আরএসএস আর বিজেপি’র মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক কী? আরএসএস হল এক সামাজিক সংগঠন, যা সমাজ, দেশ কোন পথে চলবে, সে সমাজের ধর্ম, অধর্ম-এর ডেফিনেশন, সংজ্ঞা কী হবে? দেশের প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্যকে মানুষের সামনে হাজির করা, এক রামরাজ্যের দিকে রাষ্ট্রকে দিকনির্দেশ করা, এগুলোর দায়িত্ব নেবে। আর বিজেপি হল এক রাজনৈতিক সংগঠন, যা আরএসএস-এর দর্শন অনুযায়ী দেশ চালনা করবে। শুরুতে এই কাজ জনসঙ্ঘের ছিল, জনতা দল অবলুপ্ত হওয়ার পর বিজেপি তৈরি হয় এই কারণেই এবং এই দিক থেকে অটল-আদবানির সরকার বা মোদি-শাহের সরকারের কোনও তফাৎ নেই। মোদি-শাহের জমানায় যেটা নতুন সেটা হল, আরএসএস-কে সাফ বুঝিয়ে দেওয়া যে ওই দিকনির্দেশ পর্যন্ত ঠিক আছে, তারপর সরকার কী করবে, সরকারের কী করা উচিত, তা নিয়ে আপনাদের মাথা না ঘামালেও চলবে। বাকি ঘুরুন-ফিরুন, সরকারি ব্যবস্থা, সিকিউরিটি ইত্যাদি থাকবে, মিডিয়াতে প্রচার ইত্যাদি হয়ে যাবে, শাখা চালান, ভোটের সময় হুইস্পারিং ক্যাম্পেন চালান, দাঙ্গা লাগলে প্রচারকদের দিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিন, অ্যাকাডেমিক চত্ত্বরে যা যা দরকার, কী কী বাদ দিতে হবে, কী কী জুড়তে হবে, হিপোক্রেটাস ওথ বাদ দিয়ে চরম প্রতিজ্ঞা চালু করার পরামর্শ দিন, এসব করুন, কিন্তু ইয়েদুরিয়াপ্পার ঘাড়ে দুর্নীতির অভিযোগ আছে বলে তাঁকে বিজেপি’র সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণ কমিটিতে নেওয়া যাবে না, কৃষি বিল বা শ্রম বিল দেশের পক্ষে ক্ষতিকর এসব বলা থেকে বিরত হন। ক্লিয়ার অ্যান্ড লাউড মেসেজ। আরএসএস প্রধান থেকে সংগঠনের প্রত্যেকে বুঝে ফেলেছেন এই সত্য, অতএব বাঁশ কেন ঝাড়ে বলে মাঠে নেমে পড়তে দেখা যায়নি কোনও আরএসএস কর্মকর্তাকে। যদিও তাঁদের অনেকেই বুঝেছিলেন, ডিমনিটাইজেশন এক অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে, বুঝেছিলেন কৃষি বিল ফেরত না নিয়ে উপায় নেই, বুঝেছেন শ্রম বিল নিয়ে বিস্তর গোলযোগ আছে, তাঁরাও খোঁজ খবর রাখেন কিভাবে দেশের সম্পত্তি তুলে দেওয়া হচ্ছে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যবসায়ীর হাতে, কিন্তু তাঁরা চুপ, কারণ নয়া ব্যবস্থায় তাঁদের কাজ শুধু বিষ ছড়ানোর, আর কোনও কাজ তাঁদের নেই। তবুও মাঝে মধ্যে ছিপি খোলা ফটাস জলের মত আওয়াজ করে বসেন সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। তিনি বলেন আরএসএস-এর কথাই, কিন্তু ফলিত রাজনীতি, অ্যাপ্ল্যায়েড পলিটিক্স, মাঠের রাজনীতিতে তা বিতর্ক তৈরি করে, বিজেপির অস্বস্তি বাড়ে, কারণ তাঁরা তো সেসব দর্শন মেনে চলছেন না, চলার কথাও নয়, গরু মা, গোমাতা পূজন ইত্যাদি ঠিকই আছে, কিন্তু গোয়া, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম এমনকি কেরালাতেও তো সেসব বলা যাবে না, ভোট বড় বালাই, আরএসএস নেতাদের তো ফি বছর ভোটে দাঁড়াতে হয় না। আর উত্তর প্রদেশে গো হত্যার অভিযোগে পিটিয়ে মারতে তো হবে, যেসব রাজ্যে হিন্দু পোলারাইজেশন চাই, সেখানে তো সুবচন শোনালে হবে না, দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, আরএসএস-এর সবে হাফ প্যান্ট থেকে ফুল প্যান্টে প্রোমটেড কর্তা-ব্যক্তিরা এসব জটিলতা বুঝবেনই বা কী করে? অতএব আরএসএস-এর কাছে বলা হয়েছে কেবল বিষ ছড়ানোর কাজটা আপনারা করুন, কোথায় কোন বিষ, কতটা বিষ, কেমন করে, কখন ছড়াতে হবে, সেটা আমরা ঠিক করে দেব। এইটাই হল অটল-আদবানি যুগের থেকে মোদি-শাহ জমানার আরএসএস-এর তফাৎ। কিন্তু ওই যে ফটাস জলের আওয়াজ। কদিন আগেই সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত বললেন, “Concepts of ‘Varna’ & ‘Jaati’ (caste) should be forgotten… today if someone asks about it, everyone thinking in the interest of society should tell that ‘Varna’ & ‘Jaati’ (caste) system is a thing of the past & should be forgotten” বললেন, বর্ণ, জাত, প্রথা ভুলে যাওয়া উচিত, এসব অতীতের বিষয় ভুলে যাওয়াই ভালো। ব্যাখ্যা দিয়েছেন এসবের প্রয়োজনীয়তা আজ আর নেই। মানে এককালে ছিল, আজ আর নেই। এই সূত্রায়ণ নতুন কিছু নয়, সাভারকার এই কথা বারবার বলেছেন, কেন? কারণ হল তুর্ক, আফগান, মধ্য এশিয়া থেকে আসা মুসলমান আক্রমণের সামনে কিছু ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়ের প্রতিরোধ সম্ভব ছিল না, সমাজের ৮০% মানুষকে অচ্ছুৎ করে রাখা হিন্দুসমাজ, বলা যাক উচ্চবর্ণের মানুষ হার মেনেছিলেন খুব সহজে। কাজেই অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী, কষ্টসহিষ্ণু নিম্নবর্ণের মানুষজনদের পেতে হবে সঙ্গে, তাদেরকেও হিন্দু ব্র্যাকেটের মধ্যে পেতে হবে, সাভারকরের ভারতবর্ষের চেহারাও ছিল সেই রকমই, গান্ধী মুসলমান, হিন্দুউচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণ আর হরজিনদের নিয়েই ভারতের কল্পনা করেছেন, সাভারকারের ভারত মুসলমানবিরোধী, কাজেই তাঁরও দরকার ছিল এক ঐক্যবদ্ধ হিন্দুসমাজের, যেখানে চিৎপাবন ব্রাহ্মণের একটা অংশের প্রত্যক্ষ ষড়যন্ত্রে গান্ধীকে মারা যায়, ভারতবর্ষের দখলদারি পাওয়া যায় না। মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর জন্যই হিন্দু উচ্চবর্ণের, নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ওপর দীর্ঘ অত্যাচারকে ভুলে যাওয়ার দাওয়াই সাভারকারও দিয়েছিলেন, মোহন ভাগবতও দিলেন। অত্যাচারের ইতিহাসকে ভুলে যাও, এসো মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক হও, এটাই তাঁদের ভাষণের সার সত্য। কিন্তু অ্যাপ্ল্যায়েড পলিটিক্স, জমিনি হকিকত, বাস্তবের রাজনীতিতে কী ঘটছে তার একটা উদাহরণই যথেষ্ট। ১৫ আগস্ট দেশের প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি, ট্রিম করা দাড়ি, আগে না দেখা, নতুন কুর্তা-জ্যাকেট পরে, স্বাধীনতা দিবসে, বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও এর বাওয়াল দিচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে গুজরাটের সাব জেল থেকে একে একে বের হচ্ছিল ১১ জন পশু, এক্কেবারে মানুষের মতো দেখতে, এদের নাম যশবন্তভাই নাই, গোবিন্দভাই নাই, রাধেশ্যাম শাহ ওরফে লালা উকিল, বিপিন চন্দ্র জোশি, কেসরভাই বোহানিয়া, প্রদীপ বোহানিয়া, বাকাভাই বোহানিয়া, রাজুভাই সোনি, নিতেশ ভাট, রমেশ চান্দানা আর একদা হেড কনস্টেবল সোমাভাই গোরি। এরা জেল থেকে বের হওয়ার পরে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো, ক্যামেরার সামনে তাদের মালা পরানো হল, মিষ্টি খাওয়ানো হল। ওই সময়েই গণধর্ষণে অভিযুক্ত নয়, না, মাথায় রাখুন অভিযুক্ত নয়, আদালতে দোষি প্রমাণিত, যাদেরকে যাবজ্জীবন জেলে পাঠিয়েছিলেন বিচারপতি, বলেছিলেন হিনিয়াস ক্রাইম, বলেছিলেন অপরাধীরা মানবতার কলঙ্ক, সেই কলঙ্কিত জন্তুগুলোকে স্বাধীন করে ছেড়ে দেওয়া হল জেল থেকে, যাকে সরকারি ভাষায় বলা হয়, এদের সরকারি মাফি দেওয়া হয়েছে, এদের সরকারের তরফে ক্ষমা করা হয়েছে।
কী করেছিল এই জন্তুর দল? ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০০২, গোধরায় ট্রেনের কামরায় আগুন লাগানো হল, ৫৯ জন করসেবক আগুনে পুড়ে হয় ঘটনাস্থলে, না হলে হাসপাতালে মারা গেলেন। তাঁদের দেহ পরদিন সকালে হাসপাতালের সামনে রাখা হল, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে। ভয় পেলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের কিছু পরিবার, পাঁচমাসের গর্ভবতী বিলকিস বানো তার সাড়ে তিন বছরের মেয়ে আর পরিবারের অন্য ১৫ জন সদস্য তাদের গ্রাম, রাধিকাপুর, গোধরা ছেড়ে পালালেন পাশের জেলা ছাপরভাদে। ৩ মার্চ, মাথায় রাখুন গোধরায় ট্রেনে আগুন লাগানোর পরে গোধরা সমেত সারা গুজরাটে দাঙ্গা শুরু হয়েছে, যা মোদিজির ভাষায় রিঅ্যাকশন, ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া। সেই ২৭ ফেব্রুয়ারির চার দিনের মাথায় ২৫/৩০ জন মানুষ, তাদের হাতে অস্ত্র, তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো এই আশ্রয়হীন অসহায় পরিবারের ওপরে। মহিলাদের ধর্ষণ করলো, তারমধ্যে ছিল পাঁচমাসের গর্ভবতী বিলকিস বানো, তার মা এবং আরও তিনজন মহিলা। এখানেই শেষ? না, কেবল ধর্ষণ নয়, ওই ধর্ষণের পরে তাদের পরিবারের বিলকিস, তিন বছরের এক শিশু, একজন পুরুষ বেঁচে ছিল, ৮ জনের মৃতদেহ ওখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল, ৬ জনকে খুঁজেই পাওয়া গেল না। এদের বিচার হয়, শাস্তি হয়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এরা শাস্তি রদের আবেদন জানায়, একটা কমিটি বসে এদের শাস্তি রদ করে, এরা জেল থেকে ছাড়া পায়। সেই কমিটি মাথায় কে ছিলেন? গোধরা থেকে ৬ বার নির্বাচিত বিধায়ক, তিনবার মন্ত্রী হয়েছেন, সি কে রাউলজি, চন্দ্রসিন রাউলজি। ওস্তাদ মানুষ, জনতা দলের হয়ে গোধরা আসন থেকে দাঁড়ান, জেতেন। পরে বিজেপি’তে চলে যান, বিজেপি’র হয়েও জেতেন, শঙ্কর সিং বাঘেলার মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হন, তারপরে বাঘেলার সঙ্গে দল ছাড়েন, কংগ্রেসের হয়ে গোধরা আসন থেকে দাঁড়ান এবং জেতেন, তারপরে বিজেপি’তে আসেন, জেতেন। এবারে ওই জেল থেকে কারা ছাড়া পাবে সেই কমিটির মাথায় ছিলেন এই দলবদলু ওস্তাদ মানুষটি। ধর্ষণের অভিযোগে শাস্তিপ্রাপ্ত, প্রমাণের অভাবে ফাঁসিকাঠে না চড়া ওই জানোয়ারগুলো কেন ছাড়া পেল? সি কে রাউলজি জানিয়েছেন, ওঁরা হলেন সংস্কারী ব্রাহ্মণ, হ্যাঁ বলেছেন, ওই অপরাধীরা যেহেতু সংস্কারী ব্রাহ্মণ তাই তাঁদের শাস্তি মাফ করা হয়েছে। এটাই অ্যাপ্ল্যায়েড পলিটিক্স, মোহন ভাগবত বসে জ্ঞানের কথা বলবেন, আর মাটিতে ঠিক উল্টোটা হতেই থাকবে, উনি বলেছিলেন গোমাতার নাম করে মানুষ মারা অন্যায়, বাস্তবে আগুনে পুড়িয়ে, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মানুষ মারা হয়েছে। উনি বলবেন, জাতি প্রথা অতীত, উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা হবে, উনি বলবেন জাতিপ্রথা তুলে দেওয়া হোক, মাটির রাজনীতিতে একজন মানুষ গণধর্ষণে অভিযুক্তদের কারাবাসে ছাড় দেবে, কারণ তারা সংস্কারী ব্রাহ্মণ। এবং আরও মজার কথা হল, এবার তেনার এই মহান বচনকে মাথায় রেখেই আবার সি কে রাউলজিকে গোধরার টিকিট দেওয়া হয়েছে। অতদুরের খবর সরসঙ্ঘচালক নিশ্চই পাননি, পেলেও চুপ করে থাকা ছাড়া তাঁর অন্য কোনও উপায়ও নেই।