বাবার হইল আবার জ্বর সারিল ঔষধে, আমরা ছোটবেলায় মুখস্থ করতাম, মনে থাকত বাবরের পরে হুমায়ুন, আকবরের পরে জাহাঙ্গির, শাহজাহানের পরে আওরঙ্গজেব। আর এসব মুখস্থ করতে হবে না, বিজেপি সরকার পুরো মুঘল যুগটাকেই উড়িয়ে দিয়েছেন হিস্ট্রি সিলেবাস থেকে। আজ থেকে ৫০ বছর পরে আগ্রাতে তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে এক গাইড বিদেশি ট্যুরিস্টকে বলতেই পারেন যে এটা ছিল বৈদিক সভ্যতার সময়ে ফসলের গোদাম। বলতেই পারেন যে তারও আগে এটা ছিল রাম রাজত্বে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, চারদিকের চারটে মিনার দিয়ে শহরের প্রত্যেক কোণে নিয়ে যাওয়া হত বিদ্যুৎ আর সামনের রাস্তায় নামতো পুষ্পক বিমান ব্লা ব্লা ব্লা। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করেন গণেশের মাথা কেটে হাতির মাথা জুড়ে দেওয়াটা দুনিয়ার প্রথম প্লাস্টিক সার্জারি, সেই দেশে তাজমহল বৈদিক যুগের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হতেই পারে। আসলে দেশকে সমাজকে এক মধ্যযুগীয় অন্ধকারে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে এই বিজেপি সরকার। দেশের পরিচয়, আইডেন্টিটি তৈরির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে শিক্ষা ব্যবস্থা এবং তথ্য প্রচারের মাধ্যমে, ভারতীয় জনতা পার্টি, তার আদর্শগত অভিভাবক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। এটাকেই আমরা ‘গেরুয়াকরণ’ বলছি।
ভারতের জাতীয় পরিচয় হয়ে উঠছে এক হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে, নতুন পরিচয় তৈরি হচ্ছে, হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরার জন্যই ঐতিহাসিক কাহিনিগুলোকে বদলানো হচ্ছে, সিলেবাস ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান বই থেকে সোশ্যাল মিডিয়া হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টুইটার, বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এই নতুন পরিচয়কে তুলে ধরা হচ্ছে আর অন্যধারে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠদের থেকে আলাদা করে দেখানোর চেষ্টা চলছে। এই সাংঘাতিক প্রবণতা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে দুর্বল তো করছেই, তার সঙ্গে সঙ্গেই ছদ্ম-ইতিহাস, সিউডো হিস্ট্রি ও ছদ্ম-বিজ্ঞানকে সিউডো সায়েন্সকেও উৎসাহিত করছে এবং পাশাপাশি তা গণতন্ত্র আর বহুস্বরের বহুত্ববাদী মূল্যবোধের কাছে এক রাষ্ট্রীয় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর পথম ধাপ হল, হিন্দু রাষ্ট্রের লক্ষ্য: আজ নয় সেই শুরু থেকেই আরএসএস-বিজেপির নীতির পিছনে যে মূল চালিকাশক্তি ছিল আর আছে, তা হল ভারতকে একটা হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। প্রাচীন ভারতকে এইজন্যই তারা খুব সূক্ষ্ণভাবে একটি হিন্দুকেন্দ্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে থাকে, ইতিহাসে মুঘল পিরিয়ড মুছে দাও, তাহলে থাকবে পড়ে সুলতান, লোদি, খিলজি বংশ, সেগুলোকেও মুছে দাও, তাহলে ভারত হয়ে ওঠে এক হিন্দু দেশ, তার মুঘল, ইসলামিক, বৌদ্ধ বা জৈন বা বিস্তীর্ণ আদিবাসী মানুষজনের ইতিহাসকে মুছে দিয়েই হিন্দু ইমেজ তৈরি করা সম্ভব বলে তারা ভাবে।
রাজপুতদের মধ্যে লড়াই, সম্রাট অশোকের রাজ্য দখল বা সমুদ্রগুপ্তের দাক্ষিণাত্য অভিযানের কথা তাদের মাথায় থাকে না, যা ছিল হিন্দু রাজাদের মধ্যে খেয়োখেয়ি, মারপিট, যুদ্ধ। কিন্তু তাদের আজকে এই হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের এই প্রচেষ্টা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে ভেঙে চুরমার তো করবেই, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মনে আশঙ্কা আর উদ্বেগ সৃষ্টি করবে, সেটাই বিজেপির লক্ষ্য। সেই পথেই চলছে শিক্ষা আর ইতিহাসের গেরুয়াকরণ: বিজেপি, আরএসএস-এর একটি প্রথম আর প্রধান কৌশল হল শিক্ষার ‘গেরুয়াকরণ’। মানে সিলেবাস বদলে দাও, সিলেবাসে সব কিছু হয়ে উঠুক হিন্দু-কেন্দ্রিক। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়? দরকার নেই, থাকুক সেই বিশ্ববিদ্যালয়কে কীভাবে হিন্দু আমলে আবার গড়ে তোলা হচ্ছে তার প্রচেষ্টার কথা, হিন্দু হৃদয় সম্রাট সেই প্রকল্পে কার বাবার কত পয়সা ঢেলেছেন সেটা থাকুক বড় করে। পাঠ্যক্রম পরিবর্তন হোক আর প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ছাঁচে ফেলা হোক। এই কাজের মধ্যেই রয়েছে হিন্দু সভ্যতাকে গুরুত্ব দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের পুনর্লিখন, কেবলমাত্র হিন্দুকেন্দ্রিক ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি্কেই তুলে ধরা আর ভারতীয় ইতিহাসের সেই অংশগুলোকে কম গুরুত্ব দেওয়া বা বাদ দেওয়া যা তাদের এই মতাদর্শের সাথে মেলে না। এনসিইআরটি National Council of Educational Research and Training কে এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে , পরিচিত নামীদামি ইতিহাসবিদরা এনসিইআরটি-র ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকগুলোকে ‘একতরফা’ করার প্রচেষ্টায় ‘আতঙ্কিত’ বলে জানা গেছে। বারো ক্লাসের ইতিহাস বইয়ের সাম্প্রতিক সংশোধনে বাবরি মসজিদের উল্লেখ পর্যন্ত বাদ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | পার্থ চ্যাটার্জির মামলাও কি ইডি বন্ধ করে দেবে?
আরএসএস-অনুমোদিত সংগঠন যেমন ‘বিদ্যা ভারতী’ সারা দেশে বহু স্কুল চালায় যেখানে হিন্দু সংস্কৃতি আর ইতিহাসের উপর জোর দেওয়া হয় এবং প্রায়শই অপ্রমাণিত ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক দাবিগুলোকে সত্য হিসাবেই উপস্থাপন করা হচ্ছে। উদাহরণ চাই? দিচ্ছি, শুনুন, বৈদিক যুগের দার্শনিক কণাদকে প্রথম পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং ঋষি ভরদ্বাজকে ‘বিমান চালনার জনক’ বলে দাবি করা হয়েছে, এটা ইতিহাস? এটা বিজ্ঞান? এই আজগুবি পাঠ নেবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম? এগুলোই সেই ছদ্ম-ইতিহাস ও ছদ্ম-বিজ্ঞানের উদাহরণ। আরএসএস আর তার নেটওয়ার্কের ভূমিকা: সবাই জানে আরএসএস হল বিজেপির মূল সংগঠন যা বিজেপির আদর্শগত ভাবনা তৈরি করে আর তাকে এক নব্য-হিন্দু পরিচয় দেয়। বিজেপি হিন্দুদের পার্টি, কে বলেছে? কোন হিন্দু? শাক্ত? শৈব? বৈষ্ণব? একেশ্বরবাদী? নিরীশ্বরবাদী? কেউ জানে না, কিন্তু আরএসএস-এর কল্যাণে বিজেপি এক হিন্দু পরিচয় পেয়েছে। আরএসএস-এর অনুমোদিত স্কুল এবং সংগঠনগুলির যেমন বিদ্যা ভারতী বা অখিল ভারতীয় শিক্ষণ সংস্থান, বা বনবাসী শিক্ষা কেন্দ্র এইসব মিলে একটা বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে যার মাধ্যমে তারা শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে এবং তাদের মতাদর্শকেও প্রচার করে। অন্যদিকে আরএসএস-কে একটা আধা-সামরিক সংগঠন হিসাবেও বর্ণনা করা হয়েছে, যা তার সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ জাগানোর কথা বলে আর ভারতীয় ইতিহাস ও রাজনীতির এক ধারাবাহিক ইচ্ছাকৃত বিকৃত বিবরণ প্রচার করে।
সংখ্যালঘুদের ব্রাত্যকরণ, অন্যদের থেকে আলাদা করে দেখানোর চেষ্টা: হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের আর একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ‘অ-হিন্দু ধর্মীয় পরিচয়গুলোকে’, বিশেষ করে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের, তীব্রভাবে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেখানো। ওরা আমরার একটা বাইনারি তৈরি করে দেওয়া। আর সেটা করার জন্য ঐতিহাসিক বিবরণগুলোকে এমনভাবে পরিবর্তন করা হয় যাতে মুসলিম আক্রমণকারীদের হিন্দু সংস্কৃতি ধ্বংসকারী হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়, যা মুসলিমদের চূড়ান্ত ভাবে অন্য কিছু, এক মানুষ্যতের কিছু হিসেবেই দেখানোর কাজ করে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) এবং প্রস্তাবিত অভিন্ন দেওয়ানি বিধির মতো বিতর্কিত আইন আসলে এই উদ্দেশ্যেই আনা হয়েছে বা হবে। এবং এই কাজের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল মিডিয়া এবং তথ্য প্রচারের কৌশলগত ব্যবহার: বিজেপি ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে এবং প্রভাবিত করতে এক অত্যন্ত সুপরিকল্পিত নতুন মিডিয়া কৌশল ব্যবহার করে, বিশেষ করে তার আইটি সেল এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে, এই কৌশলের লক্ষ্যই হল ক্রমাগত ভুয়ো মিথ্যে ফেক নিউজ ছড়িয়ে ভোটারদের মন জয় করা, যাকে কখনও কখনও অনেকেই এক ‘স্মার্টফোন যুদ্ধ’ বলেছেন। আইটি সেল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলোর একটি জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও আগ্রহের মানুষদের লক্ষ্য করে, অ্যানালিসিস করে। আর ভুল তথ্য বা অপপ্রচার ভারতীয় ভোটারদের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে এটাও পরিষ্কার, বিভিন্ন ভোটের আগে পরে এটা আমরা দেখেছি, জানিয়েওছি।
গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদের উপর প্রভাব: বহু সমালোচকেরাই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন আর হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার প্রচার ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক পরিচয় মুছে দেওয়ার এক প্রবল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এটাই ‘ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হিসাবে দেখা উচিত। বারবার সামনে আসছে একই প্রশ্ন, আপনার নাম কী? পদবি কী? যে প্রশ্ন কিন্তু এমনকী মধ্যযুগেও তেমনভাবে ছিল না, আসলে এসব করে অতীত আর ভারতীয় সংস্কৃতির মিশ্র সংস্কৃতির ধারণাকেই ভেঙে চুরমার করা হচ্ছে। বারবার প্রশ্ন উঠছে, কারা ভারতীয়? কারা ভারতের অন্তর্গত? আসলে এই প্রশ্নটা ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। । একের পর এক ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক ও ছদ্ম-ঐতিহাসিক দাবি এসে হাজির হচ্ছে। আরএসএস-অনুমোদিত স্কুলগুলো থেকে আসা দাবিগুলোকে একের পর এক রাষ্ট্র পরিচালিত স্কুলগুলোর আনুষ্ঠানিক পাঠ্যক্রমে, এমনকী এনআইওএস National Institute of Open Schooling এর অধীনে থাকা স্কুলগুলোতেও ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, লাগু করা হচ্ছে। এই দাবিগুলোর একটারও কোনও ঐতিহাসিক বা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই, কোনও গবেষণাও নেই, আর মূলধারার বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদরা এগুলোকে বারবার ভুল প্রমাণ করেছেন। ভাবা যায়, এনসিইআরটি-র ভারতের চন্দ্র অভিযান সম্পর্কিত নতুন মডিউলে ‘বৈমানিক শাস্ত্র’ বইটার উল্লেখ করে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় উড়ন্ত যানের জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। মানে বৈদিক যুগে বিমান ছিল, হ্যাঁ বলা হচ্ছে। এর সঙ্গেই চলছে ধর্মীয় প্রতীক ও ব্যক্তিত্বের রূপান্তর: খেয়াল করে দেখুন হিন্দু দেবতা রামকে ভক্তিমূলক চরিত্র থেকে রূপান্তরিত হয়ে আপাতত দক্ষিণপন্থী হিন্দুদের একটি শক্তিশালী, যোদ্ধা দেবতা হয়ে উঠেছে, যার জন্মতিথি উদযাপনে অস্ত্র প্রদর্শনী নাকি ভারি জরুরি। জয় শ্রীরাম বা জয় সিয়ারাম ধ্বনি, যা একসময় সমাজে এক অভিবাদন ছিল, এখন তা ঘৃণার চিৎকার, হেট স্পিচ হয়ে উঠেছে।
এক বহুত্ববাদী বহুস্বরের দেশ, এক অভূতপূর্ব বৈচিত্র্যের সমম্বয় এই দেশকে হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থান বানানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আরএসএস-বিজেপি আর তার জন্য সমস্ত রকমের আইন নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করেই তারা দেশের প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগাচ্ছে, এবং এত কিছুর পরেও তাদের সফলতা কত? তারা ৩১-৩২ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে এসে থেমে আছে, এখনও হিন্দু জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ মানুষ তাদের সমর্থন করে না, যা আসলে বুঝিয়ে দেয় আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুস্বরের ভিত্তি কত গভীর, কত বিস্তৃত।