সর্দারজীদের নিয়ে অনেক জোকস আছে, সে সব জোকস আবার সর্দারজীরাই রসিয়ে রসিয়ে বলেন, আমার এক পরিচিত প্রীতম সিং, আকাশবাণী কলকাতার ঘোষক ছিলেন, দেখা হলেই দুটো সর্দারজীর জোকস না বলে ছাড়তেন না, কিন্তু জাঠদের নিয়ে রসিকতার তেমন গল্প শোনা যায় না, আপাত রুক্ষ, ইয়া ইয়া চেহারার জাঠদের নিয়ে রসিকতা করবেই বা কে? তো সেই জাঠেদের নিয়ে এক রসিকতা, এক জোকস চরণ সিংহ বলতেন, অনেককেই বলেছেন, তাদের কাছ থেকে শোনা। আজ আবার মনে পড়ে গেল। এক জাঠ চুরির দায়ে ধরা পড়েছে, বিচার সভা, মানে পঞ্চায়েত বসেছে।
দুটো সাজার কথা তাকে বলা হল, পঞ্চপ্রধান বললেন হয় তোমাকে ১০০ টা কাঁচা পেঁয়াজ খেতে হবে নাহলে ১০০টা জুতোর ঘা। শুনেই জাঠ বলল, আফটার অল আমি জাঠ, জুতোর ঘা খাওয়া বড্ড আত্মসন্মানে লাগবে, ওই পেঁয়াজই বরং ভালো। লাও পেঁয়াজ। পেঁয়াজ আনা হল, জাঠ খেতে শুরু করল, গোটা দশেক খাবার পর নাজেহাল, চোখ মুখ থেকে জল বের হচ্ছে, ঝাঁজের চোটে নাজেহাল জাঠ বলল, ঢের হয়েছে, এর থেকে জুতোর ঘা অনেক ভাল, আনো জুতো। তাগড়া চেহারার আরেক জাঠ এগিয়ে এসে মারতে শুরু করল, ঘা ধশেক পড়ার পর, জাঠ কাঁদছে আর বলছে, থামাও বাপু, এর থেকে পেঁয়াজ খাচ্ছি।
আবার দশটা পেঁয়াজ, আবার কান্না, আবার জুতো, আবার কান্না, আবার পেঁয়াজ। এভাবে ১০০টা পেঁয়াজও শেষ, একশ ঘা জুতোও পিঠে পড়ল। মোদিজী জাঠ নয়, কিন্তু ওনার অবস্থা দেখে, আজ আমার সেই জাঠের গল্প মনে পড়ল। ওপর থেকে জাঠ কৃষক নেতা চরণ সিং নিশ্চই হাসছেন, হাসবেন বৈকি। দেশের প্রধানমন্ত্রী কৃষি বিল আনলেন, দেশে তো বটেই বিদেশেও প্রতিবাদ হল, র্যলি, মিছিল, সভা, সমাবেশ এ স্বৈরাচারী, নির্বোধ, কৃষকবিরোধী, এসব বিশেষণ বরাদ্দ হল আমাদের প্রধানমন্ত্রীর জন্য। এবার তিনি বিল ফেরত নিলেন, যারা বিলের বিরুদ্ধে তাঁরা বলছেন, আমাদের আন্দোলনের চাপে বিল ফেরত নিলেন স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী, যাঁরা সেদিন কৃষি বিল সমর্থন করেছিলেন, তাঁরা বলছেন পিছু হটলেন প্রধানমন্ত্রী, ৫৬ ইঞ্চি কোথায় গেল ইত্যাদি ইত্যাদি!
এমনটা যে হবেই, সেটাও আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভাল করেই জানতেন, তাহলে করলেন কেন? আরএসএস-এর চাপ? দলের চাপ? মাত্র ক’দিন আগে বিজেপির কার্যকারিণী বৈঠক হয়ে গেল, বিরাট বৈঠক। সে বৈঠকের খবর ছাপা হয়েছে, সেখানে একবারের জন্যও এই কৃষি বিলের কথাও নেই, তার মানে এমনকি দলের মধ্যেও কারোর রিড় কি হাড্ডি, যাকে বলে মেরুদন্ড, তাতে এমন সাহস নেই যে এই প্রসঙ্গ তোলেন, কেউ তোলেননি।
সাত দিনের মধ্যে সাত সকালে মন কি বাত, তপস্যা ইত্যাদি বলে ১০০ ঘা জুতো এবং পেঁয়াজের গল্প। কেন? আসলে এই মুহূর্তে আর এস এস বা বিজেপির এমন কেউ নেই, যারা দেশ জুড়ে বিজেপির এই সাকুল্যে দেড় জনের বিন্দুমাত্র বিরোধিতা করতে পারেন, তাদের কে প্রশ্ন করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর এক কোর টিম আছে, তাঁরা বিভিন্ন সমীক্ষাতে দেখেছেন নির্বাচনের আকাশে কালো মেঘ, তাদের মনে হয়েছে, অন্তত আপাতত কৃষকদের এই বিরাট বিক্ষোভকে সামাল দেওয়া যাবে, তাদের পরামর্শে, নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে তিনি ফেরত নিলেন কৃষি বিল, ১০০ ঘা জুতো আর ১০০টা পেঁয়াজ খাওয়ার গল্প।
ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ফেরত নিয়েছিলেন, তখন তিনিও ভুল স্বীকার করেননি, হেরেছিলেন, নির্মম হার। কাজেই ক্যামেরার সামনে দাড়ি ট্রিম করে এসে ত্যাগ আর তপস্যার কথা বললেই, আপনারই মন্ত্রিসভার মন্ত্রীর ছেলের গাড়ির চাকার তলায়, পিষে মরে যাওয়া কৃষকরা সব ভুলে আপনাকে ক্ষমা করে দেবেন, আপনার পুলিশের লাঠি, টিয়ার গ্যাস আর জলকামানে আহত কৃষকরা আপনার দিকে ক্ষমাসুন্দর চোখে চেয়ে থাকবেন, গত এক বছর ধরে শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় রাস্তায় বসে থাকা আন্দোলনরত কৃষকরা, আপনার নামে জয়ধ্বনী দেবেন এমনটা মনে করার কোনও কারণ আছে কি? আর আজ কৃষকদের দাবি তো বিল ফেরত নেওয়া নয়, তার দাবি এম এস পি, তার দাবি সস্তায় বীজ, সার সেচ।
আসল সমস্যাটা অন্য জায়গায়। ১৯৪৭-এ দেশ স্বাধীন হল, এক বিরাট কৃষি প্রধান দেশে তখন ভারি শিল্পের দরকার, নেহেরু সেদিকে মন দিলেন, বড় বাঁধ তৈরি হল, বড় বড় ইস্পাত কারখানা, মানুষের সামনে তখন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অগ্রগতি, বিদ্যুৎ আর ইস্পাত। রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পে, বিরাট বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গেই জন্ম নিল মধ্যবিত্ত মানুষজন, চাহিদার জন্ম হল, বহু বিচিত্র চাহিদা, টুথপেস্ট, টুথব্রাস থেকে শুরু করে চটি জুতো, জামা কাপড় আরও কত কিছুর, সে সব শিল্প গড়ে উঠল, শ্রমিকদের দাবি বেশি মজুরির, ওদিকে রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প, রেল, ডাক, তার, বন্দরে কর্মচারিদের মজুরি বাড়ছে, ডিএ বাড়ছে, অর্গানাইজড প্রাইভেট সেক্টরে কর্মচারি শ্রমিকদের মাইনে বাড়ছে, বোনাস, ডিএ কত কিছু।
কৃষকরা শুধু স্লোগান পেল, জয় জওয়ান, জয় কিসান। সবুজ বিপ্লব এর ছোঁয়া পেল কৃষকদের এক অংশ, বাকিরা যে তিমিরে সে তিমিরে। এরপর নরসিমহা রাও, মুক্ত বাজার, ততদিনে সোভিয়েত মডেল ভেঙে চুরমার। প্রবল গতিতে অর্থনীতির আগল ভাঙল, আমরা শুনলাম ওর মাইনে ৬০ হাজার, তার মাইনে মাসে ৮০ হাজার, কেউ কেউ লাখের গল্প শোনাল। কয়েক বছর পরে, শ্রমিক কর্মচারী বলতে একটা হোমোজেনিয়াস শ্রেণিই রইল না, তাদের কেউ মাসে ৮ কি ১০ লাখ পায়, কেউ ৮০০ টাকা। কিন্তু কৃষক তখনও যে তিমিরে সে তিমিরেই, তাদের সেই আকাশের দিকে চেয়ে বসে থাকা, তাদের হা পিত্যেস ধানের দাম না পাওয়া, তাদের মাথার ওপর দিয়ে খরা আর বন্যা বয়ে যায়, ৬০ শতাংশ মানুষ কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত, তার ১৫ শতাংশ সম্পন্ন, বাকিরা হাঘরে, হা অন্ন। বিপ্লব কোথায়? দেশের মূল ধারার কমিউনিস্টরা মানুষের ভাষা বলেন না, মানুষের ভাষা বোঝেন না, তারা এখন নিজেরাই বিপন্ন প্রজাতি।
তাহলে এই বিরাট কৃষি ক্ষেত্রের কী হবে? তার তো সংস্কার দরকার। একটা ছোট তথ্য দিই, আমাদের দেশে কৃষি যোগ্য জমির ২৫ শতাংশের কম জমিতে একটার বেশি ফসল ফলানো হয়, মাত্র ১৩ শতাংশ জমিতে ২ টোর বেশি ফসল তোলা হয়, তার মানে ভাবুন, যদি এই বিরাট জমির ৮০/৮৫ শতাংশ জমিতে ৩ টে ফসল ওঠে তাহলে দেশ কৃষিতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আমাদের দেশে পৃথিবীর সবথেকে বেশি গরু আছে, কিন্তু দুধ? সঠিক পদ্ধতি পালনের উপায় জানা না থাকায় আমরা ২০ শতাংশ দুধ পাই, যদি ৮০/৮৫ শতাংশ পেতাম? আমাদের বিশাল উপকূলে মাছধরা, বিরাট বিরাট নদী, জলাশয়ে মৎস উৎপাদন আমাদের কী পরিমাণ আয় দিতে পারে, তার কোনও হিসেবই নেই।
সরকারের পর সরকার আসছে, যাচ্ছে কৃষকদের নিয়ে চিন্তা করার কেউ নেই। আর ঠিক সেই সময়ে দেশের অন্য আর পাঁচটা বন্দর, রেল, জমি জঙ্গলের মতন কৃষি ক্ষেত্রকেও তাঁর বন্ধুদের হাতে তুলে দিতে চান, এই কৃষি ক্ষেত্রের দখলদারি চায় কর্পোরেটরা, তাই তিনি কৃষি বিল এনেছিলেন। মাইনে, সুবিধা আর স্ট্যাটাস এ বিভিক্ত শ্রমিকরা, মোদিকে আটকাতে পারেনি, কিন্তু কৃষকরা এই চাল ধরে ফেলেছে, রুখে দিয়েছে, এবার মূল প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে দেশ, যেই আসুক ক্ষমতায়, যেই থাকুক ক্ষমতায়, তাদের কৃষক আর কৃষিক্ষেত্রের দিকে তাকাতে হবে, তাদের সমস্যার সমাধান করতে হবে, তা না হলে ১০০ ঘা জুতোর বাড়ি আর ১০০টা পেঁয়াজ তো রয়েছেই।