নিউইয়র্কের ম্যানহাটন, পিন নম্বর, ১০০১৭৭৬০ ইউনাইটেড নেশন্স প্লাজা, রাষ্ট্রসংঘের সদর দফতর, ভাবুন শ্রোতারা মন দিয়ে শুনছে, বক্তা মালকোঁচা ধুতি পরা খালি গায়ে এক সাঁওতাল যুবক, সে বলছে জল, জমিন, জঙ্গলের কথা, সে বলছে পরিবেশের কথা, সে বলছে তাঁদের ভগবানের কথা, তাঁদের ভগবান গাছ, তাঁদের ভগবান পাহাড়, তাঁদের ভগবান ঝরণা, যা কেটে, ভেঙে, চুরমার করে গড়ে তোলা হচ্ছে সভ্যতা, সে তথ্য দিয়ে জানাচ্ছে, এই নিউইয়র্কেই কত গাছ ছিল, কত পাখি ছিল, কত ঝরণা ছিল, তার কথা। সে বলছে সভ্যতা তৈরি করতে গিয়ে কত শত গাছ, পাখি, জন্তু মুছে গেছে পৃথিবী থেকে, সে সভ্য, তথাকথিত সভ্য মানুষদের বলছে, দোহাই আর উন্নয়নের গল্প বলবেন না, আর উন্নয়ন চাই না, যে উন্নয়নের হাত ধরে ঢুকে পড়ে হাজারো ভাইরাস, মারণ অস্ত্র, যে উন্নয়ন লক্ষ কোটি মানুষকে ভুখা রেখে ৫ জনকে করে তোলে বড়লোক, চাই না। আর সে এসব বলছে তাঁর মাতৃভাষায়, সাঁওতাল ভাষায়।
আজ এই কথা কেন? কারণ আজ ৩০ জুন। ১৮৫৫ র এই দিনে অবিভক্ত বাংলার বীরভূমের, ভগনাডিহি থেকে এই উপমহাদেশের প্রথম লং মার্চ বেরিয়েছিল। সুদখোর মহাজন, শেঠ,বানিয়ারা সাঁওতাল গ্রামে, এলাকায় আসে ব্যবসা করতে। অভাবের তাড়নায় এই সব মহাজনদের কাছ থেকে ধারে ধান, চাল, নুন, তেল বা টাকা নিলে সাঁওতালদের ‘কামিয়াতি’ ও ‘হারওয়াহি’ নামে দু-ধরনের বন্ডে সই করতে হত। কামিয়াতি ব্যবস্থা হল, যতদিন না ঋণ শোধ দিতে পারবে ততদিন সাঁওতালদেরকে পরিবার সমেত, মহাজনের জমিতে বেগার খাটতে হবে। হারওয়াহি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে, ধার শোধ করতে না পারলে তাঁদের মহাজনদের জমিতে বেগার শ্রম তো দিতেই হত, তার পরেও অন্য কাজ, পালকি বওয়া, খামার পরিস্কার করা, মাল বওয়া ইত্যাদি করতে হত। সরল, অক্ষরজ্ঞানহীন আদিবাসীদের ঠকানো ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার, তাঁরা বেচারাম বা ছোটো বাউ নামে বাটখারা দিয়ে হিসেবের থেকে কম ওজনের জিনিস বিক্রি করে সাঁওতালদের ঠকাত, আবার সাঁওতালদের কাছ থেকে কোনও শস্য কেনার সময়, হিসাবের থেকেও ভারী ওজনের, কেনারাম বা বরা বাউ বাটখারা ব্যবহার করে কম দাম দিয়ে বেশি মাল কিনতো। সাঁওতালরা, আদিবাসীরা ধান আনলেই বলতো, কেনারাম চাপা, তারপর মাপা শুরু হত, কিছুতেই আর দশ মণ হত না, আট মণ থেকে ফিরে যেত দুই কি তিন মণে, সেই আদিবাসী তখন কাঁদতো, বলতো, বাবু বলনা কেনে ১০ মণ! লর্ড ডালহৌসির আমলে রেলকর্মচারীও ঠিকাদারেরা সাঁওতালদের প্রাপ্য মজুরি না দিয়ে তাঁদেরকে বঞ্চিত করত। সাঁওতালদের থেকে তাঁরা জোর করে হাঁস, মুরগি, পাঁঠা কেড়ে নিত। ইংরেজ সেনারা, ঠিকেদাররা অনেক ক্ষেত্রে সাঁওতাল মেয়েদের ওপর অত্যাচার করতো, সরকারি তরফে দিনের পর দিন মাত্রা ছাড়া হারে রাজস্ব আদায় করা শুরু হলে তাঁরা বিদ্রোহের পথে যায়। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে জুন গোক্কো ও বীরসিং নামক গোষ্ঠীপতিদের ওপর ইংরেজ সরকার অত্যাচার চালায়, তার প্রতিবাদে হাজার হাজার সাঁওতাল লাঠি, বল্লম, তির, ধনুক নিয়ে দামিন অঞ্চলে জড় হয় এবং বেপরোয়া লুঠতরাজ এবং দারোগা ও মহাজনদের হত্যা করে। পালটা অত্যাচার নামিয়ে আনে জমিনদার, মহাজন, ইংরেজরা। প্রতিবাদে সাঁওতালরা সিধু ও কানহু নামে দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে জুন ভাগনাডিহির মাঠে জড় হয়, স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে ।
‘আদ বাংবন পৌচঃ সিধু আদ বাংবন থিরঃ,
বাইরি ঞেলতে লৌড়হাই ঘন বাংবন ঞিরঃ।
বহঃক্ ঞুরুঃ রেহঁ সিধু মায়াম লিঙ্গি রেহঁ,
বাংবন পাচঃ লৌড়হাই আবন দেবন সহরঃ।।
‘আর আমরা পিছু হঠব না সিধু আর চুপ থাকবে না,
শত্রু দেখে লড়াই থেকে পালাব না,
মাথা উড়ে গেলেও সিধুর রক্ত বইতে থাকলেও,
আমরা আর পিছু হটবনা,লড়াই মুখো হব।’
৩০ জুন ১৮৫৫, বীরভূমের ভাগিনাডিহি থেকে সিধু কানুর নেতৃত্বে সাঁওতাল, কুমোর, তেলি কর্মকার, চামার, ডোম, মোমিন সম্প্রদায়ের গরীব মুসলমান, গরীব হিন্দু মানুষ এই উপমহাদেশের প্রথম লং মার্চ শুরু করে, কলকাতা, যেখান থেকে ব্রিটিশরা শাসন করছিল ভারতবর্ষ, সেই দিকে রওনা দেয়, কোনও চোরা গোপ্তা লড়াই নয়, রাজধানী দখল করার জন্য লং মার্চ, দিকুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য লং মার্চ, চলো কলকাতা।
নেতৃত্বে সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব। কেবল পুরুষ নয়, সাঁওতাল মেয়েরাও ছিলেন এই লড়াইয়ের সামনের সারিতে, ফুলো মুরমু, ঝানো মুরমু। বীর ইংরেজরা ফুলো মুরমুকে ধর্ষণ করে, হত্যা করে। সেই কবে ১৭৮৫ তে তিলকা মাঁঝি যে লড়াই শুরু করেছিল, ১৮৫৫ র সাঁওতাল হুল ছিল তারই শিক্ষা নিয়ে আরও বড় লড়াই, লড়াই ছিল সরাসরি ইংরেজদের বিরুদ্ধে, উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে।
তথ্য দেবো না, এসব তথ্য আপনারা জানেন, আমি কেবল ১৮৫৫ র সাঁওতাল হুল এর কয়েকটা বৈশিষ্টের কথা বলবো, যে কারণে এই সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮৫৫ র হুল ঐতিহাসিক।
প্রথম কথা হল, সাঁওতাল বা আদিবাসীদের বিদ্রোহ কিন্তু ১৮৫৫ নয়, তার বহু আগে, যখন ভারতবর্ষে তেমন কোনও বিদ্রোহের খবরই নেই, সেই তখন ১৭৮৫ তে শুরু হয়েছিল, মাথায় রাখুন, ১৭৫৭ তে সবে লর্ড ক্লাইভ পলাশীর যুদ্ধ জিতেছে, বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা দখল করেছে, তারপর প্রথম প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এসেছিল আদিবাসীদের কাছ থেকে, কলকাতার শিক্ষিত সমাজ নয়, সংবাদ প্রভাকরে তখন ছাপা হত, ওই আদিবাসীদের অসভ্য বিদ্রোহের খবর, হ্যাঁ, কলকাতার এলিটরা সাঁওতাল বিদ্রোহকে অসভ্য, বন্যদের বিদ্রোহ বলেই মনে করতেন, সম্পাদকীয়তে তাই লেখা হয়েছিল, রাজ বিদ্রোহীগণ … ইত্যাদি গ্রাম লুঠ করিতেছে, প্রজাদিগের যতা সর্বস্ব অপহরণ পূর্বক দগ্ধ করিতেছে, অনেকের প্রাণ সংহার করিয়াছে। এইরূপ অত্যাচার কুত্রাহি হয় নাই … রাজা জামাতা অতি সম্ভ্রান্ত ধনাঢ্য লোক, তাঁহার যখন সর্বস্ব গিয়া এইরূপ অবস্থা হইয়াছে, তখন প্রজার দুঃখ বিবরণ কি বর্ণনা করিব? এই বিষয় লিখিতে কাষ্ঠের লেখনিও ক্রন্দন করিতেছে! বেঙ্গল হরকরা, সে সময় প্রকাশিত আরেক বড় পত্রিকা, তাতেও সাঁওতাল বিদ্রোহীদের অত্যাচারের কাহিনী, তাদের ওপর যে অত্যাচার চলছিল, জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল, জঙ্গলে ঢোকা মানা হচ্ছিল, তাদের ঘরের মেয়েদের ইজ্জত আবরু নিয়ে ছিনিমিনি হচ্ছিল, তার কোনও উল্লেখ নেই, সে সব খবরে সম্পাদক বিচলিত হননি।
দ্বিতীয় কথা হল ১৮৫৫ র হুল ছিল গরীব মানুষের, গরীব কৃষকের, নেতৃত্বেও বশ্যই ছিলেন সিধু কানু, কিন্তু সঙ্গে ছিল বহু অন্য বর্ণের, অন্য ধর্মের গরীব মানুষজন। ডোম, চামার, চুয়াড়, মোমিন গরীব মানুষের নেতৃত্বে সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব। চার ভাই।
কেবলমাত্র তীর ধনুক আর সাধারণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেই বিদ্রোহের নায়করা, শুরুর দিকে বেশ কিছু লড়াইয়ে জিতেওছিলেন, যা ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের, ইংরেজ সাহেবদের তো বটেই।
এই বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয় ইংরেজরা, বিশ্বাসঘাতকদের সাহায্য নিয়ে, যে ইংরেজ সাহেবরা নেতৃত্ব দিতে এসেছিলেন, তাঁদের কয়েকজন লিখেছেন, পরিস্কার লিখেছেন, যে তাঁরা অন্যায় যুদ্ধ করেছিলেন, গণহত্যা করেছিলেন।
১৮৫৫ র হুল দমন করা গিয়েছিল, কিন্তু এই হুল, এই বিদ্রোহই ১৮৫৭ র সিপাহী বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছিল, ১৮৫৫ র সাঁওতাল হুলের মধ্যেই লুকিয়েছিল আগামী আর এক বিদ্রোহ, দেশ জোড়া বিদ্রোহ।
১৭৮৫ থেকে ১৮৫৫ পর্যন্ত ৬ বার হুল হয়েছে, ৬ বারের বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল আদিবাসী মানুষজনদের ওপর অন্যায়, অবিচার। তাদের জল জঙ্গল জমিন কেড়ে নেবার বিরুদ্ধেই, সরব হয়েছিলেন আদিবাসী নেতারা, তাঁরা অরণ্যের অধিকার ছাড়তে চাননি।
আজও সেই একই অবস্থা সারা দেশ জুড়ে। কয়েকটা তথ্য দিই, বুঝতে পারবেন। ১৯৪৭ সাল থেকে যত শিল্প তৈরি হয়েছে, যত খনি খাদান চালু হয়েছে, যত নদী বাঁধ তৈরি হয়েছে, তার ফলে বহু মানুষের ঘর গেছে, তাঁদেরকে অন্য কোথাও সরে আসতে হয়েছে, চলে যেতে হয়েছে। সেই ১০০ জনের মধ্যে ৭৭ জন হলেন আদিবাসী, এই বিরাট সম্পদ যাদের হাতে গেল, সেই বেসরকারি মালিকানার ১ জনও আদিবাসী নয়। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে যাদের চাকরি হল, রোজগারের পথ খুলে গেল, তাদের মাত্র ১৩ শতাংশ আদিবাসী, বাকিরা অনাদিবাসী। তার মানে কী? আদিবাসীদের জমি যাবে, জঙ্গল যাবে, নদী যাবে, পাহাড় যাবে, লাভ হবে অনাদিবাসীদের। এটাই চলে আসছে ৪৭ সাল থেকে, প্রতিটা সরকার এই একই কাজ করে চলেছে। তাই আদিবাসীদের রুখে দাঁড়াতে হবে, পরিবেশ বাঁচানোর দায় আদিবাসীদের, তাকিয়ে দেখুন বাস্তারের দিকে, তাকিয়ে দেখুন নিয়মগিরির পাহাড়, গোটা দেশে জল জঙ্গল বাঁচানোর লড়াই লড়ছে ওই আদিবাসীরাই, তাঁদেরকে কখনও ক্রিমিনাল বলে, কখনও মাওবাদী বলে জেলে পোরা হচ্ছে, দেশের জেলখানায় বিনা বিচারে পচে মরছে যে কয়েদিরা, তাঁদের সিংহভাগ আদিবাসী, গরীব আদিবাসী, যাদের মাওবাদী বলে জেলে পোরার পর আইনী সাহায্যও দেওয়া হয় না, মিথ্যে মামলার পাহাড় চাপানো হয়, ১০/১৫ বছর জেলে থাকার পর জামিন পায়, মামলা খারিজ হয়, এমনটা আকছার ঘটছে। আজকের এই নরেন্দ্র মোদি সরকার, সব থেকে ঘৃণ্য আক্রমণ নামিয়ে এনেছে দেশের সংখ্যালঘু মানুষ, আর আদিবাসীদের ওপর। আজ আবার একটা হুল এর প্রয়োজন, সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব আবার দেবে ওই জঙ্গল পাহাড়, ঝরণার ধারে বড় হয়ে ওঠা মানুষ। ওই কালোকুলো শক্ত সবল পুরুষ ও নারী পিনাকেতে দেবে টঙ্কার, আবার তাঁদের দেখা যাবে লড়াইয়ের ময়দানে, কোনও এক অখ্যাত গ্রাম ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরবেরা, বেরিয়ে আসবে ফুলো মুর্মু, ঝানো মুর্মু। সেবারে হেরেছিল, এবারে হারবে না। ১৭৮৫ থেকে এই আদিবাসীরা লড়ছে, দিকুদের বিরুদ্ধে লড়ছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছে, ১৮৫৫ সালের ৩০ শে জুন তাঁদের লং মার্চের প্রতিধ্বনি শোনা যাবে আবার, শোনা যাবে, দেলায়া বিরিদ পে, দেলায়া তিঙ্গুন পে, জাগো, এবার সাঁওতালরাজ কায়েম করো, সাঁওতাল তার কথা বলবে রাষ্ট্রসংঘে, সাঁওতালিতে।