অমিতাভ বচ্চন, সাবেক টুইটার, তাঁর এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘‘জাপানকে হারিয়ে আমরা বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হতে পেরেছি। আগামী ৩ বছরের মধ্যে আমরা হয়তো বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করব। আমাদের দেশের জন্য একটা আসাধারণ কৃতিত্ব এটা, মাত্র ৭৫ বছর আগে যে দেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। জানি না আর কোন রাষ্ট্র মাত্র ৭৫ বছরের স্বাধীনতায় এই সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে।’’ মানে তিনি দেশের অর্থনীতি নিয়েও ভাবছেন, আর ভাববেন নাই বা কেন? তিনিই তো কোটিপতি তৈরি করেন, কৌন বনেগা ক্রোড়পতি, প্রশ্নের উত্তর দিলেই স্লাম ডগস মিলিওনেয়ার। অবুঝমাড়ে লাশ জ্বলছে, লাশ পুড়ছে। বেয়াদপ মাওবাদীদের যারা অমিতাভ বচ্ছন এবং আরও অনেকের শান্তির ঘুম কেড়ে নিয়ে বারুদের গন্ধ ছড়াতে চায় দেশ জুড়ে, তাদের লাশ পুড়ছে, আপনি নিরামিশাষী হলে পোড়া মাংসের গন্ধ ভেবেই তাকে উপেক্ষা করতে পারেন, আর আমিশাষী হলে শেষবারের বারবিকিউ চিকেনের কথাও মনে আনতেই পারেন, আফটার অল বায়োলজি বলছে এক্কেবারে এক না হলেও লাল রক্ত বইছে যাদের গায়ে তাদের মাংসের মধ্যে সিমিলারিটি আছে বইকী। মাথার ঘিলুতে তফাৎ? হতেই পারে। অবশ্য সে তো মানুষে মানুষেও ওই ঘিলুর তফাৎ কি কম নাকি? ভাবুন তো হদ্দমুদ্দ বোকাগুলো রাষ্ট্রের মিলিটারি ক্ষমতার কথা জানতই না, জানতই না যে বিশ্বের অন্যতম বড় প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর কাছে কটা ছিনিয়ে নেওয়া একে ফর্টি সেভেন দিয়ে মোকাবিলা করে উন্মাদেরা, অতএব মরেছে এবং দেশ তার ঠিক পরেই জানতে পেরেছে জাপানকে ছাড়িয়ে ভারত আমার ভারতবর্ষ এখন বিশ্বের চার নম্বর ইকোনমি।
এটা বুঝে সেই অর্থনীতির খানিকটা চেটেপুটে খাওয়ার জন্য কীই বা এমন করতে হত? বেশি কিছুই নয়, বস্তাপচা সাম্য ইত্যাদি ভাটের আদর্শ তাকে তুলে জয় শ্রীরাম বললেই মাসের শেষে নিশ্চিন্ত প্যাকেজ, নিশ্চিন্ত জীবন পেয়ে যেত, যেমন অনেকেই পায়, আমিও পাই। কোন আহাম্মক তাদের বোঝাল যে দেশের জন্য প্রাণ দিতে হবে, যদি ধরেই নিই যে তারা আদৌ দেশের কাজেই নেমেছিল, তাহলেও প্রাণ দেওয়ার মতো জায়গাতে যাওয়ার কোন দরকারটা ছিল, এখন লাশ বাড়ির লোকেরাও পাবে না, দেশ চার নম্বর অর্থনীতি আর বাস্তারে উগ্রপন্থীদের লাশ জ্বলছে, এরচেয়ে আনন্দের আর কীই বা হতে পারে। অমিতাভ বচ্চন জানেন, দেশের হুদো হুদো সাংবাদিকেরা জানে, দেশের নীতি আয়োগের কর্তারা জানেন, সবচেয়ে বড় কথা হল মোদিজি, হ্যাঁ, নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদিজি বলেছে দেশ ৫ ট্রিলিয়ন ইকনমি হয়ে উঠবে, ব্যস থোড়াসা সবুর করো, একটু ধৈর্য ধরুন। কিন্তু তাদের জলপাই পোশাক বেশি ভালো লেগেছিল, সেখানেও মোদিজি দেখিয়ে দিয়েছেন, পুরোদস্তুর আর্মির পোশাক তো যুদ্ধ না করেও পরাই যায়, সেরকম পরতে পারতেন তাঁরাও যাঁরা পুড়ছেন, কত অভিনেতারা নকশাল নেতা সাজেন, নকশাল সাজেন, সেরকম গো অ্যাজ ইউ লাইকের একজন পার্টিসিপ্যান্ট হলেই তো হত, তা নয় যে দেশের ডিফেন্স বাজেটে আপাতত ৬.৮১ ট্রিলিয়ন, মানে বোঝেন, মিলিয়ন, বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন, ৬ লক্ষ ৮১ হাজার কোটি টাকা, তার সঙ্গে পাঙ্গা নিতে নেমেছে ক’টা আহাম্মক, তারা খতম, সেনারা আনন্দে নাচছেন, সেনাদের বীরত্বে আমরাও নাচছি, অমিত শাহ বলেই দিয়েছেন ২০২৬ নকশালবাদ শেষ, এন্ড অফ দ্য গেম। তাতে কান না দিয়েই বোকার দল পরবর্তী সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করে দিয়েছে, সেটাও মরবে, পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ইউনুস সাহেবের পদত্যাগ, ইচ্ছের পিছনের রাজনীতিটা কী?
জানাই নেই যে ডিফেন্স বাজেট ২.৫৩ ট্রিলিয়ন ছিল ২০১৩ –১৪তে, মোদিজির জমানাতে সেটাই এখন ৪ ট্রিলিয়ন বেড়েছে। ভাবা যায়। স্বাস্থ্যেও বেড়েছে, ২০১৪-১৫তে ব্যয় বরাদ্দ ছিল ৪ লক্ষ ৮৩ হাজার কোটি টাকা আর ২০২৪-২৫-এ সেটা বেড়ে ৬.১ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে জানাচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা। মানে স্বাস্থ্যের বাজেট বেড়েছে ২ লক্ষ কোটি টাকা আর ডিফেন্স বাজেট বেড়েছে ৪ লক্ষ কোটি টাকা। দেশ বাঁচলে তবে তো স্বাস্থ্য। আর এই ডিফেন্স বাজেট বেড়েছে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বন্দুক হাতে লড়ছিল, তাদের খতম করা হয়েছে, তাদের লাশ পুড়ছে চিতায়, কোনটা কার লাশ? কোনটা বাসবরাজু? সেটার থেকে কি একটু বেশি পচার গন্ধ আসছিল? জানি না। কারণ এসব সাংঘাতিক বিদ্রোহীদের লাশ পোড়ানোর সময় কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। তো যাই হোক, অমিতাভ বচ্চন জানিয়েছেন, আমাদের চায়ওলা কাম চৌকিদার জানিয়েছেন আমরা এখন চার নম্বর ইকনমি। জাপানকে টপকে গিয়েছি আমরা। মানে আমরা এখন বিশ্বে ৪ নম্বরে। বেশ তো, কিন্তু সেটা তো দেশের সম্পদ। মাথাপিছু সম্পদে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? প্রথম ১০টা দেশের হিসেবটাই দেখা যাক। মাথাপিছু সম্পদের হিসেবে আমেরিকা ১ নম্বরে, ৮৯১১০ ডলার, জার্মানি ৫৫৯১০ ডলার, ইউকে ৫৪৯৫০ ডলার, কানাডা ৫৩৫৬০ ডলার, ফ্রান্স ৪৬,৩৯০ ডলার, ইতালি ৪১,০৯০ ডলার, জাপান ৩৩,৯৬০ ডলার, চীন ১৩,৬৯০ ডলার, ব্রাজিল ৯,৯৬০ ডলার, ভারত ২,৮৮০ ডলার। মানে প্রথম ১০টা দেশের সবথেকে কম মাথাপিছু সম্পদ ভারতে। কিন্তু গল্পটা এখানেও শেষ নয়, ১৯৫টা দেশের মধ্যে ভারতের মাথা পিছু সম্পদ ১৪১ নম্বরে। সে আপনি খরচই বলুন, স্বাস্থ্যই বলুন, শিক্ষাখাতেই বলুন সবচেয়ে করুণ অবস্থা কিন্তু ভারতের, হ্যাঁ এটা ঠিকই যে এই করুণ অবস্থার মধ্যেও আমাদের দেশের অন্তত চার জন ব্যবসায়ী মুকেশ আম্বানি, গৌতম আদানি, শিব নাদার আর সাবিত্রী জিন্দল বিশ্বে ৫০ জন বিত্তবানের তালিকাতেই আছেন, এই খবরে নেত্য হয়ে যাক, যারা নেত্য করলো না তারা তো পুড়ছে।
১২৭টা দেশের মধ্যে ক্ষুধা, সাদা বাংলায় যাদের খিদে পায় এমন মানুষের তালিকাতে ভারত ১১০ নম্বরে। এত খিদে পায় কেন কে জানে? এটাও তো খবর যে ওয়ার্ল্ড ওবেসিটি ফেডারেশন (World Obesity Federation) জানিয়েছে যে বিশ্বে স্থূল ব্যক্তি সংখ্যার দিক থেকে ভারত রয়েছে তিন নম্বরে। আর তাই দেশে ইন্টারমিটান্ট ফাস্টিং, ডায়েটিং কত কিছু চলছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, যোগা করুন, যোগ ব্যায়ামে রোগ সারে, আর যোগ ব্যায়ামের মাস্টারমশাই বলছেন যোগ ব্যায়াম করার আগে মানে ঘন্টা দু আগে খেয়ে নেবেন, খালি পেটে যোগ ব্যায়াম নাকি ভালো নয়, আর ওখানেই সমস্যা, কন্দমূল আর শাকপাতা দিয়ে কতটাই বা পেট ভরানো যায়, সে প্রশ্ন কে করবে? যারা বোকার মতো হাতে বন্দুক নিয়ে সেই প্রশ্ন করতে গেল তারা পুড়ছে। চলুন উন্নয়নের কথা বলি, আদিবাসীরা ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮.৬ শতাংশ ,২০১১ আদমসুমারি অনুযায়ী, অথচ উন্নয়নের নামে যত মানুষ উচ্ছেদ হয়েছে, তার ৪০-৫০ শতাংশের বেশি আদিবাসী। মানে, দেশজোড়া উন্নয়ন তো হবে, কিন্তু উন্নয়নের কোল্যাটেরাল ড্যামেজের দায় কিন্তু আদিবাসীদেরই, যাদের উচ্ছেদ করা হল। উচ্ছেদের পরিমাণ: ১৯৫০ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত প্রায় ১.৮৫ কোটি মানুষ উচ্ছেদ হয়েছে। সাম্প্রতিক হিসাব বলছে, গত ৫০ বছরে প্রায় ৫ কোটি মানুষ এভাবে উচ্ছেদ হয়েছে—এবং এদের ৫০ শতাংশ অংশ আদিবাসী। তার কারণ কী? এই আদিবাসীদের জমিই দেশের সবচেয়ে ধনী জমি, কয়লা, বক্সাইট, লোহা, ইউরেনিয়াম— সবই আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে আছে। ভারতের সবচেয়ে ঘন বন, যেটা জল, খাদ্য, ওষুধ, জীবিকা দেয়, সেগুলো আদিবাসীদের অঞ্চলেই বেশি। উত্তর-পূর্ব ভারত, ছত্তিসগড়, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ইত্যাদি। বড় নদীর উৎস এই পাহাড়ি, বনভূমি অঞ্চলেই। ফলে, এখানেই বড় বড় বাঁধ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ইত্যাদি বানানো হয়।
ওই যে হঠকারী লোকগুলো পুড়ছে, তারা এই ইস্যুগুলোকে তুলে ওই আদিবাসীদের ভোটে এমএলএ হতে পারত, বিধানসভাতে তাদের কথা বলতে পারত, তারা ওই ইস্যুগুলোকে সামনে রেখে এমপি হতে পারত, সময় বুঝে শাসকদলকে সমর্থন করে উন্নয়নে গতি আনতে পারত। তাকিয়ে দেখুন না আদিবাসী নেতা, ছাগল চরানো শিবু সোরেনের ছেলে হেমন্ত সোরেন আদিবাসীদের দাবি নিয়ে বিরাট লড়াই করে মাত্র গত বছরেই নির্বাচনের আগে জানিয়েছেন তাঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ মাত্র ২৫ কোটি টাকা। মানে উন্নয়নের কাজ করা যায়, আদিবাসীদের ইস্যু নিয়ে লড়াও যায় আবার ২৫ কোটি টাকার সম্পদও তৈরি করা যায়, তা না করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, এখন কার লাশ কোনটা সেটাও জানা যাচ্ছে না, লাশ পুড়ছে, পোড়া মাংসের গন্ধ আসছে। আর এসবের মধ্যে অমিতাভ বচ্ছন জানিয়ে দিয়েছেন, মোদিজির নেতৃত্বে আমরা বিশ্বের চার নম্বর অর্থনীতি, শুনলাম মোদিজি আসবেন, চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির সেলিব্রেশন হবে, বাচ্চা ছেলেরা সেদিন জিলিপি পাবে, হাতে পতাকা নিয়ে রাস্তার ধারে পতাকা নাড়বে, কিন্তু মাথায় একটা চিন্তা ঘুরছে, ওই বাচ্চাগুলোর মধ্যে একজনও যদি চিৎকার করে বলে ওঠে অ্যাই রাজা তুই ন্যাংটো, তাহলে, তাহলে কী হবে? কিছু একটা পুড়ছে, হ্যামলেট, অ্যাক্ট ওয়ান, সিন ফোর, মার্সিলাস বলছে, ‘সামথিং ইজ রটন ইন দ্য স্টেট অফ ডেনমার্ক।’ সেই কথাই আবার মনে পড়ে গেল, কিছু একটা পুড়ছে, গন্ধ পাচ্ছেন? পোড়া মাংসের গন্ধ?