একটা কথা বলিনি, একটা প্রশ্নও করিনি, প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে, সরকারকে, যুদ্ধের দিনগুলোতে আমাদের সেনাবাহিনীর জয় কামনা করেছি, চেয়েছি সুস্থ শরীরে তাঁরা ঘরে ফিরুন। চারদিনে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে বলে আমরা মাননীয় সৌগত রায়ের মতো মুষড়ে পড়িনি, কেবল ক’টা মিসাইলের এদিক ওদিক আনাগোনায় আমাদের রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল, প্রাজ্ঞ মানুষ, দিনে রাতে বহু মিসাইল দেখেছেন সারা জীবনে তাই হয়তো অমনটা বলেছেন। আমরা খুশি, যুদ্ধবিরতি হয়েছে। আমরা তো সেই কবে থেকেই গান গাই, ভয় নেই এমন দিন এনে দেব বোমারু জঙ্গি যত বিমানের ঝাঁক থেকে বোমা নয়, গুলি নয়, চকলেট, টফি রাশি রাশি প্যারাট্রুপারের মতো ঝরবে শুধু তোমারি তোমারি উঠোন জুড়ে প্রিয়তমা। তো সেই আকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধবিরতি এসেছে, দু’ দেশের মানুষ কেবল বিরতি নয়, স্থায়ী সমাধান চায়, শান্তি চায়। এবং আজ আর মিসাইল উড়ছে না, উড়বে না জেনেই ক’টা কথা বলা। যখন যুদ্ধ চলে, যখন উগ্রপন্থী হানা চলে তখন নিজের দেশের সরকারকে বিব্রত করতে নেই, কাজ করতে দিতে হয়। এটা বেদে লেখা নেই, এটা কমন সেন্স। সেই সেন্স কি ছিল আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এর আগে?
২০০৮ সালের ২৬/১১ মুম্বই হামলার দু’দিন পর, অর্থাৎ ২৮ নভেম্বর, তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মুম্বইয়ের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে সেখানে পৌঁছন। তখনও শহর জঙ্গিদের দখলে ছিল। সেদিন তিনি ওবেরয় ট্রাইডেন্ট হোটেলে যান, যে হোটেলটিও হামলার অন্যতম প্রধান নিশানা ছিল, এবং সেখানে সংবাদমাধ্যমের সামনে কথা বলেন। মোদি সেদিন বলেছিলেন, দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের জাতির উদ্দেশে ভাষণটা অত্যন্ত হতাশাজনক আর তা নাকি দেশের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তাই তখনই সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ক এক বৈঠকের দাবি জানান। জঙ্গি হামলায় নিহতদের রক্ত তখনও শুকায়নি, নিরাপত্তাবাহিনী তখনও পাকিস্তান-প্রশিক্ষিত জঙ্গিদের সঙ্গে গুলি বিনিময়ে ব্যস্ত, সেই সময়েই মোদি মুম্বইয়ের মাটিতে দাঁড়িয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করেছিলেন। ২৯ নভেম্বর, রাজস্থান ও দিল্লির আসন্ন রাজ্য নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে, বিজেপি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় পাতাজোড়া রক্তের ছিটে লাগানো বিজ্ঞাপন ছাপিয়েছিল, “নৃশংস জঙ্গি হামলা চলছে অবাধে। দুর্বল সরকার। অক্ষম এবং অনিচ্ছুক। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করুন। ভোট দিন বিজেপিকে।” মানে এক সন্ত্রাসের ঘটনাকে নির্লজ্জভাবে নির্বাচনের প্রচার করে তুলেছিলেন। কিন্তু এই ধরনের সরকারবিরোধী বক্তব্য বা প্রচারের জন্য মোদি বা বিজেপির বিরুদ্ধে কোনও এফআইআর দায়ের হয়নি। এমনকী যখন দেশ সরাসরি পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসের মুখোমুখি ছিল, তখনও তারা সরকারের জবাবদিহি চেয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য রেখেছিল, কেউ কোনও মামলা করেনি।
তারও বহু আগে, তখন সবে দেশ স্বাধীন হয়েছে, দেশের মানুষের মুখে খাবার জোগাতেই সরকার নাজেহাল, তার মধ্যে এসেছিল যুদ্ধ, ৬২-র যুদ্ধ, চীনের হানাদারি। হানাদারি শেষ হয়নি, তখন এক তরুণ সাংসদ চেয়েছিলেন সংসদের বিশেষ অধিবেশন চাই, প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদত্যাগ চাই। হ্যাঁ পদত্যাগ করেছিলেন কে পি এস মেনন, হ্যাঁ ডাকা হয়েছিল সংসদের বিশেষ অধিবেশন, সেই অধিবেশনে সেই তরুণ সাংসদ, পরবর্তীতে দেশের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুড়ে সরকারকে নাজেহাল করেছিল, তাঁর বাগ্মীতায় খুশি সেদিনের প্রধানমন্ত্রী নেহরু বলেছিলেন, অটল তুম একদিন প্রধানমন্ত্রী বনোগে। হ্যাঁ এটাই তো সেই সহনশীলতা যা আমাদের এই উপমহাদেশের রক্তে বয়। কিন্তু সরকার, কোনও কারণ ছাড়াই ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করে দিচ্ছে, পরে বাধ্য হয়ে তুলেও নিয়েছে। সে যাই হোক, যুদ্ধ শেষ এখন তো কুছ সওয়াল বনতা হ্যায়। বিশেষ করে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর এতাবত সবচেয়ে ছোট ২১ মিনিটের কম এক বক্তৃতার জন্য। কারণ যুদ্ধ চলাকালীন তিনি বিহারের নির্বাচনী প্রচারে গেছেন, তিনি বলিউডের নাচাগানায় হাজির থেকেছেন, এবং আমরা তখন কোনও প্রশ্ন করিনি আজ তো করবই।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | যুদ্ধ শেষ, বিজেপি নেমে পড়েছে বিষ ছড়াতে, ঘৃণা ভাষণে
এক্কেবারে ওনার জবানি বলছি, “ভারতের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপে পাকিস্তান এমন ক্ষতির মুখে পড়েছিল, যা তারা কল্পনাও করতে পারেনি— এটা প্রথম তিনদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই ভারত যখন প্রবলভাবে আঘাত হানতে শুরু করে, পাকিস্তান তখনই পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। তারা বিশ্বজনীন মহলের কাছে কাকুতি-মিনতি শুরু করে, উত্তেজনা কমানোর আবেদন জানাতে থাকে। ভারতের আক্রমণে প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতির পর, ১০ মে দুপুরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আমাদের ডিজিএমও-র (DGMO) সঙ্গে যোগাযোগ করে। তখন পর্যন্ত আমরা পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদের পরিকাঠামো বড় মাত্রায় ধ্বংস করে দিয়েছি। সন্ত্রাসবাদীদের খতম করেছি। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে গড়ে তোলা জঙ্গি ঘাঁটিগুলো আমরা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি। এই অবস্থায়, পাকিস্তান যখন অনুরোধ জানায় এবং প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা আর কোনও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বা সেনা-সাহসিকতা দেখাবে না, তখন ভারত সেই অনুরোধ বিবেচনায় নেয়। এবং আমি আবারও বলছি— আমরা শুধু আমাদের প্রতিশোধমূলক অভিযান আপাতত স্থগিত করেছি, পাকিস্তানের সন্ত্রাস ও সেনা ঘাঁটির বিরুদ্ধে।” ওনার ২১ মিনিটের ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশের মাত্র এইটুকুর এক্কেবারে বাংলা অনুবাদ দিলাম। এবং এইটুকু থেকে মাত্র তিনটে প্রশ্ন উঠে আসছে।
ভারত যখন প্রবলভাবে আঘাত হানতে শুরু করে, পাকিস্তান তখনই পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। তারা বিশ্বজনীন মহলের কাছে কাকুতি-মিনতি শুরু করে, উত্তেজনা কমানোর আবেদন জানাতে থাকে। কোন দেশের কাছে তারা মানে পাকিস্তান গিয়েছিল তাদের কাকুতি মিনতি নিয়ে? কোন সংবাদপত্রে, কোন তথ্য থেকে এটা জানা গেল? কথা তো সব্বাই বলছিল আমাদের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর একবার রুবিওর সঙ্গে কথা বলছেন একবার ভ্যান্সের সঙ্গে কথা বলছেন, এসব তো যুদ্ধের সময়ে হতেই থাকে, কিন্তু এই কাকুতি মিনতি? কার কাছে? আমরাও তো গর্ব করে বলতে চাই, যে আমাদের পরাক্রমে ভয় পেয়ে পাকিস্তান বিশ্বের ওই দেশের কাছে গিয়ে কাকুতি মিনতি করছিল। তথ্য কই? তারপরে তাদের বিরাট ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পরে তাঁরা মানে তাদের মিলিটারি কর্তা, ডিজিএমও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, শান্তি চাইলেন। একজন ডিজিএমও শান্তি চাইলেন আর অমনি শান্তি হয়ে গেল? তার আগে সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ স্তরে, সরকারের সর্বোচ্চ স্তরে আলোচনা কার কার সঙ্গে হয়েছিল? এটা তো একজন শিশুও বিশ্বাস করবে না যে একজন ডিজিএমওর কথায় যুদ্ধবিরতি হয়ে গেল, হয়ে যায় বা যেতে পারে। আমরা ধরে নিচ্ছি তারপরের আলোচনার কথা আপনি গোপন রাখতে চান, বেশ। তাহলে তার বদলের প্রশ্নটা হল দু’ দেশের বলার আগেই কী করে সেটা ট্রাম্প সাহেব জানিয়ে দিলেন। মানে ভারতবাসী তো ট্রাম্প সাহেবের টুইটার দেখেই জানতে পারল যে যুদ্ধবিরতি হয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা তার আধঘণ্টা পরে করা হল।
আচ্ছা চলুন এটাও মেনে নিলাম যে যেই যুদ্ধবিরতির কথা হল অমনি আপনি আনন্দের আতিশয্যে, ট্রাম্প সাহেব আপনার পুরনো বন্ধুকে ফোন করে বলে দিলেন, আর উনিও বিরাট উৎফুল্ল হয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই সব্বাইকে তা জানিয়ে দিলেন। না তাও তো নয়, কারণ ট্রাম্প সাহেব আপনার সেদিনের জাতির প্রতি এই নড়বড়ে ভাষণের আগে, আবার সেই আধ ঘণ্টা আগে এবং সেই ভাষণের ৬ ঘণ্টা পরে আবার পৃথিবীর মানুষকে সাংবাদিকদের সামনেই বলেছেন, “আমি ভারত আর পাকিস্তানকে বলেছি আমরা অনেক সাহায্য করেছি, বাণিজ্য দিয়েও সাহায্য করেছি। আমি বলেছিলাম, ‘চলো, তোমাদের সঙ্গে আমরা প্রচুর বাণিজ্য করব। এই যুদ্ধ বন্ধ করো। যদি বন্ধ করো, বাণিজ্য করব। যদি না করো, তাহলে কিছুই করব না। কেউ আগে বাণিজ্যকে এমনভাবে ব্যবহার করেনি, যেভাবে আমি করেছি। তখনই ভারত ও পাকিস্তান বলল, ‘আমরা থামছি’। তারা থেমেও গেল। এর পেছনে অনেক কারণ ছিল, তবে বাণিজ্য ছিল বড় একটি কারণ। আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে প্রচুর বাণিজ্য করব, ভারতের সঙ্গেও করব। এখন ভারতের সঙ্গে আলোচনা চলছে, শিগগিরই পাকিস্তানের সঙ্গেও হবে। আর আমরা একটা পারমাণবিক যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছি।” আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলছেন তিনি যুদ্ধ থামালেন, হ্যাঁ তিনি বলছেন যুদ্ধ থেমেছে, আর মোদিজি বলছেন পাকিস্তানের ডিজিএমও আমাদের জানায় যুদ্ধ বিরতির কথা, তিনি বলার পরে আমরা রাজি হই।
কে সত্যি বলছেন? মুশকিল হল, পাকিস্তান তো বলছে যে হ্যাঁ ট্রাম্প সাহেব বলেছিল, আমরা সেই কথায় রাজি হয়েছি। তো মোদিজি বলুন, অন্তত এটা তো বলুন যে না ট্রাম্প সাহেব যা বলছেন সেটা ভুল বলছেন। এবং এরপরেও আর একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মোদিজি বলেছেন, সেটা হল, “এই অবস্থায়, পাকিস্তান যখন অনুরোধ জানায় এবং প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা আর কোনও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বা সেনা-সাহসিকতা দেখাবে না, তখন ভারত সেই অনুরোধ বিবেচনায় নেয়।” এ তো বিরাট ব্যাপার। গত ৫০ বছরের বিভিন্ন কনফ্লিক্ট-এ পাকিস্তান কোনওদিন স্বীকারই করেনি যে তারা ভারতের ভিতরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ করেছে, চালিয়েই গেছে, তারা স্বীকার করে নিল? তো তাদের মোদিজি বললেন না কেন যে ওই চারজন সন্ত্রাসবাদীদের ফেরত দিন। বলেছেন? পাকিস্তান কোথায়, কখন কাকে কীভাবে বলেছে যে তারা আর সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালাবে না? তার কোনও প্রমাণ আছে? একজন ডিজিএমও বলল, আর সরকার মেনে নিল? এবং তারা যদি এসব বলার পরেই আর কোনও সেনা সাহসিকতা দেখাবে না এর ভিত্তিতে ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধ বিরতিতে সায় দেন, তাহলে সেদিন রাতেই কেন আবার পাকিস্তান একদফা অ্যাটাক করল? কেন তার পরের দিনেও জম্মু শ্রীনগরে ড্রোন হামলা হল? কেন যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরেও কাশ্মীর সরকারের একজন সিনিয়র অফিসার সমেত বেশ কয়েকজন সেই আক্রমণে মারা গেলেন, যা হয়েছিল যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার পরে? প্রধানমন্ত্রী আসলে যা সত্যি তা মানুষকে বলতে পারছেন না, তিনি বলছেন না, আর বলছেন না বলেই নানান গুজব ছড়াচ্ছে, তার মধ্যে শুনলাম একটা গুজব নাকি উনিজির কানেও পৌঁছেছে। সেখানে বলা হয়েছে যে দেশ ফেশ ওসব বকওয়াস, ট্রাম্প সাহেব নাকি বলেছেন আদানিকে জেলে পুরে দেব, ব্যস। মোদিজি যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছেন। যদিও বলে রাখি এই গুজবে আমরা কেউ বিশ্বাস করি না, করতে চাই না, আমার দেশের প্রধানমন্ত্রী এত নীচে নামতে পারবেন? না, বিশ্বাস হয় না।