ভারতে সাম্প্রতিক কালে যখনই কোনও বড় ইস্যু দেখা দিয়েছে, বিজেপি সেখানে কাকে প্রজেক্ট করেছে? উত্তর একটাই। নরেন্দ্র দামোদর মোদি। উদাহরণ হিসেবে কিছুদিন আগের কুম্ভমেলার কথাই বলছি। প্রায় কর্পোরেট স্টাইলে দেশের জনগণের কাছে পেশ করা হয়েছিল এই কুম্ভমেলাকে। যেখানে পোস্টার থেকে শুরু করে বড় বড় ফ্লেক্স ঢেকে দিয়েছিল দেশের আকাশ, আর সেই সব জায়গাতেই কার ছবি জ্বলজ্বল করছিল? নরেন্দ্র দামোদর মোদি। কুম্ভমেলা মিটেছে। এবার বিজেপির সামনে নয়া ইভেন্ট – বিহার ভোট। মজা হচ্ছে, বিহারে বিধানসভা নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে বিজেপি কিন্তু সেখানে এক নয়া রাজনীতির গল্প গড়ছে, যা শুধু ভোটের হিসেব নয়, বরং বিহার তথা গোটা দেশের আর্থসামাজিক ধারাটাকেই পাল্টে দিতে চায়। বিজেপির এই নয়া গল্পে আছে জাতীয়তাবাদ, সামাজিক ন্যায়, হিন্দু আর উন্নয়নের মিশ্রণ। আর এই সব কিছুকে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মের মতো ধারণ করছেন কে? নয়া মসিহা – নরেন্দ্র মোদি।
এর শুরু হয়েছে কিন্তু অনেকদিনই। মনে করুন লালকৃষ্ণ আদবানির সেই বক্তব্য, “মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে।” মনে করুন রাম-রথ, ভারত চিরে এগোতে এগোতে যে রথ থমকে দাঁড়িয়েছিল বিহারের মাটিতে। আদবানির যে রথ আটকে দিয়েছিলেন লালুপ্রসাদ যাদব। কিন্তু হিন্দুত্ববাদের চাকা মোটেই কর্ণের রথের মতো মাটিতে পুঁতে যায়নি। গড়িয়ে গিয়েছে, ছড়িয়ে গিয়েছে ভারতের কোণায় কোণায়। কিন্তু এর পুরো প্রচারের পিছনে কাজ করছে এক সংগঠিত শক্তি। যাদের একটা নির্দিষ্ট আদর্শ আছে। একটা লক্ষ্য আছে। আর সেই লক্ষ্যের জন্য, নিঃশব্দে কাজ করে যায় তাঁরা। এই শক্তির নাম রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস। এই সংগঠন চুপচাপ বিজেপিকে সামনে রেখে, তাদের আদর্শগত পরিল্পনাগুলোকে বাস্তবের মাটিতে ফলিয়ে তুলছে। বিশেষ করে এমন সব রাজ্যে, যেখানে রাজনীতি খুব জটিল ও পরিবর্তনশীল।
ইতিহাস বলছে আরএসএস ব্রিটিশের দালাল। কিন্তু সে তো ইতিহাস। আজকের আরএসএস খুব ভাল করেই জানে, সাধারণ মানুষের স্মরণশক্তি ঠিক কতটা দুর্বল। আর তাই, তারা ভারতের মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছে এক নতুন গল্প। হিন্দুত্বের গল্প। উড়িয়ে দিতে চাইছে ভারতের সেই ইতিহাসকে, যেখানে মোগল, হুন, শক, পাঠান এক দেহে হল লীন। হ্যাঁ, আরএসএস-এর মূল হাতিয়ার হল জাতীয়তাবাদ। যা আরও জোরদার হয়েছে অপারেশন সিঁদুরের পর। পহেলগামে জঙ্গি হামলার জবাবে ভারতের সামরিক পদক্ষেপকে ইস্যু করে বিজেপি দেশপ্রেমের সুর তুলেছে দিকে দিকে। কিন্তু বিজেপির এই দেশপ্রেমের গান বেঁধে দিল কে? সোজা উত্তর – আরএসএস।
মজা এই, সবাই বড় হতে চায়। অন্যের হাত ধরে সারাজীবন হাঁটতে আর কারই বা ভালো লাগে? বিজেপিরও লাগছে না। আর তার প্রমাণ পাওয়া গেল, জেপি নাড্ডার একটা মন্তব্যে। যেখানে নাড্ডা সরাসরি বলেছিলেন, অন্য কারও হাত ধরে রাজনীতি করার দিন বিজেপির শেষ হয়ে গিয়েছে। এরপরেই কিন্তু আরএসএস-এর টনক নড়েছে। এক নিঃশব্দ সংঘাতের শুরুও হয়েছে এখান থেকেই। পুতুল যদি সুতোর টানে নাচতে না চায়, কোন্ বাজিকরেরই বা ভাল লাগে? নাড্ডার এই মন্তব্য আরএসএস-এরও ভাল লাগেনি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | তেজস্বী-রাহুল, দোস্তি শেষ? টলমল করছে জোট? না কি বিজেপিকে আটকাতে নতুন কৌশল?
এখন কথা হচ্ছে, আরএসএস যদি বিজেপির মাথার উপর থেকে হাত তুলে নেয়, তাহলে কী হতে পারে? সোজা কথায় বিজেপির সাফ হয়ে যাওয়ারও একটা সম্ভাবনা আছে। তাছাড়া আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত তো নানাভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদির একচেটিয়াগিরি আরএসএস-এর পক্ষে মেনে নেওয়ায় অসুবিধা আছে। রাজনীতিবিদের অবসরের বয়স কত? নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে এই বিতর্কের শুরু কিন্তু মোহন ভাগবতের হাত ধরেই। তাছাড়াও যেটা লক্ষ্য করার মতো বিষয় তা হল, সংঘ কিন্তু আর আগের মতো বুক বাজিয়ে হিন্দুত্বের স্লোগান তুলছে না। এবার সংঘ কাজ করছে অনেক বেশি শান্তভাবে। তাদের পরিকল্পনা অনেক বেশি দীর্ঘমেয়াদী। আরএসএস চাইছে না, হিন্দুত্বকে শুধুমাত্র বিজেপির সঙ্গেই যুক্ত করা হোক। বরং তারা চাইছে, হিন্দুত্ব ও জাতীয়তাবাদের ধারণাকে ছড়িয়ে দেওয়া হোক গোটা সমাজ জুড়েই।
উল্টোদিকে বিজেপির অস্ত্র নরেন্দ্র মোদি। নতুন নতুন রাস্তা ও প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করছেন, উদ্বোধন করছেন বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল – মোদি নিজেকে তুলে ধরছেন ‘বিকাশ-পুরুষ’ হিসেবে। তবে বিজেপি এটাও জানে, শুধুমাত্র উন্নয়নের গল্প দিয়ে মসিহা তৈরি করা যায় না। আর তাই, প্রতিটি প্রকল্পের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে উজ্জ্বলা আবাস, আয়ুষ্মান ভারত – এইসব নাম, যাকে প্রচার করা হচ্ছে মোদির ব্যক্তিগত গ্যারান্টি বলে।
আরএসএস–বিজেপি এই নিঃশব্দ টানাপোড়েনের মাঝখানেই ভোট এসে গিয়েছে বিহারে। বিহার এখন বিজেপির নতুন পরীক্ষাক্ষেত্র। জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুত্বের পাশাপাশি সামাজিক ন্যায়বোধকেও মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বিহারে। মহিলাদের সমাজের সামনের স্তরে এগিয়ে আনা, পিছড়ে বর্গকে তুলে ধরা – এই সমস্ত কিছু নিয়েই মাঠে নেমেছে বিজেপি যেখানে নির্ধারক নেতার ভূমিকায় থাকছেন সেই নরেন্দ্র মোদি।
কিন্তু বিহারে আরএসএস পুরোপুরি চুপ করে গিয়েছে। কেন? রাজনৈতিক কৌশল? সেই সম্ভাবনাই জোরদার। কেন না বিহার ও বাংলায় নতুন কৌশল নিয়েছে আরএসএস, যার নাম ‘ত্রিশূল ফর্মুলা’। এই ত্রিশুল বা ত্রিমুখী কৌশলের এক নম্বর হল, অসন্তুষ্ট ভোটার চিহ্নিত করা। বিহারে খুঁজে বার করা হচ্ছে বেকার ও দুর্নীতিতে অসন্তুষ্ট ভোটারদের। আর পশ্চিমবঙ্গের সংঘের লক্ষ্য, শহর ও আধা শহরের সেই সব ভোটারেরা যারা তৃণমূল ও কংগ্রেসের ওপর বিরক্ত। দ্বিতীয় কৌশল হল, স্থানীয় ও জাতীয় ইস্যুর মিশ্রণ। বিহারে কর্মসংস্থান, কৃষি সংস্কার, জাতি সংরক্ষণ – এই নিয়ে প্রচার চালাচ্ছে আরএসএস। যেখানে পশ্চিমবঙ্গে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে দুর্নীতি ও আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে। সংঘের তৃতীয় কৌশল হল, ধর্মীয় মেরুকরণ। বিহারে উচ্চবর্ণ ও ওবিসিদের একসাথে মেলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে তিনশোটিরও বেশি হিন্দু ধর্মনীয় অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা নিয়েছে তারা।
বোঝাই যাচ্ছে লম্বা দৌড়ের জন্য তৈরি হচ্ছে আরএসএস। আর এই দৌড়ের জন্য তাদের আছে সংগঠন, ডিসিপ্লিন আর নিখুঁত রণনীতি। শুধুমাত্র নরেন্দ্র মোদিকে ভাঙিয়ে কি বিজেপি সেই দৌড়ে টিকে থাকতে পারবে? আরএসএস-এর হাত ছাড়লে কোথায় যাবে বিজেপি? বিহার ভোটেই উত্তর মিলবে তার?