১৯৫৬ তে মাও সে তুং আমেরিকা নিয়ে কয়েকটা কথা বলেছিলেন, In appearance it is very powerful but in reality it is nothing to be afraid of; it is a paper tiger. Outwardly a tiger, it is made of paper, unable to withstand the wind and the rain.
আমেরিকাকে দেখতে দারুণ শক্তিশালী মনে হতেই পারে, কিন্তু আসলে তাকে ভয় পাবার কিছুই নেই, আমেরিকা আসলে এক কাগুজে বাঘ। বাইরে থেকে বাঘের মত দেখতে হলেও, আসলে তা কাগজ দিয়ে তৈরি, সাধারণ ঝড় বৃষ্টিও সহ্য করতে পারে না। তা যে কত বড় সত্যি তা আর একবার প্রমাণ হয়ে গেলো। ৯/১১র কুড়ি বছর বর্ষপূর্তিতে যাদেরকে তাড়িয়ে তারা আফগানিস্তানে ঢুকেছিল, তাদের হাতে দেশ ছেড়ে দিয়ে পালালো, কেবল পালালো বললে ভুল হবে, প্রাণ হাতে করে পালানোর সময় চুক্তিটা ছিল, আমাদের প্রাণ হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে দাও, পেছন থেকে যেন বুলেট না এসে বেঁধে, কেবল এইটুকু আশ্বাস নিয়েই তারা আফগানিস্তান ছাড়ল। প্লেনে চড়ার সময়েও বন্দুক দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করলো সাধারণ আফগান নাগরিকদের। পেছনে পড়ে রইল কারা? আফগানিস্তানে সদ্য স্কুলে যেতে শেখা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের, কলেজে ভর্তি হওয়া কিশোরীদের, সদ্য মেটাল রক শুনে, তা ভালোবেসে ফেলা আফগান যুবকদের। ইতিমধ্যেই নাম করে ফেলেছে, এমন প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন চলচিত্র পরিচালকদের, একটা গোটা ঝকঝকে ক্রিকেট টিমের খেলোয়াড়দের, এই ক বছরে গজিয়ে ওঠা অজস্র বিউটি পার্লারের মালিক ও কর্মচারীদের। অজস্র মানুষ যারা বিশ্বের আর দশটা দেশের মানুষের মত খেয়ে পড়ে আনন্দে দিন কাটাতে চায়, তাঁদের। সেই স্বপ্ন দেখা মানুষজন পড়ে রইল, মার্কিনিরা তাদের কড়া সৈনিকের পোষাক খুলে এখন সোজা ঘরের পানে, আমরা তোমার শান্তপ্রিয়, শান্ত ছেলে। তাদের নেতা বাইডেন, সাংবাদিকদের ডেকে বলে দিল, আমরা দেশগঠনের ঠিকে নিইনি, আমাদের ছেলেদের লাশের বোঝা আর আমরা বইতে রাজি নয়, আফগানরা বুঝে নিক তাঁদের ভবিষ্যৎ, আমরা সাতে পাঁচে নেই, যেন রুদ্রনীল ঘোষ।
আরেক গড়াপেটা খেলা চলল, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল আফগান বাহিনী, আমেরিকান ফৌজ তল্পিতল্পা গুটিয়ে প্লেনে চড়ল। ঘানি বাবা তাঁর সাকরেদদের নিয়ে দেশ ছেড়ে পালালো, খড়কুটো সরানোর মত তালিবানরা সরকারি বাহিনীকে সরিয়ে কাবুলে ঢুকে পড়ল, প্রেসিডেন্ট প্যালেসে বসে নাস্তা করল। এদিকে সারা বিশ্বে কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে? আমেরিকা ভাবছে আমেরিকার কথা, রাশিয়া ভাবছে দোরগোড়ায় যারা এসে বসেছে তাদের সঙ্গে ঝগড়া করে কী হবে? চীন ভাবছে এদের মদতে উইঘুররা না সক্রিয় হয়ে ওঠে, তাছাড়া তাদের মাথায় আছে দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়া জুড়ে ব্যবসা আর ভারত সীমান্তের স্ট্রাটেজিক জায়গাগুলোতে নজরদারি, ইংল্যান্ড চায়না তাদের দেশে ইসলামিক টেররিস্টরা বেড়ে ওঠে, তারা চায় না শত্রু নয়া আফগান সরকার সেই শক্তিদের কাবুলে বসে নিয়ন্ত্রণ করে, ইরান চায় আমেরিকার বিরোধী শক্তির সমন্বয়, পাকিস্তান তো ছাগলের তৃতীয় সন্তান, এবার বাগে পাওয়া গেছে ভারতকে, অতএব তাদের আনন্দ দেখে কে? এমন কি ভারত সরকারও তালিবানদের সঙ্গে আলোচনার দরজা খুলে রেখে কূটনৈতিক খেলায় সামিল। কেবল চারজন মহিলাকে দেখা গেল হাতে পোস্টার নিয়ে কাবুলের রাস্তায়। তাঁরা প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তারা তালিবান রাজ চায় না, বিশ্বের মানুষদের কাছে তাঁদের কাতর আবেদন, আমাদের দাবার ঘুঁটি বানিয়ে এই খেলা বন্ধ করুন।
অথচ আজ নয়, সেই কবে থেকে আফগানিস্তানদের নিয়ে এ খেলা চলছে নিরন্তর। সেই ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশরা দখল করতে চেয়েছিল আফগানিস্তানকে, বুঝেছিল, বড্ড কঠিন সে ঠাঁই। আফগানরা বশ্যতা স্বীকার করার পাত্র নয়। তিনখানা অ্যাংলো আফগান যুদ্ধ হবার পরে চুক্তি হল, আফগানিস্তানের শাসন সেখানকার গোষ্ঠীপতিদের হাতে থাকবে, সামরিক ব্যবস্থা, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি থাকবে ব্রিটিশদের হাতে। কাগজে কলমে তা ছিল, কিন্তু আফগানিস্তান তো ছোট্ট জায়গা নয়, তার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন গোষ্ঠীপতিদের আধিপত্য, তারাই সেখানে শেষ কথা। আলেকজান্ডার থেকে শক, হুন, মোঘলরা বারবার আক্রমণ করেছে আফগানিস্তান, শাহজাহান থেকে ঔরঙ্গজেব কতবার চেষ্টা করেছেন কন্দাহার থেকে গজনী দখল করতে, কাবুল থেকে হেরাটে সাম্রাজ্য ছড়িয়ে দিতে, পারেননি। যুদ্ধে হেরে গিয়ে আফগান ওয়ার লর্ডসরা কিছুটা পিছিয়েছে, মোঘল সম্রাট দিল্লি ফেরার আগেই আবার স্বাধীন হয়ে গিয়েছে তারা। আফগান চরিত্র। সেই আফগানরা ব্রিটিশ শাসনের মধ্যেই নেতাজীকে আশ্রয় দিয়েছে, সীমান্ত পার করিয়ে দিয়েছে। শেষমেষ ব্রিটিশদের তৈরি ডুরান্ড লাইন, না আফগানরা কোনও দিন মেনে নেয়নি। আচ্ছা ওই রুক্ষ অঞ্চলের দখলদারি নিয়ে ব্রিটিশরা অত চিন্তিত কেন ছিল? তাদের মাথাব্যাথা ছিল জারের রাশিয়া নিয়ে, রাশিয়া চলে এলে বিপদ, অতএব তারা দখলদারির কথা ভেবেছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ছবিটা বদলে গেল, ব্রিটিশরা পাততাড়ি গোটালো। কিন্তু রাশিয়া দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়াতে তাদের বাফার স্টেটের দিকে হাত বাড়ালো, আফগানিস্তানে তাদের বন্ধু সরকার থাকলে তাদের লাভ। বন্ধু সরকার হল। বাবরাক কারমাল সরকারের সময় অন্তত কাবুলের চেহারাই ছিল অন্যরকম। কিন্তু আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে তখনও সেই একই চেহারা। তবুও একধরনের নিয়মতান্ত্রিক সরকার ছিল। শরিয়তি আইন ইত্যাদি বড় শহরে লাগু হত না। পাকিস্তান দুরবর্তী অঞ্চলে আফগান ওয়ার লর্ড, মোল্লাদের সমর্থন দিত। কাবুল সরকার ছিল সোভিয়েত ঘেঁষা, এবং ভারতের বন্ধু। এবার আমেরিকার নজর পড়ল, কোল্ড ওয়ারের খেলায় আফগানিস্তানেও নামল তারা। তৈরি হল মুজাহিদিন, তাদের অস্ত্রশস্ত্র যোগান দিতে শুরু করল আমেরিকা, ভায়া পাকিস্তান। পাকিস্তানের ভারত বিরোধিতা আর আমেরিকা প্রেম শুরু হল। আমেরিকার সাহায্যে মুজাহিদিনরা ঢুকতে শুরু করল, সোভিয়েত রাশিয়া তাদের সাহায্য পাঠাতে শুরু করল, সরাসরি আমেরিকা রাশিয়ার খেলা। সোভিয়েত ভাঙনের আগেই গোর্বাচভের সময়ে রাশিয়া তাদের সৈন্য তুলে নেবার কথা বলল। বাবরাক কারমালকে সরিয়ে নাজিবুল্লা বসলেন ক্ষমতায়। সোভিয়েত সরে যেতেই মুজাহিদিনরা ক্ষমতা দখল করল। ইতিমধ্যে তালিবানরা শক্তি সঞ্চয় করেছে, তারা এসে দখল নিল শুধু নয়, নাজিবুল্লাকে মেরে ট্রাকের পেছনে বেঁধে রাজপথ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হল, তার ভাইকেও। তারপর মৃতদেহ টাঙিয়ে দেওয়া হল ল্যাম্পপোস্টে। শুরু হল গৃহযুদ্ধ, না আছে আমেরিকা, না রাশিয়া। আহমেদ শাহ মাসুদ আর রশিদ দোস্তম লড়ে গেল তাদের সঙ্গে। তালিবানরা আশ্রয় দিল আল কায়দাকে। ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানেই ঘাঁটি গাড়লেন। তালিবানরা, আল কায়দা, আরও কিছু ইসলামিক টেররিস্ট গ্রুপ যারা এতদিন আমেরিকা পাকিস্তানের সাহায্য পেয়েছে, তারা হয়ে উঠল ফ্রাঙ্কেস্টাইন। এরপর ৯/১১। আবার আমেরিকা আফগানিস্তানে হাজির, এই নিয়ে তৃতীয়বার, এবার সরাসরি, কী চাই? আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় আমেরিকা, তাই ফৌজ নিয়ে হাজির। ওসামা বিন লাদেন চাই, আকাশ থেকে বোমা ফেলে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার পরেও তালিবানরা দূর প্রদেশে টিঁকে গেলো। আহমেদ শাহ মাসুদকে খুন করার পরেও তালিবানদের পিছোতে হল। হামিদ কারজাইয়ের সরকার তৈরি হল। এবারেও সেই সরকার ভারতবর্ষের বন্ধু সরকার। পাকিস্তানের কাজ শেষ, ওসামা বিন লাদেনও মারা গেছে আমেরিকার হাতে। সবচেয়ে বড় কথা অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকার আর কিছু পাবার নেই, তারা এটাও বুঝেছে যে এই অঞ্চলে তাদের আর কোনও স্বার্থ নেই, তারা পিঠ বাঁচিয়ে চলে গেল। আবার তালিবানদের দখলে কাবুল। কারোর কারোর মনে হচ্ছে এই তালিবান সেই তালিবান নয়? এমনকি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী দলের মুখপত্রেও বড় প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে, এই তালিবান নাকি সেই তালিবান নয়, সিপিএম তাত্বিক নেতা নীলোৎপল বসু সেই লেখা তাঁর ফেসবুকে শেয়ারও করেছেন। ক’দিন পরে তাঁদের মুখ থেকে শুনতে পাব এই আরএসএস ওই আরএসএস নয়, এই মোদি আলাদা, আগেকার মোদি নয়। এদিকে রাস্তায় মহিলাদের বেত মারাও শুরু হয়েছে, প্রকাশ্যে গুলি করে মারাও চলছে, সংবাদপত্র দফতরে হানাও চলছে এবং সব থেকে বড় কথা ইসলামিক রিপাবলিক অফ আফগানিস্তান এখন ইসলামিক এমিরেট অফ আফগানিস্তান হয়ে গেছে, শরিয়তি আইন মেনেই দেশ চলবে, তালিবান নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন।
সোভিয়েত রাশিয়া চলে গেছে, তার আর কোনও স্বার্থ নেই, আজকের রাশিয়া চায় আফগানিস্তানে বসে তাদের দেশে বোমাবাজি না করলেই হল। আমেরিকা বিশ্বের সবদেশকে গণতন্ত্রের শিক্ষা দেয়, ভিয়েতনাম থেকে পালিয়েছে, সেই একই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিমান দেশ ল্যাজ গুটিয়ে পালালো, চীন তার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। আফগানিস্তানের নাগরিকদের সামনে তালিবান, জঙ্গলের রাজত্ব। সেই কাবুলিওলার কথা ভাবুন, মিনিকে যে খোঁকি বলে ডাকত, যার পকেটে ছিল তার মেয়ের ভুষোকালিতে মাখানো অস্পষ্ট হাতের ছাপ, যে তার পকেট থেকে মেওয়া দিত মিনিকে, তার মেয়ের কথা মনে পড়ত, সেই কাবুলিওলার কথা ভেবেই না হয় চোখের জল ফেলুন, প্রত্যেক স্বাধীনচেতা আফগান এখন সেই কাবুলিওলা, অসহায় কাবুলিওলা। তার হাত দুটো বাঁধা, পাশে কালাশনিকভ হাতে নিয়ে তালিবান।