রাম নবমীর দিনে রামের কপালে সূর্যালোকের তিলক পড়েছে, আহা, দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন এই অলৌকিক দিব্য দৃশ্য দেখে তিনি রোমাঞ্চিত, নির্বাচনের প্রচার সবথেকে আগে, মানে প্রায়োরিটি নম্বর ওয়ান তাই তিনি নির্বাচনী প্রচারেই ছিলেন, না থাকলে তিনিই তো থাকতেন ঐ গর্ভগৃহে, আপাতত নেট এ দেখে তিনি আপ্লুত, বলেছে এ এক অলৌকিক আর দিব্য ঘটনা। যিনি হাতির মাথা গণেশের মাথায় জুড়ে দেওয়াকে প্লাস্টিক সার্জারি বলেন, তিনি এরকম কথা বলবেন সেটা খুব অস্বাভাবিক তো নয়। কিন্তু এই বলার মধ্যদিয়ে উনি ওনার যে অজ্ঞানতা, জ্ঞানের অভাব প্রকাশ করলেন তা নিয়ে কটা কথা বলা খুব জরুরি। প্রথম কথা হল রামনবমীর দিনে রাম লালার ললাটে সূর্যালোক এসে পড়েনি, পড়ানো হয়েছে। মানে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে করে রামনবমীর দিনে সূর্যালোক গিয়ে অযোধ্যার ঐ নির্দিষ্ট মন্দিরেই রামের কপালে গিয়ে পড়ে। এ দেশে কোটি কোটি রাম মন্দির আছে, দেশের সর্বত্র আছে তার আরেকটাতেও মন্দিরের গর্ভগৃহে থাকা রাম মূর্তির কপালে সূর্যালোক পড়েনি। এখানে পড়েছে কারন তা পড়ানো হয়েছে, তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং এই ঘটনা অলৌকিক নয়, দিব্য ঘটনাও নয়। এবং এটাও জানিয়ে রাখা দরকার যে এই আলো আনার ব্যবস্থা অতি সাধারণ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব মেনেই ঘটানো হয়েছে, অত্যন্ত সাধারণ কিছু যন্ত্রপাতি দিয়ে এমন আলো আপনি আপনার ঘরের ভেতরে আপনার মা বাবা বৌ বা সন্তানের মাথাতেও ফেলতে পারবেন। কেবল সেই আলোর দৈর্ঘ প্রস্থকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কিছু অতিরিক্ত যন্ত্রপাতি লাগবে। আলোর প্রতিফলন আয়নার সাহায্যে ঘটানো দৈব বা অলৌকিক নয়। যদিও মিথ, ঐতিহাসিক সূত্র জানা নেই কিন্তু যাঁরাই চিতোরগড়ে গেছেন বা রাণি পদ্মীনীর গল্প পড়েছেন তাঁরা সেই কবে থেকেই জানেন এমনটা করা যায়। আসলে এর থেকেও দুরহ এবং আকর্ষণীয় আর্কিটেকচার আমাদের দেশে আছে, যেখানে আলো শব্দ নিয়ে এমন বহু খেলা করা যায়। হায়দ্রাবাদে গোলকোন্ডা দূর্গে প্রধান দরজা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে শব্দ পৌঁছনোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেই কবেই। কিন্তু আজ আমাদের আলোচনা সূর্যালোক নিয়ে। আমাদের দেশে দুটো বড় সূর্য মন্দির আছে যেখানে সামার ইকুইনক্স বা সৌর বিষুব দিন ২১ শে জুন সূর্যের আলো সোজা মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকে পড়ে। ১০২৭ খৃষ্টাব্দে গুজরাটের মধেরা তে চালুক্য বংশের রাজারা এই মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন, উত্তরায়ণের হিসেব কষে এই অসাধারণ মন্দির, মন্দির প্রাঙ্গন আর তারও বাইরের স্টেপ ওয়াল পার করে সূর্যের আলো এখনও পৌঁছে যায় ঐ মন্দিরের গর্ভগৃহে। একই ঘটনা ঘটে কোনারকে যা মধেরা তৈরির তিন বছর পরে তৈরি হয়েছিল। মানে ১০২৭ খৃষ্টাব্দে কোনও যন্ত্র ছাড়াই কেবল জ্যোতর্বিজ্ঞান এর হিসেব কষে সেই সময়ের বাস্তুকারেরা সেই কাজ করতে সক্ষম ছিল যাকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী দিব্য আর অলৌকিক বলছেন। গুজরাটের অমন সুন্দর মন্দিরটিও সম্ভবত উনি দেখেন নি, দেখলেও বোঝেন নি। এ ছাড়াও আমাদের দেশে অমন ছোটছোট সূর্য মন্দির অনেক আছে, আমাদের দেশে সূর্যের এই চলন বোঝার জন্য সূর্যঘড়ি তৈরি করিয়েছিলেন সওয়াই জয় সিং ১৭৩৪ এ, জয়পুরে যন্তর মন্তরে তা আছে। এবং এটাই নয়, সারা পৃথিবীতে এরকম অসংখ্য সান টেম্পল আছে, পেরুতে ইনকা সভ্যতার মানুষেরা সূর্যকেই দেবতা বলে মানতো, কাসকোতে সূর্য মন্দির আছে। তারও বহু আগে, খৃষ্টপূর্বাব্দ ৩০০০ থেকে ১৬০০ র মধ্যে ইংলান্ড এ স্টোন হেঞ্জ তৈরি করা হয়েছিল, সেখানেও ঐ ২১ শে জুন সূর্যালোক অনেকগুলো পাথরের আর্চের মধ্যে দিয়ে এসে পড়ে একটা পাথরে। মানুষ এসব গবেষণা সারা বিশ্ব জুড়ে করেছে, তা ছড়িয়েও গেছে সবখানে, তারই এক খেলনা সংস্করণ নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী উচ্ছসিত, অলৌকিক দিব্য বলে গান ধরেছেন। আসলে রাম ভাঙিয়ে এ যাত্রা পার পেতে চাইছেন দেশের পরধান সেভক। এই সেদিনে সি এস ডি এস লোকনীতির সার্ভে বলছে গরিষ্ঠাংশ মানুষের মতে বেকারত্বই এবারের নির্বাচনে সবথেকে বড় ইস্যু, গরিষ্ঠাংশ মানুষ জানিয়েছেন তাঁদের রোজগার কমেছে বা বাড়েনি, এসব খবর বেরিয়ে আসছে, নির্বাচনী বন্ড এর লুঠমারের কথা বেরিয়ে আসছে, প্রাথমিক হিসেব যা ভাবা গিয়েছিল, গোদী মিডিয়া যা প্রচার করছিল এখন বোঝা যাচ্ছে সে সব সত্যি নয়, অতএব সাহেব ঘাবড়ে গেছেন, তাই রাম আর রামায়ণ, রামের মাথায় তিলক নিয়ে নতুন আবেগ তৈরি করার চেষ্টা করছেন। আমাদের দেশের মানুষের কাছে রাম কি একরকম নাকি? রামায়ণ কি একটা? রাম সীতার গল্পও কি একরকম? তাও তো নয়। অশুভ কে নাশ করে, রাবণ ছিলেন অশুভ র প্রতীক, তাকে নাশ করে শুভ র জয়। রাজা রাম, লক্ষণ হনুমান কে নিয়ে ফিরছেন অযোধ্যায়, অযোধ্যার মানুষজন খুশি, তাদের অন্নের অভাব নেই, তাদের বস্ত্র, বাসস্থানের অভাব নেই। লক্ষ্মী সে রাজ্যে সদা বিরাজমান। সেই রাজ্যে অভাব ছিল শুধু পরম পুরুষ রামের, তিনি আসছেন, রাজ্যের মানুষ খুশি তাই দীপ জালানো হচ্ছে প্রত্যেক অঙ্গনে, প্রত্যেক দেউড়িতে, প্রত্যেক বাটিকায়, রাজপথে বা গলিপথের ধারে, মিষ্টান্ন তৈরি হচ্ছে, গোয়ালার দল দুধ নিয়ে এসে ঢালছেন বড় পাত্রে, ওদিকে অন্ন প্রস্তুত হচ্ছে, সুশিদ্ধ হচ্ছে বিভিন্ন মাংস। রকমফের জন্তু আর পাখির মাংস এনে হাজির করেছে ব্যাধেরা, হ্যাঁ রামায়ণেই লেখা আছে। প্রকৃত রসিক মানুষ সোমরস নিয়ে হাজির, দ্রাক্ষাফল জারিয়ে সে আরক চেখে দেখছেন প্রাজ্ঞ মুনিগণ। দীপের আলোয় অযোধ্যা সরযূ নদীর জল আলোকিত।
এমনটাই লেখা আছে রামায়ণে। এইখানেই বিরাট কেলো। কোন রামায়ন? বাল্মিকী রামায়ণের প্রথম আর শেষ কান্ড, মানে প্রথম আর শেষ অধ্যায় সম্পর্কে গবেষকদের মত, এ দুটো অনেক পরে লেখা হয়েছে, মানে দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম পর্যন্ত বাল্মিকী র রচনা, বাকি দুটো কান্ড অন্য কারোর বা অন্য অনেকের। তাহলে সাত কান্ড রামায়ণের, দুটো খন্ড এমনিতেই বাদ পড়ল বা অন্তত প্রশ্নের মুখে। এরপর বাকি পাঁচ কান্ডেরও বহু ছোট ছোট অংশ প্রক্ষিপ্ত বলে ধারণা, কাদের? যারা রামায়ণ নিয়ে গবেষণা করছেন, তাদের। এদিকে সেই বাল্মিকী রামায়ণের কোনও লিখিত রূপ নেই, যা আছে তাও আবার কেউ একজন পড়ে তার মতন করে লিখেছেন। নানান পুরাণে নানান গল্প লেখা আছে, বৌদ্ধ ধর্মে, জৈন ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে রামের উল্লেখ আছে, কিন্তু সেও নানা রকম। এত ধরণের গল্প আছে যা আসলে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র কেই মনে করিয়ে দেয়। ধরুন, ব্যায়গা রামায়ণ। ব্যায়গা হলো মধ্যপ্রদেশ ছত্তিশগড়ের এক আদিবাসী সম্প্রদায়, তাদের ও নিজেদের রামায়ণ আছে। সেখানে রাম লক্ষণ সীতা বনবাসে গেছেন। একদিন এক অপ্সরা এসে লক্ষণকে প্রপোজ করে বসে, হে লক্ষণ, তোমাকেই আমার ভাল লেগেছে, এসো আমরা দুজনে মিলিত হই। সপাট প্রপোজাল। লক্ষণ সবিনয়ে জানালেন যে না তিনি বিবাহিত, এবং পত্নীনিষ্ঠ, অতএব হে অপ্সরা আমি তোমার প্রোপজালে সায় দিতে পারছি না। অপ্সরা ভাবলো লক্ষণ ঢপ দিচ্ছে, সে পরীক্ষা করার জন্য তার হাতের কানের গয়না খুলে লক্ষণের বিছানায় রেখে দিল। খানিক বাদেই সেখানে সীতা এসে হাজির। বনে থাকলে হবে কি সুপক্ক মাংস এবং সোমরস এদুটো কেবল রাম লক্ষণের নয়, সীতাও ভালবাসতেন। আর মাংসের অভাব হলেই যেতেন ঠাকুরপোর কাছে, গিয়ে আবদার করতেন একটু মাংস এনে দাও রান্না করি। সম্ভবত সেরকম আবদার নিয়েই সীতা এসেছিলেন, আবার সেই মাংসের কথা এই ব্যায়গা রামায়ণেই আছে, সে থাক সীতা ঘরে ঢুকে দেখেন লক্ষণের বিছানায় মেয়েদের গয়না। লক্ষণের বৌ ঊর্মিলা তো সীতারই বোন, অতএব সীতা রেগে গ্যালো, এটার মানে কি? তুমি বোন কে ফেলে এখানে এসে ফুর্তি করছো? লক্ষণ অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো যে ব্যাপারটা আলাদা, কিন্তু কে কার কথা শোনে, সীতা তো রেগে আগুন, সে বলেই যেতে থাকলো। তখন আর কোনও রাস্তা না দেখে লক্ষণ অগ্নিপরীক্ষা দিতে সম্মত হল। আগুনের মধ্য দিয়ে ক্লিনচিট নিয়ে বেরিয়ে এলো। মানে আমরা যে সীতার অগ্নিপরীক্ষার কথা বলি, তার বহু আগেই ব্যায়গা আদিবাসী সম্প্রদায়ের রামায়ণে লক্ষণের অগ্নিপরীক্ষার কথা বলা আছে।
অন্তত দুটো রামায়ণে সীতাকে রাবণের কন্যা হিসেবে দেখানো হয়েছে। নবম খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে গুণভদ্রের লেখা সেখানে অলকাপুরির রাজা অমিতভেগা র মেয়ে মান্যবতির দিকে কুনজর দিয়েছিলেন রাবণ। মান্যবতি এর প্রতিশোধ নেবার জন্য রাবণ মন্দোদরীর কন্যা হয়ে জন্ম নেয়, রাবণ বেদ পুরাণ জ্যোতিষ বিশারদ ছিলেন, তিনি গণনা করে দেখলেন এই কন্যা তাঁর মৃত্যুর কারণ হবে, তিনি এই কন্যাকে এক চরের হাতে দিলেন, কোথাও ফেলে আসতে বললেন। সেই চর যেখেনে ফেলে এলো সেই জমি রাজা জনকের। পরের দিন হাল নাঙ্গল নিয়ে হাজির তিনি ও তাঁর স্ত্রী। হালের ফালের পাশে পাওয়া গেল এক কন্যা কে, হালের ফাল কে বলা হয় সীতা, কন্যার নাম দেওয়া হল সীতা। এই রামায়ণের উপাখ্যানে সীতা রাবণের কন্যা। রাম রাবণের লড়াইটা আসলে শশুর আর জামাই এর।
পঞ্চম খৃষ্টপূর্বাব্দে সংঘদশা রচিত জৈন রামায়ণেও সীতা আসলে রাবণের কন্যা। সেখানে রাবণ জানতে পারে এই কন্যা তাঁর বংশ ধ্বংস করবে, তাই তাকে অনেক দূরে এক মাঠে পুঁতে রেখে আসে। রাজা জনক তাকে খুঁজে পায়।
বেগুসরাই, যেখান থেকে উঠে এসেছেন তরুণ নেতা কানহাইয়া কুমার, তার মুখেই শুনেছিলাম আর এক গল্প। সেখানে সীতার জন্মস্থান ঐ বেগুসরাই তে। এক মন্দিরও আছে, সেইখানে অযোধ্যা থেকে রাম লক্ষণ এসেছিল বিয়ে করতে, বরযাত্রী নিয়ে। সেই কথা মনে রেখে এখনও বছরের নির্দিষ্ট দিনে রাম লক্ষণের মূর্তি নিয়ে অযোধ্যা থেকে বারাতি মানে বরযাত্রিরা আসে দল বেঁধে। রাম সীতার বিয়ে হয়, বরযাত্রীদের পেটপুরে খাবারের আয়োজন থাকে, তার সঙ্গেই থাকে অকথ্য গালিগালাজ, প্রথা অনুযায়ী, গ্রামের মেয়েকে নিয়ে চলে যাচ্ছে তাই গ্রামের মহিলা বৃদ্ধরা অকথ্য ভাষায় সম্বোধন করেন রাম লক্ষণ আর বরযাত্রীদের। সেই প্রথা এখনও বরকরার। গ্রামের মেয়ে চলে যাচ্ছে অযোধ্যা তাই বিদায়ের সময় রাম লক্ষণ আর বারাতির জন্য বরাদ্দ থাকে চোখা চোখা গালিগালাজ। ভাবুন দেখি রাম কে গালিগালাজ, যোগী বাহিনি শুনতে পেলে গলার মাপ নিয়ে ছাড়বে। তিব্বতে রামায়ণের ৬ টা পান্ডুলিপি পাওয়া যায়, একটার সঙ্গে অন্যটার বিস্তর গরমিল। এখানে কিন্তু কুম্ভকর্ণ বধ হচ্ছে না। কুম্ভকর্ণ যুদ্ধ করছেন বটে কিন্তু যুদ্ধে হেরে যাবার পরে আবার খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ছেন। ওদিকে লক্ষণের শক্তিশেলের গল্পটাও নেই, কিন্তু হনুমান যে কৈলাশে এসেছিলেন তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। সেখান থেকে যে ঔষধি নিয়ে গিয়েছিলেন সে গল্পও আছে কিন্তু সেটা যে লক্ষণের জন্য ছিল এমন কথা সেখানে নেই।
ভারতীয় সব ভাষাতেই প্রাচীন রামায়ন কাহিনী পাওয়া যায়, এক একটা ভাষায় একাধিক রামায়ণ। তার গল্প আলাদা, আখ্যান আলাদা, সময় আলাদা, স্থান আলাদা। ধরুন তেলেগু রামায়ণ, বারোশ শতাব্দিতে বুদ্ধ রেড্ডি র রঙ্গনাথ রামায়ণ, ছাড়াও তেলেগুতে ভাস্কর রামায়ণ, ইয়ানা রামায়ণ, মোল্ল রামায়ণ,অচ্চতেন্নু রামায়ণ, কট্টবরদারাজু রামায়ণ ইত্যাদি এক ডজন রামায়ণ আছে। তেলেগু রামায়ণে প্রায় কোনোটাতেই উত্তর কান্ড নেই। সেখানে লব কুশের গল্পও নেই।
১২শ শতাব্দীতেই নাগচন্দ্র পম্পনারায়ণ বা রামচন্দ্র চরিত পুরাণ লেখেন কন্নড় ভাষায়। এখানে রাম ধনুর্ধারী বীর ক্ষত্রিয় নয়, সে অহিংসার পুজারি। কন্নড় ভাষায় ১৩শ শতাব্দীতে কুমুদেন্দু নারায়ণ রচনা করা হয়। কুমুদেন্দু নামে এক জৈন কবি এই রামায়ণ লেখেন, বলাই বাহুল্য এখানেও রাম অহিংসা ত্যাগ তিতিক্ষার প্রতীক, বীরচুড়ামণি হিসেবে নয়। এছাড়াও কন্নড় ভাষাতেই আরও একডজন রামায়ণ রচনা হয়েছে। এডুওচ্ছোন ষোড়শ শতাব্দীতে বিখ্যাত মালয়ালম আধ্যাত্ম রামায়ণ রচনা করেন। কেরালার জনজীবন তাঁদের সংস্কৃতি এই রামায়ণের ছত্রে ছত্রে। অহমিয়া রামায়ণে মোদ্দা চারটে ভাগ, পদরামায়ণ, গীতিরামায়ণ, কথা রামায়ণ কীর্তনীয়া রামায়ণ। কোথাও রাম বৈষ্ণব, কোথাও রাম ক্ষত্রিয়, কোথাও রাম সীতার কাহিনী রোমান্টিকতায় ভরা। হিন্দি সাহিত্যে তুলসিদাসি রামায়ণ ছাড়া ৩৫/৩৬ টা প্রাচীন রামায়ণের খবর পাওয়া যায়। আকবরের সময় বেনারসের অসসি ঘাটে বসে তুলসীদাস যে রামায়ণ রচনা করেছিলেন, তাই এখনও পর্যন্ত আসাম বাংলা বাদ দিলে উত্তর ভারতের মূল রামায়ণ, যা বিজেপি আর এস এস এর ভারি পছন্দের।
মৈথিলি ভাষা, ওড়িয়া ভাষা, মারাঠি ভাষা, গুজরাটি ভাষা, বহু আদিবাসী ভাষাতেও রামায়ণ রচনা হয়েছে, একটা নয়, বহু। এবং বাংলায় কৃত্তিবাসি রামায়ণ।
গবেষকদের অনুমান সারা পৃথিবীতে সাড়ে তিনশর বেশি প্রাচীন রামায়ণ আছে। সেই সব রামায়ণের নির্যাস একটাই অসত্যের ওপর সত্যের বিজয়, অন্যায়ের ওপর ন্যায়ের বিজয়। কিন্তু তার স্থান আলাদা, নানারকম, কল্পনার রথে ছিল ১০৮ টা ঘোড়া, সে তার মত ছুটেছে, কোথাও রাম শাক্ত, কোথাও রাম বৈষ্ণব, কোথাও রাম ক্ষত্রিয় বীর চূড়ামণি কোথাও অহিংসার পুজারী। কথাও সীতা জনকের আসল কন্যা, কোথাও জনকের পালিতা কন্যা, কোথাও রাবণদুহিতা। কোথাও রাম স্বাত্বিক, ফল মূল কন্দ আহরণে ব্যস্ত, কোথাও রাম লক্ষণ সীতা এক সঙ্গে সুপক্ক মাংস খাচ্ছেন এবং সোমরস পান করছেন, সীতা নিজমুখে সেই সোমরসের গুণ বর্ণনা করছেন। কোথাও হনুমান কেবলই রামভক্ত, কোথাও রামের দিকনির্দেশকারী।
আমরা কেবল এই টা জানতে চাই যে আপনারা কোন রামের কথা বলছেন? সাড়ে তিনশ রাম সীতা হাজির, আপনাদের সামনে। কোন রাম? যোগী রাজ্য? যেখানে রেফ্রিজেটারে গোমাংস রাখা আছে বলে মানুষকে একলাখ আহমেদ কে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়, সেই যোগী জী জানেন? মোদীজী জানেন? এমন রামকথা আছে যেখানে বলা হচ্ছে রাজা জনকের চার কন্যা সীতা, ঊর্মিলা, মান্ডভি আর শ্রুতকীর্তি র সঙ্গে রাম লক্ষণ ভরত শত্রুঘ্নর বিয়ে দেন। বিয়ে তো হয়ে গ্যালো। পরদিন সকালে এবার তারা বশিষ্ঠমুনির সঙ্গে রওনা দেবেন অযোধ্যা, সেখানে রাজা দশরথ অপেক্ষা করছেন। এদিকে সেই সকালেই রাজা জনকের দূত খবর দিলেন, মহারাজ তিনি আসছেন? কে? ঋষি পরশুরাম। ওমনি রাজা জনক আদেশ দিলেন পঞ্চ শারদীয় সেবার, সেটা কী? ১৭ টা ৫ বছরের কম বয়সী গরুর মাংস রান্না করে মুনি ঋষিদের খাওয়ানো। পরশুরাম ও তার শিষ্যদের এলে তাঁদের সেই খাবার খাওয়ানো হলো। এও রামায়ণেই আছে, গুজরাটে, মোদীজীর দেশে মদ্যপান নিষেধ, এদিকে এক রামায়ণেই সীতা আক্ষেপ করছেন যে ১৪ বছরের বনবাসে তাঁর সুপক্ক মাংস আর সোমরস জুটবে কিনা সন্দেহ আছে। এটাই ভারত, এখানে রাম থাকে হৃদয়ে যার যার নিজের মতন, তাকে এক মন্দিরে বেঁধে ফেলার সাধ্য কার। রাম নিশ্চই থেকে যাবেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের লড়াইএর প্রতীক হয়ে, আসুরিক বৃত্তির বিরুদ্ধে মানবিক আচরণের প্রতীক হয়ে। পরধান সেভক যেভাবে রামের ব্যাখ্যান দেবেন তাই আমরা মেনে নেবো, তা তো হয় না, আমাদের রাম লক্ষণ সীতা আমাদের মনে আছে, সাহিত্যে আছে, সমাজে আছে, ধর্মেও আছে, থাকবে।