এবার বিখ্যাত কবি ফৈজ আহমেদ ফৈজের কবিতা পাঠে মহারাষ্ট্রের একদল শিল্পী ও সমাজকর্মীদের হিন্দুত্ববাদীদের লাল চোখের, তাদের রোষের মুখে পড়তে হল। ‘হাম দেখেঙ্গে’ কবিতা পাঠে মিলল দেশদ্রোহিতার অভিযোগ। গত ১৩ মে নাগপুরে অভিনেতা ও সমাজকর্মী বীরা সাথিদার স্মরণে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে এই কবিতা পাঠ করা হয়। সেই ‘অপরাধে’ সাথিদারের স্ত্রী পুষ্পা সহ অনুষ্ঠানের আরও দুই আয়োজকের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন দত্তাত্রেয় শিরকে নামে স্থানীয় এক ‘কট্টর হিন্দু’। এই ঘটনায় পুলিশ একাধিক ধারায় মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছে, তারমধ্যে বেশ কটা আবার জামিন-অযোগ্য ধারা। মানে এটা এক নতুন কায়দা, জামিন-অযোগ্য ধারাতে অভিযোগ এনে নিজেদের পুলিশ প্রশাসন দিয়ে জেলে পুরে দাও, বুঝুক বেটা প্রতিবাদের ফল। কেবল যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁদের নয়, অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়েছে। সেখানে নানা ধরনের উসকানিমূলক এবং বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছে।
কী কী উসকানি? কেমনভাবে হিংসা ছড়ানোর কথা বলে হয়েছিল? না, সেগুলো এখনও তাঁরা জানিয়ে উঠতে পারেনি। ভারতীয় ন্যায়সংহিতার ১৫২, ১৯৬, ৩৫৩ ধারায় মামলা করা হয়েছে। অনুষ্ঠানের আড়ালে ছিল এক গোপন ষড়যন্ত্র, দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতার বিরুদ্ধে আয়োজকরা সেই ষড়যন্ত্র করছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গত কয়েকদিন ধরে তাঁদের নানাভাবে হেনস্তা করছে নাগপুরের পুলিশ প্রশাসন। বিখ্যাত অভিনেতা এবং সমাজকর্মী বীরা সাথিদারের মৃত্যুদিবস উপলক্ষে ১৩ মে নাগপুরের বিদর্ভ সাহিত্য সম্মেলনের সভাকক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, তিনি ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন এর আহ্বায়ক ছিলেন এবং মারাঠি পত্রিকা ‘বিদ্রোহী’র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেক ছবির মধ্যে তাঁর অভিনয় করা কোর্ট সিনেমাটা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা ফিচার ফিল্ম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। বীরা সাথিদার স্মৃতি সমবায় সমিতি ও সমতা কলা মঞ্চের যৌথ ভাবে অনুষ্ঠান পরিচালনার উদ্যোগ নেয়। গান, নাচ, নাটকের পাশাপাশি কবিতা পাঠের আসর বসে। অনুষ্ঠানটি অনলাইনেও সম্প্রচারিত হয়েছে। তারই মধ্যে ‘সমতা কলা মঞ্চ’-র কিছু শিল্পী বিশ্ববরেণ্য কবি ও পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ফৈজ আহমেদ ফৈজের ‘হাম দেখেঙ্গে’ কবিতাটি পাঠ করা হয়। কবিতাতে কী আছে? কবিতাটা বিতর্কিত কেন? আসুন আগে কবিতাটা শুনে নিন,
আমরা দেখব, মনে রেখো, আমরা দেখেই ছাড়ব,
আমরা সব দেখব
অনিবার্য সেই আগামী ভবিষ্যৎ, যা আমাদের,
সেই দিনও আমরা দেখব
আমরা দেখব, মনে রেখো আমরা দেখেই ছাড়ব,
আমরা সব দেখব
যখন তোমাদের সব অত্যাচার সব ফতোয়া তুলোর মতো উড়ে যাবে
আম আদমির পায়ের চাপে এই পৃথিবী থর থর করে কাঁপবে
আকাশের থেকে বাজ পড়বে তোমাদের মাথায় ওহে শাসকের দল
আমরা দেখব, মনে রেখো আমরা দেখেই ছাড়ব,
আমরা সব দেখব
যখন মহাকালের সেই দুনিয়া থেকে
নিজেদের ভগবান মনে করা মানুষগুলো উবে যাবে কর্পূরের মতো
যখন মানুষ দখল নেবে তার হৃত সাম্রাজ্য কলকারখানা জল জমিন
সব মুকুট ছুড়ে ফেলে দেওয়া হবে
সব সিংহাসন ভেঙে দেওয়া হবে
আমরা দেখব, মনে রেখো আমরা দেখেই ছাড়ব,
আমরা সব দেখব
নাম থাকবে কেবল তাঁর, যিনি আছেন অথবা নেই
যিনি দ্রষ্টা এবং দৃষ্টি,
আমিই সত্য এই আওয়াজ উঠবে দিকে দিগন্তরে
যে সত্য তুমি, যে সত্য আমি
ক্ষমতা দখল করবেই অমৃতের পুত্ররা
সেই আমি সেই তুমি, আমরা।
আমরা দেখব, মনে রেখো আমরা দেখেই ছাড়ব,
আমরা সব দেখব।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজির ঘুম ভাঙল? নাকি এটাও বিশুদ্ধ নৌটঙ্কি?
হ্যাঁ, এই কবিতাটা পড়ার অভিযোগে স্থানীয় সীতাবুলডি থানায় বীরার স্ত্রী পুষ্পা সাথিদার ও আরও দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে নাকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী বিভিন্ন উসকানিমূলক ও বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়েছে। হ্যাঁ, এটাই অভিযোগকারীদের দাবি। এই বিখ্যাত কবিতা নিয়ে বিতর্ক আজকের নয়, ভারত-পাকিস্তানের নানা গণআন্দোলনে এই কবিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একদিকে পাকিস্তানে যেমন জিয়াউল হক থেকে পারভেজ মুশারাফের স্বৈরাচারী জুন্টা সরকারের বিরুদ্ধে এই কবিতা প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে। জেনারেল জিয়া-উল-হকের পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানের দুই বছর পর , ১৯৭৯ সালে ফৈজ এই কবিতাটি লিখেছিলেন। এই শাসনকালেই পাকিস্তানের গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়েছিল না বলে বলা ভালো গণতন্ত্র ধ্বংস হয়েছিল, জিয়া উল হক আরও কড়া এক ইসলামি রাষ্ট্র তৈরির দিকে এগোচ্ছিলেন, যেখানে ইসলামের শরিয়ত মেনেই চলবে দেশ। আর সেই সময়ে কবিতাটা জিয়াকে চ্যালেঞ্জ করেছিল, বলা হয়েছিল তিনি আল্লাহর নয় বরং ক্ষমতার পূজারী। ১৯৮৬ সালে ইকবাল বানো এই গান গাইবেন বলে জানান, আর মাথায় রাখুন আরও বেশ কিছু বছর কেটে গেছে সেই জিয়া শাসনের, এই কিংবদন্তি পরিবেশনা এমন এক সময়ে হয়েছিল যখন পাকিস্তান এবং তার জনগণ জিয়ার সামরিক শাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। ফৈজের নাতি আলি মাদিহ হাশমিও সেই পরিবেশনায় উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলছেন বিখ্যাত গায়িকা ইকবাল বানো কালো পোশাক পরে হাজির ছিলেন, যা সেই সময়ে ব্যান করা হয়েছিল, তিনি মঞ্চে আসার আগেই হল ‘কানায় কানায় পূর্ণ’ হয়ে গিয়েছিল। হাশমি লিখেছেন, “দরজা খোলার পর, লোকেরা ভিড় জমাচ্ছিল এবং শীঘ্রই হলের এক ইঞ্চিও জায়গা অবশিষ্ট ছিল না। লোকেরা সিঁড়িতে, মেঝেতে, যেখানেই জায়গা পেত সেখানে বসে ছিল। ইকবাল বানো উপস্থিত হয়ে জোরে জোরে গান গাইতে শুরু করলেন। তিনি কনসার্টটি শেষ করার পরেও দর্শকরা তাঁকে যেতে দিতে দিচ্ছিল না, আর তাই তিনি আবার সেই গান গেয়েছিলেন। আলহামরার একজন টেকনিশিয়ান গোপনে সেই আবার গাওয়া গানটা রেকর্ড করেছিলেন এবং এটিই সেই রেকর্ডিং যা আজও টিকে আছে। ফৈজের নাতি বলেছিলেন, আমরা যারা হলটিতে বসে আছি তাদের জন্য এটা ছিল এক অবাস্তব ঘটনা। হাততালি এবং উল্লাস এতটাই তীব্র ছিল যে মাঝে মাঝে মনে হয়েছিল যে আলহামরা হলের ছাদ উড়ে যাবে।” অন্যদিকে ভারতে বাবরি ধ্বংস, গুজরাট গণহত্যা, দিল্লি ধর্ষণকাণ্ড থেকে এনআরসি সিএএ বিরোধী আন্দোলনে এই কবিতা প্রতিবাদীদের মুখে মুখে ফেরে। দুই দেশেই এই কবিতা হয়ে ওঠে শাসকের চক্ষুশূল। পাকিস্তানের মুসলিম মৌলবাদীরা একাধিক বার এই কবিতাকে ‘বিধর্মী প্রচারণার’ তকমা দিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা আবার এই কবিতাকে ‘জেহাদি’ তকমা দিয়ে থাকে। শাসক শ্রেণির অস্বস্তির কারণ হলেও, দু’দেশের মুক্তিকামী মানুষকে এই গান একই সূত্রে বাঁধে। মূল বিতর্কটা কোথায়? ‘হাম দেখেঙ্গে’-র তৃতীয় পংক্তির বিষয় নিয়েই যাবতীয় বিতর্ক। তাতে রয়েছে: ‘হাম এহল-এ-সাফা, মারদুদ-এ-হারাম, মসনদ পে বিঠায়ে জায়েঙ্গে, সব তাজ উছালে জায়েঙ্গে, সব তখত গিরায়ে জায়েঙ্গে, হাম দেখেঙ্গে, যখন আমরা যারা ন্যায়ে বিশ্বাস রাখায় হয়েছিলাম পুণ্যভূমি থেকে নির্বাসিত, পাব আশার অক্ষয় আসন। তখন সকল মুকুট খসে যাবে, সকল সিংহাসনের হবে পতন।
এই লাইনগুলো দু’দেশের শাসককে, ইসলামি মৌলবাদীদের, আবার হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীদের অপছন্দ, তাদের দুদলেরই ধারণা এই কবিতায় দেশের অখণ্ডতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগকারী দত্তাত্রেয় শিরকে কী বলেছেন? তিনি দাবি করেন, ভিডিও-তে আয়োজকদের মধ্যে থাকা এক ব্যক্তি বলেন, ‘যে গানের মাধ্যমে একদিন স্বৈরাচারীরা কেঁপে উঠেছিলেন, সে গানে আমাদের দেশের শাসকদেরও কাঁপিয়ে দিতে হবে। বর্তমানে আমাদের দেশের ফ্যাসিবাদের রাজত্ব চলছে।’ এটা কোন এমন নতুন কথা? কিন্তু হ্যাঁ, এটার জন্যই এফআইআর হয়েছে, তাদেরকে থানা পুলিশ হাজতের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যাঁরা কেবল এক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন, কবিতা পাঠ করেছেন। এই অভিযোগকারীরা স্থানীয় টিভি চ্যানেলে বলেছে আমাদের হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র চেতনাতে আঘাত করার জন্যই এক পাকিস্তানি কবিকে বেছে নেওয়া হল, তাও আবার অপারেশন সিঁদুরের পরে। তাহলে আরও মজার কথা যা ওই হিন্দুত্ববাদী মূর্খরা জানে না, জানার কথাও নয় সেটা বলি। গল্পটি ১৯৭৭-৭৮ সালের। দেশ এ তখন প্রথমবারের মতো একটি অ-কংগ্রেসি সরকার। অটল বিহারী বাজপেয়ী বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সেই সূত্রেই তিনি পাকিস্তানে একটি সরকারি সফরে গিয়েছিলেন। বিদেশমন্ত্রীর একটি প্রোটোকল থাকে। সফরের সময় যাওয়া আসা বৈঠক সবকিছুই আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। কিন্তু বাজপেয়ী প্রোটোকল ভেঙেছিলেন। প্রোটোকল ভাঙার কারণ ছিল তিনি হঠাৎ করেই জানান, তিনি ফৈজ আহমেদ ফৈজের সঙ্গে দেখা করবেন। ফৈজ আহমেদ ফৈজ তখন এশিয়ান-আফ্রিকান রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রকাশনা সভাপতি ছিলেন, যিনি বেইরুটে থাকতেন, কাজ করতেন। আর সেই কাজের সূত্রে তিনিও কয়েকদিন আগে পাকিস্তানে এসেছিলেন।
অটল এবং ফৈজের এই বৈঠকে মানুষ অবাক হয়েছিল। কারণ খুব স্পষ্ট। ফৈজ এবং অটল দুজনে দুটো বিপরীত মতাদর্শ থেকে এসেছিলেন। ফৈজ নিজেকে কমিউনিস্ট মনে করতেন, কিন্তু বাজপেয়ী ছিলেন একজন দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদ। বাজপেয়ী ফৈজের সাথে দেখা করার পরেই তাঁকে বলেন, আমি কেবল একটা শের, কবিতার দুটো লাইনের জন্যই আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। ফৈজ খানিক অবাক হয়েই বাজপেয়ীকে শের পাঠ করতে বললেন। অটল বিহারী বাজপেয়ী ফৈজের এক বিখ্যাত গজল থেকে শের পাঠ করেছিলেন, মকাম ফৈজ কোই রাহ মে জচা হি নহি, মকাম ফৈজ কোই রাহ মে জচা হি নহি, জো কু এ ইয়ার সে নিকলে তো সু এ দার চলে। মানে হল, তাঁর প্রিয়তম সেই ছোট্ট গলি থেকে ফৈজ যখন ফাঁসিকাঠের দিকে যাচ্ছেন তখন এই দুই জায়গার মধ্যে আর কোনও জায়গা তাঁর ভালো লাগেনি। তাঁর নিজের কবিতা ভারতের এক রাজনীতিবিদের মুখে শুনে ফৈজ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। এরপর তিনি কবিতা শোনান, গজল পাঠ করেন, অটল বিহারী বাজপেয়ী ও তাঁর কবিতা শোনান। সমস্ত প্রোটোকল ভেঙে দুজনের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ সাক্ষাৎ চলতে থাকে। তারপর অটল বিহারী বাজপেয়ী ফিরে আসেন, তাঁকে ভারতে আসার আমন্ত্রণ জানান। এরপর ১৯৮১ সালে ফৈজ ভারতে আসেন, অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে দেখা করেন। হ্যাঁ এটাই ছিল আমাদের দেশ, মোদি জমানাতে এ আমরা কোথায় এসে পৌঁছেছি? ফৈজের কবিতা পাঠের জন্য পাকিস্তানে মানুষকে জেলে পাঠানো হয়, মানে বোঝা যায়, কিন্তু তাঁর কবিতা পাঠের জন্য ভারতের মানুষকে জেলে পাঠানো হবে, এটা কি আমরা ভাবতে পেরেছিলাম?