানো হয়েছে। ২) একজন সাক্ষীও অপরাধে ব্যবহৃত লাল রঙয়ের ইন্ডিকা গাড়িটাকে সনাক্ত করেনি, পুলিশ সেই সনাক্তকরণের কাজই করেনি। ৩) যে কন্সটেবলের দল ওই তিনজনকে গ্রেপ্তার করে, প্রসিকিউশন তাদের আদালতে জেরা করেনি, কাজেই আসামী পক্ষের উকিলও সেই সুযোগ পায়নি, তাদেরকে কোথা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তা নিয়েও মতপার্থক্য আছে। ৪) মৃতদেহ ঠিক কোথা থেকে পাওয়া গেছে, কে প্রথম সেই মৃতদেহ উদ্ধার করতে যায়, তা নিয়ে সরকারি বয়ানে মতপার্থক্য আছে, থানার ডায়রিকে সাক্ষ্য-প্রমাণের মধ্যে রাখাই হয়নি। ৫) অভিযুক্তদের বয়ান সামনে রাখা হয়েছে, কিন্তু ওই বয়ানকে আদালত প্রমাণ হিসেবে গণ্য করে না। ৬) ঘটনাস্থল থেকে রাহুলের মানিব্যাগ পাওয়া গিয়েছে বলে জানানো হচ্ছে, কিন্তু সেই মানিব্যাগ সিজার লিস্টে নেই। ৭) মৃতদেহের ওপর পড়ে থাকা চুলকে প্রমাণ হিসেবে রাখা হয়েছে, কিন্তু মৃতদেহ তিন দিন পরে সর্ষে ক্ষেতে পাওয়া গিয়েছে, খোলা জায়গায় এতদিন ধরে এই চুল পড়ে থাকবে কেন? এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট সন্দেহ প্রকাশ করেছে। ৮) পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট বলছে, মেয়েটির মৃত্যু ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হয়েছে, পুলিশ বলছে ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হয়েছে। এই গরমিল কেন? ৯) গাড়ি সিজার করা আর ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোর মধ্যে বেশ কিছু গরমিল রয়েছে, যার ফলে গাড়ির মধ্যে যে ডিএনএ পাওয়া গিয়েছে, তার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে। এইসব দেখে অভিযুক্তরা অপরাধী হতেই পারে জেনেও, সুপ্রিম কোর্ট তাদের মুক্তির আদেশ দেয়। রায়ে পরিস্কার নো ওয়ান রেপড অর কিলড কিরণ নেগি। অন্তত আমরা সেরকম কাউকে জানি না। জানি না আফতাব আমিন পুনাওয়ালা সেই একই আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসবে কিনা, কিন্তু এটা জানি যে এই অপ্রেমের গল্প, এই খুনের গল্প বহু ভালোবাসার ভিত নড়িয়ে দেবে।